নতুন এই দেশটাতে নতুন মানুষগুলো তাদের মুখের ভাষায় কি বলে,অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। দেশে থাকতে বাংলা,ইংরেজি আর বড়জোর একটু খানি উরদু বুঝতাম।তাও আবার আমার পাকিস্তানী রুমমেট আমনা আসলামের মুখ থেকে শুনে শুনে।
আর এক পাকিস্তানী ক্লাসমেট ছিল...মেহেরুননেসা, লাহোরের মেয়ে। ও যখন প্রথম আমাদের সাথে ক্লাসে জয়েন করল,কেমন যেন ঝিম মেরে থাকত মেয়েটা। একদিন বলল,তোমাদের এখানে শীপ,মানে জাহাজ কই?
শুনে অবাক,জাহাজ আসবে কোত্থেকে?
বলল,ও নাকি শুনে এসেছে আমাদের দেশটা নদীতে ভরা,সব জায়গায় চলতে হয় নৌকা দিয়ে।
ওর কথা শুনে মনে পড়ল,আমাদের দেশটা একদিন নদীমাতৃক দেশ ছিল।
হায়রে, সেদেশের আজ কি অবস্থা!
ভাষা আন্দোলোনের ইতিহাসটা ও জানত,তাই খুব অবাক হয়েছিল যখন আমি ওর কাছে উরদু শিখতে চেয়েছিলাম।
তবে মেডিকেলের গাদাগাদি পড়ার চাপে দুদিনেই আমার উরদু শেখার বারোটা বেজে গিয়েছিল।পরে অবশ্য আমনা আর মেহের খুব ভাল বাংলা বলতে পারত। আমার আর উরদু শেখা হয়ে ওঠেনি
যাই হোক,এসেছি ডয়েসল্যান্ডে। মানে জার্মানীতে। এরা ইংলিশ বলেও না,বোঝেও না। যারা বলতে পারে তারাও বলতে চায়না। এরা চায় যে সবাই এদের ভাষা শিখুক।
বাসার পাশেই শপিংমল। কিছু কিনতে গেলে হ্যালো আর চুজ দিয়েই চালিয়ে নিতে হতো। চুজ হল tschuss ,মানে বিদায়। এরপর আস্তে আস্তে শিখলাম guten tag(শুভ দিন ), guten morgen (শুভ সকাল ) ইত্যাদি ইত্যাদি...
একদিন ডিম কিনব,খুজে পাচ্ছিনা।
কত ভাবেই বুঝাই...তারা কিছুতেই কিছু বোঝেনা।
Egg বলি,হাত দিয়ে দেখিয়ে দেই...বোঝেনা।
পরে ইশারায় মুরগী বোঝাতে পারলাম,তখন বুঝল। জানলাম এরা ডিম কে বলে Eier.
বুঝলাম এই দেশে ভাষা না শিখে রেহাই নেই। ভর্তি হলাম ভাষা কোর্সে। চোখে চশমা পরা ইতালিয়ান মহিলা আমাদের টিচার।
শুরুতেই বলল,ich heise Mirella.
Wie heist du?
বলার ধরনে বুঝলাম,তার নাম মিরেলা।
আর সে আমার নাম জানতে চাচ্ছে।
তারপর ঠিক তার মত করেই বললাম
ich heise...
এভাবেই শুরু হল অজানা ভাষার অজানা বুলি মুখে তুলে নেবার প্রয়াস।
কোথা থেকে এসেছি বলার জন্য শিখলাম,
ich komme aus Bangladesh.
এই কথাটা বলতে ভাল লাগত অনেক।
আমাদের টিচার অনেক ভাল ছিল,আর সত্যিই হয়তো যেকোনো নতুন ভাষা শেখা অনেক আনন্দের,তাই আমি খুব...খুবই উপভোগ করতাম এই ক্লাস।
আনা মারিয়া আর হোসে ব্রাজিলের, ভু ,ওয়াং লি, আর মিন চিনা, সোয়েতলানা আর ভিটালি ইউক্রেনের, বার্সেলোনার আনা আর ওলগা, ইরানের সাইফ,পাকিস্তানের ইউসরা আর কানমাল, ইজিপ্টের জাকারিয়া। সবার সাথে খুব অল্প সময়েই ভাল বন্ধুত্ব হয়েছিল। অবাক হয়েছিলাম অনেকেই একেবারেই ইংরেজি জানেনা দেখে।
একদিন মিরেলা comparative শেখাচ্ছিল।
যেমন,
Peter ist besser als Min( peter is better than min)
অনেকগুলো শেখানোর পর আমাদেরকে নতুন বাক্য তৈরী করতে দিল।
লিখলাম,
Bengali ist schoner als deutsch
মানে,বাংলা ডয়েসের চেয়ে ভাল।
মিরেলা খুব মজা পেল। আমি ও বেচে গিয়েছিলাম।
কারন ভাগ্যিস সে ইতালিয়ান ছিল।জার্মান ছিলনা।
তিনমাসের এই কোর্সটার শেষের দিকে অবাক হয়ে দেখলাম,যে ভাষাটাকে সেখা একদিন অসম্ভব মনে করেছিলাম,ছোট্ট ছোট্ট বাক্যে আমি এখন তা বলতে পারি,আর অন্যদের কথাও বুঝতে পারি অনেকটাই।নতুন একটা ভাষা শেখার অদ্ভুত আনন্দ মনে দোলা দিচ্ছিল।
কোর্স শেষে পরীক্ষা হল। ৮৭% নম্বর পেলাম। মিরেলার প্রশংসাও পেলাম।
শেষের দিন সবাই বাড়ি থেকে খাবার বানিয়ে এসেছিল। আমি মোগলাই করেছিলাম। সবাই খেয়ে খুব খুশি।
খাবার শেষে চলছিল গল্পগুজব।মিরেলা কে বললাম,তুমি তো ভাষা শেখাও,তুমি কি মাতৃভাষা দিবস জান?
কেউই জানেনা।
বিষয়টা সত্যিই খুব দুঃখজনক।
কিছুদিন আগে বৃটিশ কাউন্সিলের ওয়েবসাইটে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস সম্পর্কে অনেককিছু দেখলাম। ওরা একটা আলাদা সংখ্যা বের করেছে ২১ ফেব্রুয়ারী নিয়ে। কিন্তু কোথাও বাংলাদেশের কোন কথা নেই। ইতিহাসটা আমাদের,কিন্ত আমাদেরকে কেউ চেনেনা।
মনে হল,আসলে আমরাই অন্যদেরকে জানাই না।
তাই এই সুযোগটা হাতছাড়া করলাম না।
টানা ৭/৮ মিনিট বলে গেলাম এই ইতিহাস।
পিনপতন নিরবতায় সবাই শুনলো।
অনেকে অনেক প্রশ্ন করল।
কথা শেষ হলে মিরেলা ধন্যবাদ দিল এই ইতিহাসটা জানানোর জন্য।
একটা ছোট্ট দেশের ছোট্ট মানুষ হয়েও গর্বে আমার বুকটা ভরে উঠল!
নিজের দেশটাকে হঠাৎ আরো নিজের ,আরো আপন বলে মনে হলো!
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জুলাই, ২০০৮ রাত ১০:৩৮