বাপ মায় শখ করে নাম রাখছিলো হাবিবুর রহমান। আল্লার হাবিবের মত ছেলে রূপেগুণে একদিন বংশের মুখ রোশনাই করবে। কিন্তু পদ্মলোচন নাম রাখলেই যেমন কানা ছেলের চোখে দৃষ্টি ফিরে আসে না, হাবিবুর রহমান হাবিবও আল্লার হাবিবের কোনো গুণই পাইলো না; বরং স্কুলে পরীক্ষার পর পরীক্ষায় ডাব্বা মারতে থাকলো। ৩ এর সাথে ২ যোগ করলে যখন গর্বের সাথে বুক ফুলিয়ে বললো, ত্রিশ হয়, সারা ক্লাসে হাসির রোল পড়ে গেলো। সেই থেকে হাবিবুর রহমান হাবিব সুন্দর নামটা হাবুতে রূপান্তরিত হয়ে গেলো। এমনকি বাপমায়ও তারে এখন হাবু নামেই ডাকে।
দুনিয়া বড়োই রহস্যময়। কার যে কখন কোন দিক দিয়া বোধিপ্রাপ্তি ঘটে, এইটা সবসময় গেস করা যায় না। হাবু টিকতে না পারে স্কুল পালাইলো বটে; কিন্তু বাপে তারে একবারে বসাইয়াও মাগনা ভাত খাইয়াতে রাজি হলো না। মুদি দোকান ছিলো, হাবুকে বসাইয়া দিলো। এই মুদি দোকানে বসার পর থেকেই হাবুর যোগবিয়োগগুণভাগের জ্ঞান তরতর করে বেড়ে উঠলো। হাবু এখন ঠিকই বোঝে কয় কেজি হলুদে কত গ্রাম ইটের গুড়া মিশাইতে হবে। সেই ইটের গুড়া মিশাতে মিশাতেই হাবু বড় ব্যবসাদার হইলো, সরাকারী চাল-গমের ডিলারশীপ পাইয়া তরতর কইরা উন্নতির পরে উন্নতি করিতে থাকিলো। হাবু এখন বিরাট ব্যবসায়ী। এলাকার এমপির সাথে ওঠাবসা, নির্বাচনে জিততে যাচ্ছে এমন পার্টিকে বিরাট ডোনেশন দেয়। হাবু হাওয়া বুঝে।
ব্যবসায়িক কাজে হাবু ইতিমধ্যে এশিয়া, মিডলইস্ট, ইউরোপ, আমেরিকা তন্ন-তন্ন করে ফেলেছে। সে এ ও জেনেছে, দুবাইয়ের মার্কেটে বলিউডি নায়িকাদের কদর কেমন আর ইউরোপের লোকজন ছুটি কাটাতে কেন থাইল্যান্ড যায়। হাবু সিদ্ধান্ত নিলো, সে এবার বউকে কোনো একটা ভুংভাং দিয়ে থাইল্যান্ডেই যাবে। হাবু থাইল্যান্ডে গেলো। গার্লফ্রেন্ড জুটলো, টাকার অঙ্কে হাবু বিরাট হ্যান্ডসাম। থাই মাইয়ার ইংরেজি খারাপ না, তবে হাবু নামটাকে সে কিছুতেই আয়ত্ব করতে পারে না। বার বার কয়, হাবুয়া। হাবু অবশেষে হাল ছেড়ে দিয়ে ভাবলো, যা তাইলে হাবুয়াই সই।
থাইল্যানন্ড থেকে ফিরতি প্লেনে তার হঠাৎ মনে হলো, আরে,হাবুয়া নামটা খারাপ তো না, কেমন কাব্যিক ভাব আছে। হাবু; বা হাবিব দুইটা নামটা আনস্মার্ট, সেকেলে, গেঁয়ো। হাবুয়ায় বরং কেমন একটা উত্তরাধুনিক ফ্লেভার আছে। তার ডিসিশান ফাইনাল হইলো, এখন থেকে সে আর হাবু নয়, হাবুয়াই হবে।
হড়ড় গল্পের কাহিনী বলতে গিয়ে এত ভূমিকা শুনলে পাঠকের মন বিলা হবে; কিন্তু কিছু করার নাই। হাবুয়ার ইতিহাস না জানলে পাঠক হড়ড় গল্পের ভিতরেই ঢুকতে পারবে না, ভয় পাবে কেমনে?
