অনেকে বলে, ইলমে তাছাউফ হাছিল করা নাকি ফরয? এখন ফরয বলে দিলেই তো আর ফরয হয় না। ফরয হওয়ার প্রমাণ ও যুক্তি কি?
- ইলমে তাছাউফ হল আত্মশুদ্ধির পথ। যা কিছু পূর্বে বলা হয়েছে, শুধু এগুলোই নয়, আরও অনেক বিষয় তাছাউফের সাথে জড়িত রয়েছে।
আর, ইলমে তাছাউফ চর্চার মাধ্যমে কমপক্ষে সুলতানুল আযকার পর্যন্ত জারী করা ফরযে আইন। এখন, প্রশ্ন হতে পারে, ‘সুলতানুল আযকার’ শব্দ কুরআন শরীফে খুঁজে পেলাম না, সেটা আবার ফরয হল কি করে। জি, সে বিষয়েই আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।
প্রথমেই বলে নেওয়া জরুরী, ইসলামে মনগড়া কথা চলবে না। কথা বললে প্রমাণ থাকতে হবে। প্রমাণ দিলে অস্বীকার করা যাবে না। তবে যুক্তি থাকলে পেশ করতে পারে। কিন্তু অনেক সময়, গ্রহণযোগ্য প্রমাণ দেওয়া হলে, সেই প্রমাণটিকেই অনেকে অস্বীকার করে থাকে মনগড়া সিদ্ধান্তে। মূলত, এরা অবিশ্বাসী, অস্বীকারকারীদের মধ্যেই গণ্য হতে চায়। যাই হোক, আলোচনায় ফিরে আসি। যেসব কারণে তাছাউফ চর্চা করা ফরযঃ
১) ক্বল্বী ইলমঃ
ইলমে তাছাউফ এক প্রকার ইলম যা অর্জন করা ফরয। এ ব্যাপারে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাদীছ শরীফ-এ ইরশাদ করেন, “প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য (জরুরত আন্দাজ) ইলম অর্জন করা ফরয।” (মুসলিম, ইবনে মাজাহ, বায়হাক্বী, মাছাবিহুস সুন্নাহ, মিশকাত, মিরকাত, লুময়াত, তা’লীকুছ্ ছবীহ্, শরহুত্ ত্বীবী, মোযাহেরে হক্ব, আশয়াতুল লুময়াত)
এবং হাদীছ শরীফ-এ বর্ণিত রয়েছে, “ইলম দু’প্রকার- (১) ক্বল্বী ইলম অর্থাৎ ইলমে তাছাউফ। আর এটাই মূলতঃ উপকারী ইলম। (২) যবানী ইলম অর্থাৎ ইলমে ফিক্বাহ্, যা আল্লাহ্ পাক-এর পক্ষ হতে বান্দার জন্য দলীল।” (দারিমী, তারগীব ওয়াত তারহীব, তারীখ, আব্দুল বার, দাইলামী, বায়হাক্বী, মিশকাত, মিরকাত, শরহুত্ ত্বীবী, তা’লীকুছ্ ছবীহ্, আশয়াতুল লুময়াত, লুময়াত, মুযাহিরে হক্ব)
২) ইখলাছঃ
ইবাদত দু’প্রকার। ক) ইবাদতে যাহিরাহ ও খ) ইবাদতে বাতিনাহ। ইলমে ফিক্বাহ হাছিলের মাধ্যমে বান্দা সঠিক ও পরিপূরণভাবে ইবাদতে যাহিরাহ (অর্থাৎ নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত, মুয়ামালাত, মুয়াশিরাত ও আক্বাইদ ইত্যাদি বাহ্যিক ইবাদতসমূহ) পালন করতে পারবে।
আর, ইলমে তাছাউফ হাছিল করার মাধ্যমে বান্দা (ইবাদতে বাতিনাহ অর্থাৎ নিজ অন্তরসমূহকে ইবাদতে যাহিরাহ বিনষ্টকারী কুস্বভাব বা বদ খাছলত থেকে হেফাযত করে) ইখলাছের সাথে ইবাদতে যাহিরাহ পালন করে মহান আল্লাহ পাকের হাক্বীক্বী মা’রিফত ও মুহব্বত হাছিল করতে পারবে।
ইখলাছের বিপরীত বস্তুর নাম হচ্ছে গায়রুল্লাহ। একমাত্র আল্লাহ পাক-এর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য হাছিলের উদ্দেশ্য ব্যতিরেকে অন্য যে কোন উদ্দেশ্যে আমল করার নাম হচ্ছে গায়রুল্লাহ। অসংখ্য হাদীছ শরীফ দ্বারা একথা সুস্পষ্ট যে, একমাত্র ইখলাছ না থাকার কারণে নামাযী, শহীদ, আলিম, ক্বারী, দানশীল সবাই জাহান্নামে চলে যাবে। আবার, কালামুল্লাহ শরীফে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, “ঐ সকল নামাযীদের জন্য হালাক্বী- যারা গাফলতির সহিত নামায আদায় করে এবং ঐ সকল নামাযীদের জন্যও হালাক্বী যারা মানুষকে দেখানোর উদ্দেশ্যে নামায আদায় করে ইখলাছের সহিত আমল করে না”। ( সূরা মাউন- ৪, ৬)
