ইসলাম যে সভ্যতা ও সংস্কৃতির আশা করে তা তখনই অস্তিত্ব লাভ করতে পারে যখন ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে পবিত্র শান্তিময় সমাজ গঠন করা সম্ভব হয়। পবিত্র সমাজ গঠনের জন্যে আবশ্যক হচ্ছে যে,পারিবারিক ভিত্তিতে স্বামী-স্ত্রীর পবিত্র বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে জীবনের যে সূচনা হয় তার সৌন্দর্য ও দৃঢ়তা। আর তখনই সম্ভব যখন স্বামী-স্ত্রী উভয়ে তাদের বৈবাহিক জীবনের নীতি ও কর্তব্য সম্পর্কে সুন্দরভাবে অবহিত থাকে এবং ঐ সকল নীতি ও কর্তব্য পালনে উভয়ে সচেতন হলে তাদের জীবন সুখময় হয়।
স্বামীর সাথে সম্পর্কিত নীতি ও কর্তব্যসমূহ
১. স্ত্রীর সাথে উত্তম আচরণের অভ্যাস করবে। তার অধিকারসমূহ স্বতস্ফূর্তভাবে আদায় করবে এবং প্রত্যেক ব্যাপারে উপকার ও আত্মোৎসর্গের পন্থা অবলম্বন করবে, আল্লাহ তাআলা বলেছেন-
“তোমরা স্বামীরা তোমাদের স্ত্রীদের সাথে উত্তম আচরণ করবে”।
রাসূল (সাঃ) বিদায় হজ্বের ভাষণে বিপুল জনতাকে সম্বোধন করে বলেছেন শুন! নারীদের সাথে উত্তম আচরণ করো, কেননা,তারা তোমাদের নিকট কয়েদীর মত আবদ্ধ, তাদের পক্ষ থেকে কোন প্রকার অবাধ্যতা প্রকাশ পাওয়া ব্যতীত তাদের সাথে তোমাদের খারাপ আচরণ করার কোন অধিকার নেই। তারা যদি কোন অপরাধ করেই ফেলে তাহলে তাদের বিছানা পৃথক করে দাও আর তাদেরকে যদি মারতেই হয় তাহলে এমনভাবে মারবে না যাতে তারা মারাত্মক আঘাত পায়-অতঃপর তারা যদি তোমাদের কথামত চলতে আরম্ভ করে তখন তাদের ব্যাপারে অনর্থক অজুহাত খুঁজবে না।
তোমাদের কিছু অধিকার তোমাদের স্ত্রীদের ওপর আছে, তাহলো তারা তোমাদের বিছানাকে ঐ সকল লোকদের দ্বারা পদদলিত করবে না যাদেরকে তোমরা অপছন্দ করো আর তোমাদের ঘরে এমন লোকদের কখনো প্রবেশ করতে দেবে না যাদেরকে তোমরা অপছন্দ করো। শুন! তোমাদের অধিকার এই যে, তোমরা তাদেরকে যথাসাধ্য ভাল খানা খাওয়াবে এবং উত্তম কাপড় পরিধান করাবে।
(রিয়াদুস সালেহীন)
অর্থাৎ খানাপিনার এমন ব্যবস্থা করবে যাতে স্বামী-স্ত্রীর অনুপম নৈকট্য আন্তরিক সম্পর্ক ও বন্ধুত্বের যথোপযুক্ত নিদর্শন পরিস্ফুটিত হয়।
২. যথাসম্ভব স্ত্রীর প্রতি সুধারণা পোষণ করবে। তার সাথে জীবন-যাপনে ধৈর্য্য, সহ্য এবং সহনশীলতার পরিচয় দেবে। যদি তার আকৃতি অথবা শুভ্যাস ও চরিত্র অথবা আচার-ব্যবহার এবং জ্ঞান বুদ্ধিতে কোন ত্রুটিও থাকে তাহলে ধৈর্য্যের সাথে তা মেনে নিবে আর তার মধ্যে যেসব গুণ আছে তার প্রতি লক্ষ্য করে উদারতা, ক্ষমা, ত্যাগ এবং আপোষমূলক আচরণ করবে।