এবার আসল গল্প। দুবাইয়ের। আরবী মাইয়ারা মাশাল্লা, দুধে আলতা গায়ের রঙ, ফ্যাকাসে ফর্সা না, টাইটটুইট আছে। তবে হাবুয়ার পড়ন্ত বয়স। ওইসব জিনিসে আগ্রহ কমে গেলেও যে কারণে দুবাই তার ফেবারিট তা হলো এখানের বেলি ড্যান্স। বেলি ড্যান্সে দুবাইয়ের মেয়েদের কেউ টেক্কা দিতে পারবে, এমন কথা কিরা কাইটা বললেও কেউ হাবুয়াকে বিশ্বাস করাতে পারবে না।
হাবুয়া এজেন্ট মারফত সবব্যবস্থা পাকাপাকি করেই এসেছে। বেলি ড্যান্সের আসরে সে বেশি ভিড় পছন্দ করে না। তার সাথে কিছু ভিআইপি ব্যবসায়িক পার্টনার থাকবে। আর কেউ না। হাবুয়া যথাসময়ে বেলি ড্যান্স দেখতে গেলো। তার পার্টনার না অপেক্ষাকৃত অল্পবয়স্ক, রক্ত বেশি গরম, তারা হাবুয়ার আগেই এসে বসে আছে।
হাবুয়া খুব সামাজিক লোক। মিশুক। প্রথমেই দেখলো, বিড়াল চেহারার মিস্টার রাঙা মিউকে। রাঙা মিউর নাম হাবুয়া অনেকবার শুনেছে; কিন্তু সামনা-সামনি দেখা এবারই প্রথম। লোকটা কুচকুচে কালো। তার নাম রাঙা মিউ কিভাবে হলো হাবুয়া ভেবে পায় না। সে আগ্রহ পেটে রাখার মত লোক নয়, স্মার্ট সামাজিক মানুষ। জিজ্ঞেস করে ফেললো, আপনি এত কুচকুচে কালো হওয়ার পরেও রাঙা মিউ নাম কেন? রাঙা মিউ হা হা করে অট্টহাসি হাসে। বলে, আপনি মিয়া কিছুই বুঝেন না। অনেকের অনেকরকম শখ থাকে, আমার শখ হলো লোকজন ডেকে ডেকেুন্দানি খাওয়া। অভ্যাসটা খারাপ মানি; তবে শখের হাতি ৫ লাখ টেকা। আমি কালো হইলে কি হইবো, শখ মিটাইতে গিয়া পশ্চাৎদেশ সবসময় রাঙাই হইয়া থাকে। হাবুয়া মাথা নাড়ে। আর কইতে হইবো না, সে বুঝতে পেরেছে।
রাঙা মিউর সাথে কথা শেষ হতে না হতেই ছাগল চেহারার এক লোক তিড়িং বিড়িং করতে করতে হাজির। হাবুয়ার সাথে হ্যান্ডশেক করে বলে, তার নাম ছাগাইডল। হাবুয়া অবাক হয়। সে ছাগুচীফকে চিনে। ছাগুচীফ একমেবাদ্বিতীয়ম বলেই জানে সে। এই বেটা ছাগুকুলের আইডল পরিচয় দিয়া নিশ্চয়ই ভাড়ানি দিচ্ছে। হাবুয়া সন্দেহের চোখে তাকায়।
