ওর নাম সাব্বির। ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়েছে যত দূর আমি জানি। ফ্যামিলিতে বাবা মা আর বড় বোন আছে।
সাব্বিরের বাবা কাজ করে না খুব বেশি। এলাকাই একটা গাজ্জার আখড়া আছে ওখানেই পড়ে থাকে রাত দিন। মাঝে মধ্য কাজ করলে করে না করলে না।
সংসার খুব টানাটানি ভাবেই চলে। বাসা হাস মুরগি গরু পালন করে কন মতে সাব্বিরের মা সংসার চালায়।
সাব্বির একটা দোকানে কাজ করে। মাসে ১০০০/- টাকা সেলারি। বড় বোন এবার ক্লাস নাইনে উঠেছে। বড় বোনের পড়ালেখার খরচ বলতে গেলে সাব্বিরই চালায়।
বনের যখন যা লাগে সেটা সাব্বির সাধ্য মত চেষ্টা করে। পারলে মাস শেষে কিছু টাকা মা কে দিয়ে সাহায্য করে।
আমি অনেক ছোট এরকম সাব্বিরের মত ছেলে দেখেছি, কিন্তু এই সাব্বির আসলেই অতি চঞ্চল। সারাক্ষন সবার সাথে ফাজলামি নিয়ে থাকে।
ওকে জিগেস করলাম সাব্বির তুই পড়া বাদ দিলা কেন?
সাব্বিরঃ টাকা নাই। আব্বা তো কাজ করে না।
আমিঃ আচ্ছা তোরে স্কুলে ভর্তি করে দিলে পড়বি? যা টাকা বা খরচ হয় আমি দিব।
সাব্বির ঃ হ্যাঁ পড়বো।
আমিও পিপারেশন নিয়েছিলাম ওকে এই সপ্তাহে ভর্তি করে দিব। কিন্তু সাব্বির আর রাজি হয় নি।
জিগেস করেছিলাম সাব্বির কেনো পড়বি না?
সাব্বিরঃ ভাইয়া মা মানা করছে। কাজ করবে কে আমি পড়লে?
আমি ঃ আচ্ছা তুই কাজ কর। পাশাপাশি পড়তে থাক। স্কুল টাইম তোকে ছুটি নিয়ে দিবো কাজ থেকে।
সাব্বিরঃ আচ্ছা দেখা যাবে।
গত কিছু দিন আগে একবার দেখলাম সাব্বির থুথু ফেলছে, খেয়াল করলাম রক্ত। ওকে বললাম কিরে কি হয়েছে?
সাব্বির বললো ভাইয়া দাঁত পড়ে গেছে। জিগেস করলাম কইয়টা দাঁত পড়ছে?
সাব্বিরঃ ভাইয়া ৪ টা পড়ছে
আসলে সাব্বিরের বয়সটা গেস করলাম ১১-১২ মেবি।
মজার কাহিনিতে আসি। একবার সাব্বির কে দেখলাম আটার বস্তা মাথায়।
বস্তার ওজন ৩৭ কেজি। আমার কাছে এসে বলে ভাইয়া একটা ছবি তুলেন আমার।
বললাম ঘাড়ে লাগবে যা ভাগ । ফাজলামি করিস না।
নাছোড় বান্দদা বলে ভাইয়া তুলে দেন ।
পরে ছবি তুলে দিলাম। বললাম ছবি কি করবি?
সাব্বির ঃ মা কে দেখাবো। মা বিশ্বাস করে না যে আমি বস্তা মাথায় নিতে পারি।
অন্য আর একদিন সাব্বির কে দেখলাম ৫০ কেজির চিনির বাস্তা নিয়ে যেতে । গাড়ি থেকে চিনি নামিয়ে গোডাউনে ঢুকাচ্ছিলো।
এই দিন খেয়াল করলাম সাব্বির ১৩ বস্তা চিনি নামিয়েছে বাকি লেবার দের সাথে।
সাব্বির কে বললাম সাব্বির তোর কষ্ট হয় না?
সাব্বিরঃ মাথায় বস্তা তুলতে কষ্ট হয় কিন্তু মাথায় নিয়ে যেতে কিছুই হয় না। ( মাথায় ধরে তুলতে কষ্ট হয়, কিন্তু মাথায় করে নিয়ে যেতে কষ্ট লাগে না।
ভাইয়া আমার হাতে শক্তি নেই কিন্তু মাথায় অনেক শক্তি। কথাটা শুনে অনেক হাসলাম নিজে নিজে।
সাব্বির তোর বড় হয়ে কি হওয়ার ইচ্ছে?
সাব্বিরঃ ভাইয়া বড় হয়ে আমি আপনার সাথে থাকবো।
অবাক চোখে বললাম কেনো? আমার সাথে কি?
সাব্বিরঃ আপনি যেখানে যেখানে যাবেন আমাকেও নিয়ে যাবেন তাই।
আচ্ছা সাব্বির তোর বাবা কি করে সারা দিন?
সাব্বিরঃ সারাদিন ফকির বাগানে বসে গেজ্জা খাঁই।
মাঝে মধ্যে সাব্বির সন্ধ্যা বেলা কাছে আসে , বলে ভাইয়া ১০ টাকা দেন। বা ৫ টাকাদেন । কি হবে জিগেস করলেই বলে চটপটি খাবো অথবা বলে বড় আপু কে দিবো
ও স্কুলে গিয়ে কিছু খাবে।
সত্যি বলতে এই সাব্বির সাধারণের অসাধারন একটা ছেলে, দিন যত যাচ্ছে ওর প্রতি ততই ভালবাসা আর আবেগ টা বাড়ছে।
যে বয়স টা তে সাব্বির পড়া লেখা করবে, খেলবে খেলার মাঠে। বাবা-মার ভালবাসায় বড় হবে। সেই সাব্বির এখনি জীবন যুদ্ধে নেমে গেছে।
সত্যি বলতে আমার মনে হয় আমি নিজেও পারবো না ৫০ কেজি ওজনের কিছু মাথায় নিয়ে এক পা এগোতে। আর সেখানে সাব্বির মাত্র ১২ বছর বয়সের একটা ছেলে খেটে চলেছে......... !!
সকাল ৭ টাই কাজে আসে বাসায় ফিরে রাত ৯ টায়। যে সময়টা তে সাব্বিরের হাতে বই কলম বা খেলনা থাকবে , সেই সময়টাতে সাব্বির ৫০ কেজি ওজনের বস্তা মাথায় নিয়ে কাজ করে।
আসলে আমাদের সমাজ টাই অনেক নোংড়া, যেখানে শিশু শ্রমটা অনেক বেশি সহজ লভ্য।
যে সমাজে ধর্ম নিয়ে মারামারি, সেখানে গাজ্জা খাওয়াটা সাংস্কৃতি । সে সমাজ থেকে এর চেয়ে আর কি বেশি আশা করা যায়??
প্রথম প্রকাশিতঃ মাইন্ড লোকাষ্ট ব্লগ
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জানুয়ারি, ২০১৭ রাত ১:০৭