আল্লাহ তাআলা বলেছেন,’ওয়াছলুহু খায়রুন’ ‘আপোষকামিতা বড়ই উত্তম’।
মুমিনদের হেদায়তের উদ্দেশ্যে আল্লাহ পাক বলেছেন-
“অতঃপর কোন স্ত্রী যদি তোমাদের অপছন্দ হয় তাহলে সম্ভবতঃ তার মাত্র একটি বিষয় তোমাদের অপছন্দ অথচ আল্লাহ তার মধ্যে (তোমাদের জন্যে) অনেক ভাল জিনিস রেখে দিয়েছেন”।
(সূরায়ে নিসা-১৯)
উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ
“কোন মুমিন তার ঈমানদার স্ত্রীকে ঘৃণা করবে না, যদি স্ত্রীর কোন এক অভ্যাস তার অপছন্দও হয় তবে সম্ভবতঃ তার অন্য স্বভাব পছন্দনীয় হবে”।
মূলকথা হলো, প্রত্যেক মহিলার মধ্যে কোন না কোন ত্রুটি অবশ্যই থাকবে। যদি স্বামী তার কোন একটি দোষ দেখেই তার থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় এবং মন খারাপ করে ফেলে তাহলে কোন পরিবারেই পারিবারিক সুখ-শান্তি পাওয়া যাবে না। উত্তম পন্থা হলো এই যে, স্ত্রীদেরকে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবে এবং আল্লাহর উপর ভরসা করে স্ত্রীর সাথে সুখে শান্তিতে জীবন-যাপন অতিবাহিত করার চেষ্টা করবে। সম্ভবতঃ আল্লাহ তাআলা ঐ স্ত্রীর মাধ্যমে এমন কিছু উত্তম বস্তু দান করতে পারেন যা পুরুষের দুর্বল দৃষ্টি শক্তির অনেক ঊর্ধ্বে। যেমনঃ হয়তো স্ত্রীর মধ্যে দীন, ঈমান, স্বভাব ও চরিত্রের এমন কিছু বৈশিষ্ট্য আছে যার জন্য সে পূর্ণ পরিবারের জন্য রহমত হিসেবে পরিগণিত হতে পারে অথবা তার থেকে এমন একটি সু-সন্তান জন্মলাভ করতে পারে যার দ্বারা দ্বারা সমগ্র পৃথিবী উপকৃত হবে এবং সে সারা জীবন পিতার জন্যে সাদক্বায়ে জারিয়া হিসেবে পরিগণিত হবে। অথবা স্ত্রী স্বামীর চরিত্র সংশোধনের হিসেবে পরিগণিত হবে অথবা তার সৌভাগ্যের কারণে আল্লাহ তাআলা ঐ পুরুষকে দুনিয়াতে রুজি রোজগার ও স্বচ্ছলতা দান করবেন। যা হোক স্ত্রীর কোন দোষ দেখে অবিবেচকের মত বৈবাহিক সম্পর্ককে ছিন্ন করবে না বরং উত্তম পন্থায় ধীরে ধীরে ঘরের পরিবেশকে সুন্দর করতে চেষ্টা করবে।
৩. বিবেচকের পন্থা অবলম্বন করবে। স্ত্রীর ত্রুটি-বিচ্যুতি, অজ্ঞতা ও অবাধ্যতা সুলভ আচরণসমূহকে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবে। মহিলারা স্বভাবতঃ জ্ঞান-বুদ্ধিতে একটু বেশী দুর্বল ও আবেগ প্রবণ হয়, সুতরাং ধৈর্য্য, সহনশীলতা ও ভালবাসা এবং আন্তরিকতার সাথে তাদেরকে সংশোধন করার চেষ্টা করবে এবং ধৈর্য্য ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জীবন-যাপন করবে।
আল্লাহ তাআলা বলেন-