ছাগাইডল বলে, আপনি মনে হয় বিশ্বাস করলেন না? হাবুয়া মাথা নাড়ে। ছাগাইডল হো হো করে হাসে। আপনি মিয়া কিছুই বুঝেন না। ছাগুচীফ একজন থাকলে ছাগাইডল থাকতে পারবে না কেন? স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরশ্রেষ্ঠ যেমন আছে, বীর উত্তম - বীরবিক্রম কি আর নেই? ছাগুচীফ মনে করেন আমাদের বীরশ্রেষ্ঠ, আমি বীরবিক্রম নাম্বার ওয়ান। হাবুয়া মাথা নাড়ে। সে বুঝেছে। কিন্তু একটা খটকা যায় না। ছাগুকূল স্বাধীনতা যুদ্ধের এনালজি ব্যবহার করে কেন? ছাগাইডল তার কনফিউশন দূর করে। সে আছে জামাতি মুক্তিযোদ্ধা উইংয়ে। তাদের কাজ হলো, মুক্তিযুদ্ধ নিয়া গলাবাজি করে চামেচিকনে চানপুরের চানমিয়ার ইতিহাস ঢুকানো, আমান আলীর মত প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের পশ্চাতদেশে লাথি মারা। এই উইং যথেষ্ট শক্তিশালী বলে ছাগাইডল হাবুয়াকে জানায়। তবে কিছু উইক লিংক আছে। তাদের সবকিছুই ঠিক; কিন্তু মেয়ে দেখলে মাথা আউলায়। সোনা মেয়ে, যাদুমেয়ে করে, গভীর ভাবনায় ডুবে যায়, নাঙাবনে গিয়া জামাতি মাইয়ার সাথে মুড়ি খাওয়ার গপ করার সময় ভুলেই যায় যে তারা আসলে মুক্তিযুদ্ধ উইংয়ের রিক্রুট।
হাবুয়া জিজ্ঞেস করে, আপনাদের তো জানি ট্রেনিং অনেক ভালো, পুরা চুনকাম করার পরেই ফিলডে ছাড়ে। তাইলে এমন কাঁচা কেহলার কারণ কি? ছাগাইডল একটু গম্ভীর হয়। ভেবে বলে, আপনাকে আপন মনে করে বলি, গোপন কথা কাউকে বলে দিবেন না। এই বিষয়ে আমাদের কিছু অসন্তোষ আছে। মজলিশে শুরার নেতারা আমাদেরকে ওয়াশ করার সময় কিছুক্ষণ পরপর হুরপরীর কথা বলে। এমনকি সাপ্তাহিক বয়ানেও হুরপরীর রসালো বর্ণনা। এটা বিরাট মোটিভেশন হিসেবে কাজ করে। কিন্তু মোটিভেশনের সাথে সাথে শরীরও যে গরম হয়। মজলিশে শুরার ওনাদের জন্য মেয়েমানুষ বরাদ্দ আছে, এরা দাসী হিসেবে নিয়োগ পায়, ইসলামে দাসী ভোগ করা জায়েজ। কিন্তু আমাদের জন্য দাসী রাখার নিয়ম নেই, দাসী রাখতে হলে রোকন মর্যাদায় থাকতে হয় অন্তত ২ বছর। সুতরাং আমাদেরকে অন্য পথ দেখতে হয়। নাঙাবনে হোক আর নুডুস খাওয়ার সময় চ্যাট করে হোক, আমাদেরকে তাপ নামাতে হয়। মেয়ের চেহারাও এক্ষেত্রে ব্যাপার না, এমনকি রেশাস বানরের মত লোমশ হলেও সমস্যা নেই।
