প্রথম কয়েক মিনিট শুধু মেজাজ খারাপ হচ্ছিল।এখন মনে হচ্ছে উঠে গিয়ে শরীরের সব শক্তি দিয়ে একটা চড় মেরে আসি।ব্যাটা ন্যাকার বাদশা কোথাকার!!পাশের মেয়েটার দিকে তাকিয়ে চড় মারার ইচ্ছেটা সমানুপাতিক হারে আরো বেড়ে যাচ্ছে।বুঝতে পারছিনা সত্যি সত্যিই উঠে গিয়ে চড় মেরে আসবো কীনা।জোর করে চিন্তাটা ডাইভার্ট করার চেষ্টা করি।টেবিলে রাখা গ্লাসের বাকি অর্ধেক পানিটুকুও এক নিঃশ্বাসে শেষ করে ফেললাম।
আমি রকিব এর কথা বলছি।আমার থেকে কয়েক টেবিল দূরে বসে আছে ।কয়েকদিন আগেও আমরা জিগরি দোস্ত ছিলাম।হ্যা,ছিলামই বলতে হয়।টয়লেট আর এক্সাম হল ছাড়া আমাদের কেউ কখনো আলাদা দেখেনি।কালার করা বিশ্রি চুলের যে মেয়েটা রকিবের পাশে বসে আছে আর ওর যে কোন কথা শুনে হাসতে হাসতে গায়ের ওপর গড়িয়ে পড়ছে, ও আসার আগ পর্যন্ত আমরা ভালো বন্ধু ছিলাম।এখন আর বন্ধুদের জন্য ওর সময় নেই।কারণ ব্যাটা প্রেমে পড়েছে।লালচুলো মেয়েটার চুলের মেকি সুবাস নিতেই ও এখন বেশি ব্যস্ত।
ওদের টুকরো টুকরো কিছু কথা আমার টেবিল পর্যন্তও ভেসে আসছে...
-উফ রকিব, তুমি যা মজা করে কথা বলতে পারো না!!
পরের কথাগুলো ঠিকমত বোঝা যায়না...বদলে মেয়েটার চিকন সুরের বিশ্রি হাসিটা আবার ভেসে আসে।আমি বেকুবের মত বসে থাকি।ফ্লপার খেতাব পাওয়া রকিব হঠাৎ কবে থেকে এতো মজার কথা শিখলো কিছুতেই মাথায় ঢুকেনা।
-আল্লাহ রকিব...প্লিজ আর বলোনা... এত বেশি হাসলে তো মরে যাবো।আমি মরে গেলে তোমার কথা শুনে কে এত হাসবে বলো?
এটুকু বলার পর গতবারের চেয়েও বিশ্রি হাসিতে গড়াগড়ি খায় মেয়েটা।গাধার বাচ্চা রকিবটাও বেকুবের মত সুর মিলিয়ে হে হে করতে থাকে।
আমার আর সহ্য হয়না।প্রেমের মত ন্যাকামি মানুষ ক্যামনে করে? রাগে গজগজ করতে থাকি।কদিন পরেই বুঝবি ব্যাটা কতধানে কত চাল।...আরো কিছুক্ষণ এসব দেখলে উঠে গিয়ে নির্ঘাত চড় মেরে বসবো।তার আগেই ভার্সিটি ক্যাফেটেরিয়া থেকে বেরিয়ে আসি।
*****
লাইব্রেরীতে বসে আছি।সামনে তিনটা বই হাট করে খোলা।কালকে এসাইনমেন্ট জমা দেবার লাস্ট ডেট।ক্যামনে কি??এখন কেউ আমার মনের কথা পড়তে পারলে দেখতো দুনিয়ার ৯০% বিরক্তি সেখানে জমে আছে।কপাল কুঁচকে বইয়ের দুর্বোধ্য লেখাগুলো বোঝার চেষ্টা করছি।পেছনে হঠাৎ চুড়ির রিনিঝিনি।উফ,এইসব মেয়ে মানুষের জ্বালায় পড়াশুনাও কিচ্ছু হবেনা।এরা কি পড়তে আসে নাকি চুড়ির আওয়াজ শোনাতে আসে।ভাবতে ভাবতে আরেকবার কান খাড়া করি।চুড়ির আওয়াজ শোনা যায় কিনা।কি আশ্চর্য!এবার আমার ঠিক পাশেই কাঁচ ঘষা টুং টাং।একটু ভড়কে গেলাম।ঘাড়টা বেঁকিয়ে পাশে তাকাতেই দেখি আস্ত একটা মেয়ে মানুষ আমার দিকে চেয়ে হাসছে।মুখের হাসিটা আরো বিস্তৃত করে চুড়িওয়ালী আমাকে জিজ্ঞেস করলো...