“মুমিনগণ ! তোমাদের কোন কোন স্ত্রী ও কোন কোন সন্তান তোমাদের শত্রু। সুতরাং তাদের থেকে দূরে থাক, দি তোমরা ক্ষমা, দয়া, মার্জনা ও উপেক্ষা করো তাহলে নিশ্চিত আল্লাহ মহান ক্ষমাপ্রদানকারী ও দয়াবান।
(সূরা তাগাবুন-১৪)
রাসূল (সাঃ) বলেছেন-
“নারীদের সাথে সদাচরণ কর। নারীগণ পাঁজড়ের হাড্ডি দ্বারা সৃষ্ট এবং পাঁজযের হাড় এর উপরের অংশ সব চাইতে বেশী বাঁকা, তাকে সোজা করার চেষ্টা করলে ভেঙ্গে যাবে, যদি ঐভাবেই ছেড়ে দাও তা হলে বাঁকাই থেকে যাবে, সুতরাং নারীদের সাথে সদ্ব্যবহার কর”।
(বুখারী, মুসলিম)
৪. স্ত্রীদের সাথে উত্তম ব্যবহার করবে এবং প্রেম ও ভালবাসাসুলভ আচরণ করবে। রাসূল (সাঃ) বলেছেন-
যে উত্তম চরিত্রের অধিকারী সে পূর্ণ মুমিন আর তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি সর্বাধিক উত্তম যে তার স্ত্রীর নিকট সর্বাধিক উত্তম”।
(তিরমিযি)
উত্তম চরিত্র ও নম্র স্বভাবের পরীক্ষা ক্ষেত্র হলো পারিবারিক জীবন। পরিবারের লোকদের সাথে সব সময় সুসম্পর্ক থাকে। আর ঘরের অকৃত্রিম জীবনেই স্বভাব ও চরিত্রের প্রতিটি দিক ফুটি উঠে। আর এটাই মূল কথা যে, ঐ ব্যক্তিই পরিপূর্ণ মুমিন যে পরিবারের লোকদের সাথে উত্তম ব্যবহার, হাসি খুশী ও দয়া সুলভ ব্যবহার করে। পরিবারের লোকদের অন্তর আকর্ষণ করবে এবং স্নেহ ও ভালবাসা প্রদান করবে।
হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেছেন, আমি রাসূল (সাঃ)-এর ঘরে পুতুল নিয়ে খেলা করতাম, আমার সাথীরাও আমার সাথে খেলা করতো, যখন রাসূল (সাঃ) আসতেন তখন সকলে এদিক ওদিক লুকিয়ে যেতো, তিনি তাদেরকে খোঁজ করে প্রত্যেককে আমার সাথে খেলা করতে পাঠিয়ে দিতেন।
(বুখারী, মুসলিম)
৫. অত্যন্ত প্রাণখোলাভাবে জীবন সঙ্গিনীর আবশ্যকীয় জিনিসপত্র সংগ্রহ করে দেবে এবং খরচের বেলায় খুব বেশী সংকোচ করবে না। সংগ্রহ করে দেবে এবং খরচের বেলায় খুব বেশী সংকোচ করবে না। নিজের পরিশ্রমের রুজি পরিবারের লোকদের জন্য খরচ করে মানসিক শান্তি ও খুশী অনুভব করবে। খাদ্য ও বস্ত্র স্ত্রীর অধিকার আর এ অধিকারকে খুশী ও প্রশস্ততার সাথে আদায় করার জন্যে যথাসম্ভব চেষ্টা ও তদবীর করা স্বামীর কর্তব্য, খোলা অন্তরে এ কর্তব্য সম্পাদনে শুধু এ পার্থিব জগতেই বৈবাহিক জীবনের সুফল লাভ হয় তা নয় বরং মুমিন ব্যক্তি আখিরাতেও পুরস্কার ও নেয়ামতের অধিকারী হবে।
রাসুল (সাঃ) বলেছেন-
