শুরুতেই যখন থেমে যায় জীবন
স্বপ্ন আর আশা কেড়ে নেয় মরণ।
সাজনা বেগম এমনই একজন হতভাগ্য মা। যার বয়স ২০ বছর। গ্রামের বাড়ি হবিগঞ্জ জেলার পাঁচপাড়িয়া নামক এক প্রত্যন্ত গ্রামে। প্রায় দুই বছর আগে একই গ্রামের সাজলু মিয়ার সাথে বিয়ে হয় সাজনা বেগমের। সাজলু মিয়া পেশায় কৃষিজীবি। রোজগার ভালই ছিল। বিয়ের পর সুখেই কাঁটছিল তাদের জীবন। জীবনকে আরো সুন্দর, অর্থবহ করে তোলার জন্য, মাতৃত্বের স্বাদ নেয়ার জন্য সাজনা বেগম গর্ভবতী হন।কিন্তু দুর্ভাগ্য বশতঃ সেটি গর্ভপাত হয়ে যায়।পরবর্তীতে তিনি আবার গর্ভধারণ করেন। তার LMP ছিল ০৮.০৬.২০১০ইং তারিখে।তাই আগামী ১৫.০৩.২০১১ইং তারিখের মধ্যে সাজনা বেগম মা হবে এমন সম্ভাবনাই উকি দিতে থাকে ধীরে ধীরে। ২ মাস, ৩ মাস, ৪ মাস, ৫ মাস এমন করে পেটের ভিতর লালন করে একটি স্বপ্ন, ধীরে ধীরে তৈরি হয় মাতৃত্বের অহংকার। এ সময়টাতে মেয়েরা তাদের মায়ের কাছে থাকতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। তাইতো সাজনা বেগম চলে আসে মা-বাবার কাছে। তারা থাকেন সিলেট সিটি কর্পোরেশনের ১০নং ওয়ার্ড অর্ন্তগত শামীমাবাদ এলাকায়। গ্রামের বাড়ি ছেড়ে কিছু উপার্জনের আশায় এই শহরে পাড়ি জমায় প্রায় তিন বছর আগে। এখানে তারা একটি মেছ গড়ে তোলে। যার প্রধান ভোক্তা রিকসা/ভ্যান চালকেরা। উপার্জন ভালই। এখানে একটি ভাড়া বাড়িতে থাকেন তারা। পাশেই থাকেন ব্র্যাকের স্বাস্থ্যসেবিকা নিলুফা বেগম। সাজনা বেগম এখানে আসার এক মাসের নিলুফা সংবাদ পায় সাজনা বেগম গর্ভবতী। সংবাদ দেয় ব্র্যাক স্বাস্থ্যকর্মী হোসনা আক্তারকে। উদ্দেশ্য গর্ভবতীকে চিহ্নিত করতে হবে, তাকে প্রসব পূর্ববর্তী সেবা দিতে হবে, মায়ের লালিত স্বপ্নের বাস্তবায়নে সহযোগিতা করতে হবে।
পূর্বে একটি গর্ভপাতের ইতিহাস থাকার কারণে সাজনা বেগমকে হাসপাতালে চেকআপ করানোর পরামর্শ দেন স্বাস্থ্যকর্মী।তিনি সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চেকআপও করিয়েছেন ২ বার। কোন ধরনের সমস্যা ধরা পরেনি। তবে সাজনা বেগম প্রায় সময়ই তার কানে ব্যাথার কথা বলতো।প্রথম দিকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি কেউ। তবে হঠাৎ করে একদিন প্রচন্ড রকমের অসহ্য কানের ব্যাথার কারনে তার স্বামী তাকে জালালাবাদ রাকিব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডাক্তার দেখানোর জন্য নিয়ে যায়। হাসপাতালের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী অমহল্লার এক ঔষধের দোকান থেকে ঔষধ কিনে খায়। ঔষধ খাওয়ার কয়েক ঘন্টা পর সাজনা বেগমের সমস্ত শরীর ঘেমে যায় এবং আবোল-তাবোল বকতে থাকে। খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেয়। পরদিন অবস্থা আরো খারাপের দিকে যায়, পাগলের মতো আচরণ করতে শুরু করে। শরীর থেকে সকল কাপড়-চোপড় খুলে ফেলছে। এমতাবস্থায় সাজনার বাবা কোন প্রকার উপায় না দেখে স্থানীয় হুজুরের নিকট থেকে পানি পড়া এনে মেয়েকে খাইয়েছেন।
কাজ হচ্ছে না। মেয়ে তার ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। একে একে খসে পড়ছে লালিত স্বপ্নবৃক্ষের পাতা গুলো।সেবিকা নিলুফা বাড়ি ছিল না। যখন বাড়িতে আসলো তখন সাজনা বেগমের অবস্থা প্রায় আশংকাজনক। এমন অবস্থা দেখে নিলুফা সাজনা বেগমের বাবাকে পরামর্শ দেন তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য।কালক্ষেপন না করে বাবা তার মেয়েকে নিয়ে দ্রুত সরকারী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করান। এখানে মেয়ের চিকিৎসার অবহেলা দেখে অন্য একটি বেসরকারী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করান। চিকিৎসা ভাল ভাবেই চলছিল। ডাক্তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সাজনার বাবাকে বলল, যদি আপনার মেয়েকে বাঁচাতে চান তবে তার পেটের বাচ্চাকে বের করে ফেলতে হবে। যে কথা সে কাজ। মেয়ে বেঁচে থাকলে আরো বচ্চার জন্ম দিতে পারবে।ফরসেফ ডেলিভারীর মাধ্যমে সাজনার পেট থেকে একটি মৃত বাচ্চা বের করে আনেন হাসপাতালের ডাক্তাররা। সাজনা বেগম এক সময় জ্ঞান হারিয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়,যা আর কোন দিন ফিরেনি।সাজনা বেগম পৃথিবীর মায়া ছেড়ে স্বপ্নলোকে পাড়ি জমান।
আর সাথে সাথেই মা-বাবার কন্নায় ভারী হয়ে উঠে হাসপাতালের বাতাস। হৃদয় বিদারক এক দৃশ্যের অবতারণা ঘটে যায় হাসপাতাল চত্বরে। এই সুন্দর হাতে আর আঁকবেনা ছবি। ঘরের চার পাশে আর কোন দিন সাজিয়ে রাখবে না নিজ হাতে তৈরি সুন্দর সুন্দর ওয়ালম্যাট। পিঠের উপর লুটাবেনা আর লাল ফিতে বাঁধা চুলের বেণী। এসবই কান্নার উপকরণ।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ডিসেম্বর, ২০১২ সন্ধ্যা ৬:৫১