জীবন কেড়ে নেয় যখন মৃত্যুর কড়াল গ্রাসে
স্বপ্ন মায়া আর অহংকার শেষ হয় নিমেশেই।
মিনা বেগম একজন হতভাগ্য মা। যার বয়স ৩৫। প্রায় ১৭/১৮ বছর আগে বিয়ে হয় ১৮৬,একতা,নরসিংটিলা, বাগবাড়ি, সিলেট নিবাসি মোঃ আলাউদ্দিন মিয়ার সাথে। আলাউদ্দিন মিয়া পেশায় একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। বিয়ের পর সুখেই কাঁটছিল তাদের জীবন। জীবনকে আরো সুন্দর, অর্থবহ করে তোলার জন্য, মাতৃত্বের স্বাদ নেয়ার জন্য মিনা বেগম গর্ভবতী হন। একটি ফুটফুটে মেয়েও হয় তার। এখন মেয়েটির বয়স পনের। এরপর দুই বছর পার না হতেই আবার গর্ভবতী হন মিনা বেগম। এবারও মেয়ে হয় তার।পরিবারের অন্যান্য সকলের মতোই মন খারাপ হয়ে যায় পিতা আলাউদ্দিন মিয়ার। আশা ছিল এবার বুঝি ছেলে হবে তার। বংশের প্রদ্বীপ জ্বালাবে। কিন্তু তার আশা পূরণ হয়নি। ছেলের আকাঙ্খা থেকেই যায় আলাউদ্দিন মিয়ার মনে। মেয়ে বলে তেমন যত্ন-আত্বি করতো না শিশুটিকে। অবহেলা আর অনাদরে মেয়েটি বেড়ে উঠতে লাগল, কিন্তু আদর-ভালবাসার অতৃপ্তির কাছে হার মেনে মাত্র ৯ মাস বয়সে প্রচন্ড জ্বরে আক্রান্ত হয়ে একদিন সবাইকে ফাঁকি দিয়ে চলে যায় না ফেরার দেশে। মায়ের অন্তরের হাহাকার আর মেয়ের মৃত্যু শোক মা মিনা বেগমকে অসহায়ত্বের এক মুরতি বানিয়ে দেয়।বছর তিনেক পর আবার গর্ভবতী হন মিনা বেগম। এটা তার তৃতীয় গর্ভ। পরিবারের সকলের আশা এবার বুঝি ছেলে হবে তার।
সবার মধ্যে একটা চাপা আনন্দ বিরাজমান। ভাগ্যের কি নির্মমতা! এবারও তার মেয়ে হয়, তাই বুঝি সবার চাপা আনন্দ টুকু পরিণত হয় মৃদু ক্ষোভে। মায়ের বুক আবার ভরে উঠে সন্তানের উষ্ণতায়। দেখতে দেখতে মেয়ে তার বড় হতে থাকে। আর এদিকে ছেলের আকাঙ্খা যেন আরও দ্বিগুণ গতিতে বাড়তে থাকে আলাউদ্দিন মিয়া ও তার পরিবারের অন্যান্য লোকজনের মনে। তাই মিনা বেগম ৪র্থবারের মতো গর্ভেধারণ করেন আরেক সন্তান। এবার ছেলে হয় সত্যি কিন্তু ছেলেটি অপরিণত অবস্থায় হাসপাতালে জন্ম নেয়। এখানেও ভাগ্যের এক নির্মম পরিহাস। জন্মের মাত্র ৯ দিনের মাথায় ছেলেটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। কষ্ট আর ভাগ্যের নির্মম কষাঘাতে আজ তারা জর্জরিত। মায়ের বয়স এখন ৩১। শারিরীক অবস্থাও খুব একটা ভাল নেই। ভাগ্যর নিকট অসহায়ত্ব প্রকারশ করে তারা সিদ্ধান্ত নেয় আর বাচ্চা নেবে না। পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতিও ব্যবহার কার শুরু করে দেয়। ব্র্যাকের স্বাস্থ্যকর্মী রেহেনা আক্তার নিয়মিত খানা ও দম্পতি পরিদর্শনে যেতেন এবং পদ্ধতির তথ্য লিখতেন মিনা বেগমের কথা মতো। এভাবে কিছু দিন যাবার পর একদিন