এক দীনার যা তুমি আল্লাহর রাস্তায় খরচ করেছো, যা তুমি কোন গোলামকে আযাদ করতে ব্রয় করেছো, যা তুমি ভিক্ষুককে দান করেছো এবং যা তুমি পরিবারের লোকদের জন্যে ব্যয় করেছো, এগুলোর মধ্যে সর্বাধিক পুরস্কার ও সওয়াবের অধিকারী ঐ দীনার যা তুমি নিজ পরিবারের লোকদের জন্যে ব্যয় করেছ।
(মুসলিম)
৬. স্ত্রীকে দীনি বিধি-বিধান সংস্কৃতি বা আচার-আচরণে শিক্ষিত করে তুলবে। দীনি শিক্ষা দান করবে। ইসলামী চরিত্রে চরিত্রবান করে সাজিয়ে তুলবে এবং তার প্রশিক্ষণ ও সংশোধনের জন্যে সম্ভাব্য চেষ্টা চালাবে যেনো সে একজন উত্তম স্ত্রী, উত্তম মাতা এবং আল্লাহর নেক বান্দি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে আর তার ওপর নির্ধারিত কর্তব্যসমূহ সুন্দর ও সঠিকভাবে আদায় করতে পারে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেছেন
“মুমিনগণ! নিজেদেরকে ও নিজেদের পরিবারবর্গকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করো”।
রাসূল (সাঃ) বাইরে যেমন দাওয়াত ও শিক্ষাদানের কাজে ব্যস্ত থাকতেন তেমনি ঘরেও উক্ত কর্তব্যসমূহ সুচারুরূপে সম্পাদন করতেন। এদিকে ইঙ্গিত করেই পবিত্র কুরআন নবী পত্নীগণকে সম্বোধন করেছে।
“তোমাদের ঘরে আল্লাহর যে সকল আয়াত পাঠ করা হয় এবং বিজ্ঞান সম্মত কথাবার্তা আলোচনা করা হয় এগুলো স্মরণ রেখো”।
পবিত্র কুরআনে রাসূল (সাঃ)-এর মাধ্যমে সকল মুমিনকে হেদায়াত করার উদ্দেশ্যে বলা হয়েছেঃ
“আপনার পরিবারবর্গকে সালাতের নির্দেশ দিন এবং আপনি নিজেও তার ওপর কায়েম থাকুন”।
রাসূল (সাঃ) বলেছেন-
“যখন কোন পুরুষ রাতে নিজ স্ত্রীকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দুজনে দু’রাকাত (নফল) নামায আদায় করে তখন স্বামীর নাম যিকিরকারীদের মধ্যে এবং স্ত্রীর নাম যিকিরকারিণীদের মধ্যে লিখে নেয়া হয়”।
(আবু দাউদ)
দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর (রাঃ) রাতে আল্লাহর দরবারে দাঁড়িয়ে ইবাদত করতেন এবং শেষ রাতে জীবন সঙ্গিনীকে ঘুম থেকে জাগাতেন এবং বলতেন, উঠো, নামায পড়ো। অতঃপর কুরআনের আয়াত পাঠ করতেন।
৭. যদি একাধিক স্ত্রী হয় তবে সকলের সাথে সমান ব্যবহার করবে। রাসূল (সাঃ) বিবিদের সাথে সমান আচরণ করতে চেষ্টা করতেন। সফরে যাবার সময় বিবিগণের নামে লটারী দেয়া হতো। লটারীতে যার নাম আসতো তাঁকে সফর সঙ্গিনী করে নিতেন।
হযরত আবু হুরাইরাহ (রাঃ) থেকৈ বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) বলেছেন-
“কোন ব্যক্তির যদি দু’জন স্ত্রী হয় আর সে তাদের মধ্যে ইনছাফ ভিত্তিক সমান ব্যবহার না করে তা হলে সে কিয়ামতের দিন এমতাবস্থায় উত্থিত হবে যে, তার অর্ধেক শরীর অচল”।