সুতরাং, ইখলাছ হাছিল করা ফরয। আর, ইখলাছ বাহ্যিক ও দৃশ্যমান বিষয়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত নয়। ইখলাছের সম্পর্ক হচ্ছে অন্তরের সাথে। তাই, ক্বলবী ইলম বা তাছাউফ চর্চা করা ফরয।
৩) যিকিরঃ
আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, “যার ক্বলবে আমার যিকির জারি নেই, সে নফসের অনুসরণ করে এবং তার আমলগুলো হয় শরীয়তের খিলাফ”। (সূরা কাহাফ-২৮)। যেহেতু, শরীয়তের খিলাফ আমল থেকে বেঁচে থাকা ফরয, তাই ক্বলবে যিকির জারী করাও ফরয, কেননা ক্বলবে যিকির জারী না থাকলে শরীয়ত বিরোধী কাজ হয়ে যাবে, আল্লাহ পাকের নাফরমানী হয়ে যাবে (নাউযুবিল্লাহ)।
এখন, সেটা কি করে সম্ভব। ইলমে তাছাউফে সেটাই শিক্ষা দেওয়া হয় যে, কি করে ক্বলবসহ শরীরের সকল লতীফায় দায়িমী যিকির জারী করা যায়। ইলমে তাছাউফের একটি স্তর হল- ‘সুলতানুল আযকার’ যার অর্থ হল যিকিরের বাদশাহ। পৃথকভাবে সমস্ত লতীফায় যিকির জারী হওয়ার পর একসাথে সমস্ত লতীফায় যিকির শুরু করবে-যাকে সুলতানুল আযকার বলা হয়। এর স্তর তিনটি। তার মধ্যে প্রাথমিক স্তর পর্যন্ত জারি করা ফরযে আইন। কেননা, শয়তান শরীরের যে সকল লতীফায় ওয়াসওয়াসা দিয়ে থাকে, সে সকল লতীফায় যিকিরের মাধ্যমে যিকির জারী হয়ে গেলে শয়তান আর ওয়াসওয়াসা দিয়ে বিপথগামী করতে পারে না। এ ব্যাপারে সূরা যুখরূফ-৩৬,৩৭ তে বলা হয়েছে। যেহেতু, ইলমে তাছাউফের মাধ্যমেই শুধুমাত্র যিকির জারী করা সম্ভব, তাই ইলমে তাছাউফ চর্চা করা ফরয।
৪) তাযকিয়ায়ে ক্বলবঃ
মহান আল্লাহ পাক উনার কালাম পাকে ইরশাদ করেন, “মু’মিনদের প্রতি আল্লাহ পাক উনার ইহসান যে, তাদের মধ্য থেকে তাদের জন্য একজন রসূল প্রেরণ করেছেন, তিনি আল্লাহ পাক এর আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করে শুনাবেন, তাদেরকে তাযকিয়া (পরিশুদ্ধ) করবেন এবং কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দিবেন। যদিও তারা পূর্বে হিদায়েত প্রাপ্ত ছিল না।” (সূরা আল-ইমরান-১৬৪)। অনুরূপ সূরা বাক্বারা-১৫১, সূরা জুমুয়া-২।
মুফাসসিরীনে কিরামগণ وَيُزَكِّيهِمْ – এর ব্যাখ্যায় প্রসিদ্ধ তাফসীরের কিতাব যেমন- তাফসীরে জালালাইন, কামালাইন, কুরতুবী, তাবারী, খাযিন, বাগবী, ইবনে কাছীর, দুররে মানছূর, আবী সউদ, মাযহারী, রুহুল বয়ান, রুহুল মায়ানী, মায়ারিফুল কুরআনসহ আরো অনেক তাফসীর গ্রন্থে “তাযকিয়ায়ে ক্বলব” বা অন্তর পরিশুদ্ধ করাকে ফরয বলেছেন এবং তজ্জন্য ইলমে তাছাউফ অর্জন করাকে ফরয বলেছেন।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১২ দুপুর ১:১৯