যারা ভূতে বিশ্বাস করেন না, বা করতে চান না তাদেরকে আজকে আবার একটা সত্য ঘটনা শুনাব-
লচনা কাকাটা যে কি সময়মত দোকানের মালগুলো নিয়ে আসবে, আর উনি কিনা আড্ডা মারছে। আমি রাগে গজগজ করতে লাগলাম। এমন সময় কুলিদের সর্দার বিষু কাকা দৌড়ে এসে বলল- বাবা সর্বনাশ হয়ে গেছে লচনাতো দাঁড়ানো থেকে মাটিতে পড়ে গেছে। দৌঁড়ে গিয়ে দেখি মুখ দিয়ে লালা পড়ছে। হুঁশ নেই। কোলে করে উনাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম। প্যারালাইসিস। অনেক চিকিৎসা করার পর বাঁচানো গেল, কিন্তু মুখটা বেকে গেছে, দুইটা হাতই অচল হয়ে গেছে, হাটতে পারে সেটাও খুব কষ্টে। কাকার জন্য খুব কষ্ট হতো। এরপর প্রতিদিন সকালবেলা আমাকে এসে বলত বাপু দুইটা টাকা দে। আমি পাঁচ-দশ টাকা দিতাম। একদিন সকালবেলা শুনি কাকা আর নেই।
আশ্বিনের মাঝামাঝি। আকাশে সাদা সাদা মেঘের বেলা অপরুপ চিত্রকর্ম তৈরি করে রেখেছে। এমন দিনে সবাই মাছ ধরতে যায়। মাছ ধরতে গেলে বুকে সাহস লাগে। কারন তখন নাকি মাছ খেকোদের আনাগোনা বেড়ে যায়।
ছোটবেলা থেকেই আমার মাছ ধরার খুব সখ ছিল। আমাদের বাড়ীর কাছেই ছিল কংশ নদী, জোকা বিল, জাম বিল, সোনাইনদী আর আমাদের পুকুরতো ছিলই। তাই সুযোগ পেলেই মাছ ধরতে চলে যেতাম সেসব জায়গায়।
এমনি এক শরতে ইউনিভার্সিটি বন্ধ পেয়ে সোজা বাসে বাড়িতে যাওয়ার জন্য। সন্ধায় বাজারে আড্ডায় মাছ ধরা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা। আমিন, শওকত নাকি গতরাতে একটা বিশাল বোয়াল পেয়েছে। মনকে আর বাঁধ মানাতে পারলাম না। আমিন, শওকতকে বললাম আমাকেও নিয়ে যাওয়ার জন্য।
রাতে বাসা থেকে খেয়ে বাজারে আসার সময় চরে দেখি দুটি বাতি জ্বলছে। (উল্লেখ্য যে আমাদের বাসার ঠিক পিছনেই হলো চর। চরকে ঘিরে ইউ আকৃতির কংশ নদী। চরের একদিকে গোরস্থান, আর ডানদিকে নদীর তীরে শশানঘাট)। বুঝতে পারলাম কেউ মাছ ধরছে। কে.. কে.. এখানে মাছ ধরে? ঐ আমি আমিন। তোরানা আমারে নিয়া যাবি। আমরা এইখানেই আছি তুই আয়। আমি বাজারে না গিয়া বাসায় ঢুকলাম। নাল বাতি, কুঁচ, টর্চ এবং খালই(মাছ রাখার বাঁশ দিয়ে তৈরি বিশেষরকম পাত্র) নিয়ে দৌড় দিলাম।
গোরস্থানের কাছে যেতেই আমাকে দেখে কি যেন সরে গেল। বুকের ভিতর ধপ করে উঠল। টর্চ লাইট দিয়ে দেখলাম দুটি শেয়াল আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে আছে। রাতে গোরস্থানে শেয়াল আসে কবর খুঁরে লাশ খাওয়ার জন্য। আমি সোজা আমিনদের কাছাকাছি চলে আসলাম। ওরা আমার সামনে, আমি পিছনে পিছনে মাছ ধরছি।
অন্ধকার খুব অন্ধকার রাত ছিল সেদিন। পানির ওপর বাতি ধরে ধরে খুব তীক্ন দৃষ্টি দিয়ে মাছ দেখছিলাম। হঠাৎ একটি সা-ঝাক শব্দ। কি মাছ জানতে চাইলাম। মাগুর। কিছুক্ষণ পর আমিন বলল চল শশানঘাটে চলে যায়। গভীর রাতে শশানঘাট নীরব থাকে বলে প্রচুর মাছ পাওয়া যায়।