(তিরমিযি)
অর্থাৎ কিয়ামতের দিন সে অর্ধেক শরীরে উত্থিত হবে।
ইনসাফ ও সম্মানের আসল মর্ম হলো, লেন-দেন ও আচরণে সমতা রক্ষা করা। কোন এক স্ত্রীর প্রতি অন্তরের টান ও প্রেমের জন্যে আল্লাহর নিকট কোন জবাবদিহি করতে হবে না।
স্ত্রী সম্পর্কিত আদব ও কর্তব্যসমূহ
১. অত্যন্ত স্বাচ্ছন্দে নিজ স্বামীর আনুগত্য করবে এবং এ আনুগত্যে শান্তি ও স্বাচ্ছন্দ অনুভব করবে, কেননা এটা আল্লাহর নির্দেশ। যে মহিলা আল্লাহর নির্দেশ পালন করবে সে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করে। পবিত্র কুরআনে বলা আছে, “ফাসসালিহাতু কানিতাতু” নেককার মহিলাগণ (তাদের স্বামীদের) আনুগত্যকারিণী হয়।
রাসূল (সাঃ) বলেছেন-
“কোন মহিলা স্বামীর অনুমতি ব্যতীত (নফল) রোযা রাখবে না।
(আবু দাউদ)
স্বামীর আনুগত্য ও শ্রদ্ধার গুরুত্ব প্রকাশ করে রাসূল (সাঃ) নারীদেরকে সতর্ক করেছেন এভাবে-
দু’প্রকারের লোক আছে যাদের নামায তাদের মাথা থেকে উপরে উঠে না-(১) সেই গোলামের নামায, যে গোলাম নিজের মনিব থেকে পলায়ন করে চলে যায় অর্থাৎ পলাতক গোলাম, এবং যে পর্যন্ত (সে মনিবের নিকট) ফিরে না আসে। (২) সেই মহিলার নামায যে স্বামীর নাফরমানী থেকে বিরত না হয়।
(অততারগীব ওয়াত তারহীব)
২. নিজের ইজ্জত ও সতীত্ব রক্ষার পূর্ণ চেষ্টা করবে এবং এমন কথাবার্তা ও কাজ থেকে বিরত থাকবে যার দ্বারা সতীত্বের ওপর কালিমা লেপনের সন্দেহও না হয়, আল্লাহর হেদায়াতের উদ্দেশ্যও তাই এবং বৈবাহিক জীবনকে সুন্দরভাবে গঠন করে নেয়ার জন্যেও ইহা অত্যন্ত জরুরী। স্বামীর অন্তরে যদি এ ধরনের কোন সন্দেহ সৃষ্টি হয় তা হলে স্ত্রীর কোন খেদমত, আনুগত্য এবং কোন নেক কাজ তাকে (স্বামীকে) নিজের দিকে আকৃষ্ট করতে পারবে না। এ ব্যাপারে সামান্য দুর্বলতার দ্বারাও স্বামীর অন্তরে সন্দেহ সৃষ্টি করতে শয়তান কামিয়াব হয়ে যায়। সুতরাং মানবিক দুর্বলতার প্রতি দৃষ্টি রেখে খুব সাবধানতা অবলম্বন করবে।
রাসূল (সাঃ) বলেছেন-
“স্ত্রীগণ যখন পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ে, নিজের ইজ্জত রক্ষা করে এবং নিজ স্বামীর আনুগত্য করে তা হলে সে বেহেশতের যে দরজা দিয়ে ইচ্ছা প্রবেশ করতে পারবে।
(আততারগীব ওয়াততারহীব)
৩. স্বামীর অনুমতি ও সন্তুষ্টি ব্যতীত ঘরের বাহির হবে না, স্বামী যে সকল বাড়ীতে যেতে অপছন্দ করে সে সকল বাড়ীতে যাবে না এবং স্বামী যে সকল লোকদের ঘরে আসা পছন্দ করে না তাদেরকে ঘরে আসতে অনুমতি দেবে না।