হাবুয়া বুঝদার মানুষ। মাথা নাড়ে। অন্য পাশে একটা ভেড়াকৃতি লোক নীরবে গ্লাসে চুমুক দিয়ে যাচ্ছে আর মাঝে মাঝে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে এদিকে তাকিয়ে আলোচনার সার বোঝার চেষ্টা করছে। হাবুয়া সামজিক মানুষ। তিনি নিজে গিয়েই লোকটার টেবিলে গিয়ে বসলেন, হাত বাড়িয়ে দিয়ে পরিচিত হলেন। মাই নেইম ইজ ভেড়াটর। লোকটা গম্ভীর ভাবে ভাব নিয়ে পরিচিত হলো। চোখে চশমা আছে।বুদ্ধিজীবী বুদ্ধিজীবী ভাব। হাবুয়া তার সাথে আর কথা বাড়ানোর আগেই বেলি ড্যান্সার মঞ্চে হাজির। আহ! কী রূপ। সারা গায় বাইয়া বাইয়া রূপের জোয়ার হাবুয়ার চোখ দিয়ে ঢুকে তলপেটে পৌঁছে যায়। হাবুয়া সম্মোহিতের মত বেলি ড্যান্স দেখে।
হাবুয়া অনেক বেলি ড্যান্স দেখেছে; কিন্তু আজকের মত এমন অনুভূতি আর কখনো হয় নি। সে কেয়ারফুল ব্যবসায়ী মানুষ। কেমন ছমছম লাগে। ড্যান্সার মেয়েটি ইতিমধ্যে সবাইকে রেখে হাবুয়ার সাথে কেমন বেশি বেশি ভাব জমানোর চেষ্টায় আছে। হঠাৎ হাবুয়ার কানে কানে বলে, আমাকে খাবা? কেমন মোহনীয় হাসি দেয়। হাবুয়া সতর্ক হয়। এবার দুবাইয়ে ভূতপ্রেতের উপদ্রব খুব বেড়েছে এ ইনফর্মেশন তার আগেই জানা। লক্ষ্য করে দেখে, ড্যান্সার মেয়েটির দুইপাশে দুই গজদন্ত। হাবুয়া নিশ্চিত হয়। এই ছাগাইডল, রাঙা মিউ, ভেড়াটর সব শালাই ভূত। তাকে বেলিড্যান্সের লোভ দেখিয়ে কাঁচা খেয়ে ফেলার ষড়যন্ত্র করেছে। ভয়ের একটা শীতল স্রোত হাবুয়া শিরদাঁড়া দিয়ে একেবারে পায়ের পাতা পর্যন্ত বয়ে যায়।
কিন্তু এখন ভয়ের সময় নয়। হাবুয়া ব্যবসায়ী মানুষ। তার মাথা উত্তর গোলার্ধের বরফের মত ঠান্ডা। সে চিন্তা করতে থাকে। এদিকে হাসিমুখে ড্যান্সার মেয়টিকে বলে, হ্যাঁ, আমি তোমাকে খাবো। তবে একটু অপেক্ষা করতে হবে। বাথরুম পেয়েছে। আমিও একটু ক্লীন হয়ে আসি।মেয়েটি মোহনীয় হাসি দিয়ে বলে, আচ্ছা।
হাবুয়া ধীর পায়ে বেরোয়। তাড়াহুড়া দেখালেই সন্দেহ করবে। জুতা পরে। তার পা কাঁপে না, পাথরের মত স্থির সে। কিন্তু বাইরে বেরিয়েই দে ছুট। ছোটবেলা দুষ্টু পোলাপান তাকে হাবু হাবু বলেঢিল মেরে খুব বিরক্ত করতো। সেই ট্রেনিং আজ কাজে লেগে গেলো।
হাবুয়া দৌঁড়ায়। দৌঁড়ায়। রাস্তায় কোনো ট্যাক্সিও নেই। চারিদিকে ছিমছাম। লোকজন এত রাতে বাইরে থাকে না। এবছর দুবাই খুব ভূতের উপদ্রব বেড়েছে। তবে রাস্তায় বিপরীত দিকে ক্লান্ত পায়ে হেঁটে যাওয়া একটি পাগোল শুধু থেকে থেকে চিৎকার করে ওঠে, "আমি রাজা, আমি রাজা" ।
(গল্পটি হড়ড় গ্রুপে প্রকাশিত)