-জাহিদ ভাই কেমন আছেন??
এবার আমি পুরোপুরি ভড়কে গেলাম...
***
এক সপ্তাহ ধরে আমার যে কী হয়েছে।কোন কাজেই মন বসছেনা।সব কিছুই কেমন আউলা লাগে।দু ঘন্টা ধরে পড়ার টেবিলে বসে আছি।কিচ্ছু পড়া হচ্ছেনা।হঠাৎ কানের পাশে চুড়ির আওয়াজ শুনে চমকে তাকাই।কিছু নেই তো!!এই নিয়ে তিনবার এমন হলো।আমার কিছু একটা হয়েছে।অবশ্যই কিছু একটা হয়েছে।কিছুক্ষণ নিজের সাথে যুদ্ধ করতে করতে শেষ পর্যন্ত পকেট থেকে মোবাইলটা বের করেই ফেললাম।সদ্য চেনা একটা নাম্বারে ডায়াল করে দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করছি ওপাশের কন্ঠ শোনার আশায়।
-আরে জাহিদ ভাই যে,কেমন আছেন??
নিমিষেই আমার গলা আবেশে ধরে আসে।কোনমতে ঢোক গিলে বলি...
-এইতো ভালোই... তুমি??
***
দুদিন হলো রকিবের নাকি ব্রেকআপ হয়ে গেছে।ওর মুখেই শোনা।শালা একটু আগে আমার পাশে বসে গোল্ডলীফের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলছিল...
-বুঝলি জাহিদ।মাইয়া মানুষরে কখনো বিশ্বাস করতে নাই।বড় খারাপ প্রজাতি।
-হুঁ
- তার চে বাজার থিকা একটা কালসাপ কিন্যা দুধ কলা দিয়া পুষবি।তাও ভাল।
এবার আর কিছু বলিনা।আমি তখন অন্য কিছু ভাবছি।আচ্ছা,রিয়া আজকে কোন কালারের শাড়িটা পড়ে আসবে??
***
এই মুহূর্তে আমি আমার পাশে বসা মেয়েটার দিকে দুনিয়ার সব মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে আছি।রিয়াকে আমি যতবার দেখি ততবারই মুগ্ধ হই।আর পূর্বজন্মে ঠিক কি এমন পূন্য করেছিলাম সেটা মনে করার চেষ্টা করি।মেয়েটা যা হাসতে পারে না!! আমি যা বলেই তাতেই ওর সে কি হাসি!!
-রিয়া,তোমাকে আজ অনেক সুন্দর লাগছে।
-আচ্ছা তাই নাকি??আমাকে আর কেমন কেমন লাগে শুনি??
এটুকু ঠিকমত বলতে না বলতেই দু চোখ নাচিয়ে হাসতে হাসতে ও বিষম খায়।আর একহাতে কালার করা অবাধ্য চুলগুলো সামলাতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে।হাত বাড়িয়ে ওর চুলগুলো হঠাৎ আমার ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করে।
মেয়েটা এখনো হাসছে।আমি দুচোখ ভরে সেই হাসি কুড়িয়ে কুড়িয়ে দেখি।ওর বা পাশের ঝিকিয়ে ওঠা গজদাঁতের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান মানুষ মনে হয়...
আমরা ক্যাফেটেরিয়াতে বসে আছি প্রায় দুঘন্টা হল।হঠাৎ কয়েকটেবিল দূরে চোখ পড়তেই দেখি রকিব একা বসে আছে।দু আংগুলের ফাঁকে প্রায় শেষ হয়ে যাওয়া গোল্ডলীফ ।চোখে চোখ পড়তেই মনে হলো রকিব অনেক বিরক্তি আর রাগ নিয়ে আমাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে।
আমি তেমন একটা পাত্তা দেইনা।চোখ ফিরিয়ে আবার রিয়ার চুলের ঘ্রাণ নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি।
(পূর্ব প্রকাশিত)