হযরত মুয়ায বিন জাবাল (রাঃ ) বলেছেন যে, রাসূল (সাঃ) বলেন-
“আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী কোন মহিলার পক্ষে এমনটি জায়েয নয় যে, সে এমন লোককে স্বামীর ঘরে আসতে অনুমতি দেবে যার আসা স্বামী পছন্দ করে না। স্বামীর অনুমতি নিয়ে স্বামীর ঘর থেকে বের হবে আর স্ত্রী স্বামীর ব্যাপারে অন্য কারো কথা মানবে না।
(তারগীব ও তারহীব)
অর্থাৎ স্বামীর ব্যাপারে স্বামীর ইচ্ছা ও চোখের ইশারা অনুযায়ীই কাজ স্ত্রী করবে, এর বিপরীত অন্যের যক্তি পরামর্শ কখনো গ্রহণ করবে না।
৪. সর্বদা নিজের কথা ও কাজ, চাল-চলন ও রীতি-নীতির দ্বারা স্বামীকে সন্তুষ্ট রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করবে। সফল বৈবাহিক জীবনের কর্তব্যও এটা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি ও জান্নাতে প্রবেশের পথও এটা।
রাসূল (সাঃ) বলেছেন-
“যে মহিলা স্বামীকে খুশী রেখে মৃত্যুবরণ করলো সে অবশ্যই বেহেশতে প্রবেশ করবে”।
রাসুল (সাঃ) আরো বলেছেন-
যখন কোন ব্যক্তি নিজের স্ত্রীকে মানবিক প্রয়োজনে কাছে ডাকে আর সে তার ডাকে সাড়া না দেয় এবং এ কারণে স্বামী সারা রাত তার ওপর অসন্তুষ্ট থাকে এমতাবস্থা ফিরিশতা ভোর পর্যন্ত তার ওপর অভিশাপ করতে থাকে”।
(বুখারী, মুসলিম)
৫. নিজের স্বামীকে ভালবাসবে এবং তার ভালবাসার মর্যাদা দেবে। এটা জীবনের সৌন্দর্য্যের উপকরণ এবং জীবন পথের মহান সহায়। আল্লাহ তাআলার এ নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করবে এবং এ নেয়ামতেরও মর্যাদা দেবে।
রাসূল (সাঃ) একস্থানে বলেছেন-
“দু’জন নারী পুরুষের ভালবাসা স্থাপনকারীর জন্যে বিবাহ থেকে উত্তম আর কোন বস্তু পাওয়া যায়নি”।
হযরত ছুফিয়া (রাঃ) রাসূল (সাঃ)-কে অকেন ভালবাসতেন। রাসূল (সাঃ) যখন অসুস্থ হয়ে পড়লেন তখন অত্যন্ত দুঃখের সাথে বললেন, “তাঁর স্থলে যদি আমি অসুস্থ হতাম!” রাসূল (সাঃ)-এর অন্যান্য বিবিগণ এরূপ ভালবাসা প্রকাশের কারণে আশ্চর্যান্বিত হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন, তখন রাসূল (সাঃ) বললেন, “লোক দেখানো নয়, বরং সত্যই বলছে”।
৬. স্বামীর উপকার স্বীকার করবে তার শুকরিয়া আদায় করবে। তোমার স্বামীই তো তোমার সর্বাধিক উপকারী যিনি তোমাকে সন্তুষ্ট করার জন্যে সর্বতোভাবে ব্যস্ত থাকেন, তোমার প্রত্যেকটি প্রয়োজন পূরণ করে দেন এবং তোমাকে সকল প্রকার সুখ প্রদান করেন।