ধূপ এবং পোড়া কাঠের গন্ধ নাকে আসল। নদীর খাঁড়া পাড় বেয়ে নিচে নামলাম। সন্তপর্নে খুব সন্তপর্নে এগুতে লাগলাম। পানির নিচে দেখলাম লাল লাল চোখ নিয়ে কি যেন ছুটাছুটি করছে। ভাল করে তাকিয়ে দেখি চিংড়ি মাছ। আমিন আর শওকতকে দেখা যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে সা-ঝাক করে একটি শব্দ। বুঝতে পারলাম কাছাকাছিই আছে। ততক্ষণে মাছের নেশা এতই বেড়ে গেল যে কারও কথা মনে নেই। আমি নদীর বাঁক ধরে ধরে সামনে আগাচ্ছি।
হঠাৎ......হঠাৎ......নদীর ভিতর একটি শব্দ হলো। মনে হলো কোন মাছ খেকো দানব একটি কুমিরকে গিলে ফেলার চেষ্টা করছে। আর ঐ কুমির নিজেকে বাচানোর জন্য এই চেষ্টা করছে। আবারও শব্দটা হলো। আমি টর্চ লাইট দিয়ে শব্দের উৎপত্তিটা বুঝার চেষ্টা করলাম। এক জায়গায় পানির কম্পন দেখে বুঝতে পারলাম শব্দটা ঐ জায়গা থেকে আসছে। দূর থেকে মনে হলো বোয়ালের বরশীর মাঝে কোন বড় বোয়াল আটকা পড়েছে। এই সময় লোকজন নদীর তীরে সারি বেঁধে বোয়ালের বরশী গেথে যায় এবং রাতে পাহাড়া দেয়। এইসব লোকজন অনেক সাহসী হয়। চিন্তা করলাম বোয়ালটা নিতে পারলে ভালই হতো। কিন্তু একলা একলা পানিতে নামতে সাহস পেলামনা। আমি আমিনকে ডাকলাম। কিন্তু কোন সারাশব্দ নেই।
বোয়াল মাছের লোভ ত্যাগ করে আমি সামনে চললাম। মনে হচ্ছে আমার সাথে অনেকেই চলছে। মনে মনে ভাবলাম আমার পায়ের শব্দে নদীর পাড়ে প্রতিধ্বনি হচ্ছে এইজন্য এমন মনে হচ্ছে। কিছুক্ষন পরে খেয়াল করলাম হাজারও পা আমার সাথে এগুচ্ছে। আমি ভয়ে জোড়ে হাটতে লাগলাম। সামনে তাকিয়ে দেখি হাজারও কঙ্কাল সাড়ি বেধে দাড়িয়ে আছে। যেন কোন কঙ্কাল মারা গেছে তাই সবাই মিলে তার জানাযা পড়ছে।
ভয়ে আমার শরীর দিয়ে ঘামের ঝড়না বইতে লাগল। ভয়ে ভয়ে সামনে টর্চ লাইট মারলাম, দেখি মরা পাট গাছ সারি বেধে দাড়িয়ে আছে। বন্যার পানিতে পাট গাছ পচে শোলা হয়ে দাড়িয়ে আছে। আর সাদা পাট শোলাতে নালবাতির আলো পড়ে দূর থেকে ঠিক কঙ্কাল মনে হচ্ছে। আমি কতগুলো পাটশোলা একসাথে করে পাট দিয়ে বাধলাম। তারপর তাতে কতটুকু কাঁদা মেখে কেরোসিন দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিলাম এবং সেই আলোতে সামনে দৌড়াতে লাগলাম।
দপ দপ শব্দ হতে লাগল। কত খারাপ চিন্তা মনে আসতে লাগল। লচনা কাকার কথা খুব মনে পরে গেল। সামনেই লচনা কাকার শশান। এই জায়গাটা একটু সরু। তারপরও আমি যতটা সম্ভব জোড়ে হাটার চেষ্টা করতে লাগলাম।
লচনা কাকার শশানের সামনে যখন আসলাম শুনতে পেলাম- বাপু দুইটা টাকা দিয়া যা। আমি পিছনে না তাকিয়ে দৌড়াতে লাগলাম। দূর থেকে ফযরের আযান শোনা যাচ্ছে। আমার ভয়টা কেটে গেল। বাসায় চলে গেলাম।
পরদিন সকালে বাজারে যাওয়ার পর আমিন আমাকে বলল আজ মাছ ধরতে যাব তুই রেডী থাকিস। গতকাল অমাবস্যা ছিল তাই যায়নি। আমি থ হয়ে গেলাম।