পাশের বাসার এক মহিলা বলেন মিনা আপা তো গর্ভবতী। পরে মিনা বেগমকে স্বাস্থ্যকর্মী যখন জিজ্ঞাসা করেন তখন তিনি বলেন ভুলে হয়ে গেছে তাই আপনার নিকট বলতে লজ্জা পাচ্ছিলাম। মিনা বেগমের বয়স এখন ৩৫। এটা তার ৫ম গর্ভ। যখন স্বাস্থ্যকর্মী রেহেনা মিনা বেগমকে চেকআপ করে রেজিঃ করে তখন তিনি ৭ মাসের গর্ভবতী। তার শারীরিক অবস্থা ভালই ছিল। রক্তচাপ ও অন্যান্য দিকগুলোও ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু অধিক বয়স এবং গর্ভসংখ্যা বেশি থাকার কারণে কিছুটা ঝুঁকিপর্ণতার লক্ষণ তার মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। যার কারণে স্বাস্থ্যকর্মী মিনা বেগমকে নিয়মিত হাসপাতালে স্বাস্থ্য চেকআপ ও প্রসব করার পরামর্শ প্রদান করেন। তিনিও হাসপাতালে এবং স্বাস্থ্যকর্মী রেহেনা বেগমের নিয়মিত স্বাস্থ্য চেকআপ করাতেন। মিনা বেগম স্বাস্থ্যকর্মীর কথা মতো একটি বেসরকারী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রসব করান।ইপিসিউটমির মাধ্যে তার ডেলিভারী হয়। এবারও তার মেয়ে সন্তান হয়। ছেলে বুঝি তার ভাগ্যে নাই। কি আর করা বিধাতার যা ইচ্ছা। প্রসব পরবর্তী পরিচর্যা গুলোও স্বাস্থ্যকর্মী যথা সময়ে প্রদান করেছে। প্রসবের পর ৭ দিনের ও ২৮ তম দিনের ভিজিট দিয়েছে স্বাস্থ্যকর্মী।মিনা বেগমের কোন প্রকার জটিলতা খুজে পায়নি স্বাস্থ্যকর্মী।স্বাভাবিক সুস্থ্য মানুষের মতোই নিত্যকার কাজকর্ম করছেন মিনা বেগম। গত ১৪/০১/২০১১ইং তারিখে অন্যান্য দিনের মতোই কাজকর্ম সেরে রাত আনুমানিক সাড়ে এগারটার দিকে শুয়ে পড়েন। রাত বারটার দিকে তিনি শারীরিক ভাবে অসুস্থ্যতা বোধ করেন। হঠাৎ করে শরীরে অস্থিরতা অনুভব করেন এবং একাধিক বার বমি করে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। এমতাবস্থায় তার স্বামী আলাউদ্দিন মিয়া ফোন করে বাড়িতে এ্যাম্বুলেন্স নিয়ে আসেন এবং মিনা বেগমকে সিলেট এম.এ.জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে রাত আনুমানিক দেড়টার দিকে ৩ নং ওয়ার্ডে ভর্তি করানো হয়। ভর্তির পর মিনা বেগমকে স্যালাইন ও ইনজেকশন দেয়া হয়।চিকিৎসাধীন অবস্থায় হঠাৎ তার খিচুনি উঠে।হাসপাতালের ডাক্তারা অনেক চেষ্টা করেও মিনা বেগমকে আর তার ৩৭ দিন বয়সী মেয়ের কাছে ফিরিয়ে দিতে পারল না। ভোর ৪:৪৫ মিনিটে পরিবার ও স্বামী-সন্তানের মায়া ত্যাগ করে না ফেরার দেশে চলে যান মিনা বেগম।মৃত্যুর প্রমাণ পত্রে ডাক্তার মৃত্যুর কারণ লিখেছিল-“ Irreversible cardio respiratory block due to stroke”. শেষ
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ডিসেম্বর, ২০১২ সন্ধ্যা ৭:২৭