হযরত আসমা (রাঃ) বলেছেন যে, একবার আমি আমার প্রতিবেশী বান্ধবীর সাথে অবস্থান করছিলাম। এমতাবস্থায় রাসূল (সাঃ) আমাদের নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি আমাদেরকে সালাম দিয়ে বললেন, “তোমরা যাদের দ্বারা উপকৃত হয়েছো তাদের নাফরমানী থেকে দূরে থাক, যদি তোমাদের কোন একজন দীর্ঘদীন যাবত মাতা-পিতার নিকট অবিবাহিতা অবস্থায় বসে থাক, অতঃপর আল্লাহ তাআলা (দয়া করে) তাকে স্বামী দান করেন, তারপর আল্লাহ তাকে সন্তান দান করেন, (এতসব উপকার সত্বেও) যদি কোন কারণে স্বামীর ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে পড় তখন বলে ফেল, “আমি কখনো তোমার পক্ষ থেকে অসন্তুষ্ট ছাড়া কোন সৌজন্যমূলক আচরণ দেখিনি”।
(আল আদাবুল মুফরাদ)
অকৃতজ্ঞ ও উপকার ভুলে যাওয়অ মহিলাদেরকে সতর্ক করে রাসূল (সাঃ) বলেছেন-
“আল্লাহ তাআলা কাল কিয়ামতের দিন স্বামীর প্রতি অকৃতজ্ঞ স্ত্রীর দিকে রহমতের দৃষ্টিতে দেখবেন না। প্রকৃতপক্ষে মহিলাগণ কোন সময়ও স্বামীর থেকে মুক্তি পাবে না”।
(নাসায়ী)
৭. স্বামীর খেদমত করে আনন্দ অনুভব করবে আর যথাসম্ভব নিজে কষ্ট সহ্য করে স্বামীকে শান্তি দান করার চেষ্টা করবে এবং সর্বতোভাবে তার খেদমত করে তার অন্তর নিজের আয়ত্বে রাখার চেষ্টা করবে।
উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রাঃ) নিজ হাতে রাসূল (সাঃ)-এর কাপড় ধুতেন, মাথায় তৈল লাগাতেন, চিরুণী দিয়ে মাথা আঁচড়াতেন, সুগন্ধী লাগাতেন এবং অন্য মহিলা সাহাবীগণও এরূপ করতেন।
একবার রাসূল (সাঃ) বলেছেন-
“কোন এক ব্যক্তির অন্য কোন ব্যক্তিকে সেজদা করা জায়েয নেই, যদি থাকত তা হলে স্ত্রীকে তার স্বামীকে সেজদা করার আদেশ দেয়া হতো। নিজের স্ত্রীর ওপর স্বামীর বিরাট অধিকার, যদি স্বামীর সারা শরীর ক্ষত-বিক্ষত হয় আর স্ত্রী যদি স্বামীর ক্ষত-বিক্ষত শরীর জিহ্বা দ্বারা চাটে তবুও স্বামীর অধিকার শেষ হতে পারে না।
(মুসনাদে আহমদ)
৮. স্বামীর ঘর-সংসার ধন-সম্পদ ও আসবাবপত্রের রক্ষণাবেক্ষণ করবে স্বামীর ঘরকেই নিজের ঘর মনে করবে এবং স্বামীর ধন-সম্পদকে, স্বামীর ঘরের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধিকরণ, স্বামীর সম্মান সৃষ্টি ও তার সন্তান-সন্ততির ভবিষ্যৎ গড়ার কাজে মিতব্যয়িতা অনুসরণ করবে, স্বামীর উন্নতি ও স্বচ্ছলতাকে নিজের উন্নতি ও স্বচ্ছলতা মনে করবে। কোরাইশী মহিলাদের প্রশংসা করতে গিয়ে রাসূল (সাঃ) বলেছেন-
“কোরাইশী মহিলাগণ কতইনা উত্তম মহিলা। তারা সন্তান-সন্ততির ওপর অত্যন্ত দয়ালূ এবং স্বামীর ঘর সংসারের রক্ষণাবেক্ষণকারিণী”।
(বুখারী)
রাসূল (সাঃ) নেককার স্ত্রীর গুণসমূহ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন-
“মুমিনের জন্য সর্বাধিক উপকারী এবং উত্তম নেয়ামত হলো তার নেককার স্ত্রী, সে যদি তাকে কোন কাজের নির্দেশ দেয় তাহলে সে তা আন্তরিকতার সাথে সুসম্পন্ন করে আর যদি তার প্রতি দৃষ্টি দেয় তা হলে সে তাকে সন্তুষ্ট করে এবং সে যদি তার ভরসায় শপথ করে বসে তা হলে সে তার শপথ পূরণ করে দেয়, যখন সে কোথাও চলে যায় বা তার অনুপস্থিতিতে সে নিজের ইজ্জত ও সম্মান রক্ষা করে এবং স্বামীর ধন-সম্পদ ও আসবাবপত্রের রক্ষণাবেক্ষণে স্বামীর হিতৈষী ও বিশ্বাসী থাকে।
(ইবনু মাজাহ)
৯. পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, আচার-আচরণ রীতি, সাজ-সজ্জা এবং শোভা সৌন্দর্য্যকরারও পরিপূর্ণ চেষ্টা করবে। ঘরকেও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখবে, প্রত্যেক জিনিসকে সুন্দরভাবে সাজাবে এবং উত্তম ব্যবহার করবে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ঘর, নিয়ম-পদ্ধতি অনুযায়ী সাজান, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কক্ষসমূহ, ঘরের কাম-কাজে নিয়ম-পদ্ধতি ও সৌন্দর্য্য বিধান, সুসজ্জিত বিবির পবিত্র মুচকি হাসি দ্বারা শুধুমাত্র সংসার জীবনই প্রেম-ভালবাসা এবং নিরাপত্তা ও প্রাচুর্যে পরিপূর্ণ হয় না এবং একজন নেক স্ত্রীর জন্যে পরকালের প্রস্তুতি ও আল্লাহকে সন্তুষ্ট করারও অছিলা হয়।
একবার ওসমান বিন মাজউন (রাঃ)-এর স্ত্রীর সাথে হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ)-এর সাক্ষাৎ হলে তিনি দেখতে পেলেন যে, বেগম ওসমান অত্যন্ত সাদাসিধা পোশাক পরিচ্ছদ ও সাজ-সজ্জা বিহীন অবস্থায় আছেন। তখন হযরত আয়েশা (রাঃ) তাকে আশ্চার্যান্বিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেনঃ
“বিবি! ওসমান কি বাইরে কোথাও গিয়েছেন?” এ আশ্চার্যান্বিত হওয়া থেকে অনুমান করা যায় যে, আদরীনী স্ত্রীদের নিজ নিজ স্বামীর জন্যে সাজসজ্জা করা কত পছন্দনীয় কাজ।
একবার এক মহিলা সাহাবী রাসূল (সাঃ)-এর দরবারে স্বর্ণের কঙ্কন বা বালা পরিহিত অবস্থায় উপস্থিত হলেন, তিনি “তাকে (অহংকারের উদ্রেককারী) ইতা পরিধান করতে নিষেধ করলে সে বললোঃ
“ইয়া রাসূলাল্লাহ!মহিলা যদি স্বামীর জন্যে সাজ-সজ্জা না করে তা হলে সে স্বামীর দৃষ্টি থেকে বিচ্যুত হবে”।
(নাসায়ী)
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা মে, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:০৩