মাত্র কয়েকদিন আগে মিউনিখে একজন বন্দুকধারী তরুণ এলোপাথাড়ি গুলি করে আটজন মানুষকে মেরে ফেলল। জার্মানিতে থেকেও এই ঘটনা জানতে পারলাম ঘটনার প্রায় সাথে সাথে বাংলাদেশ থেকে আসা ফোনকল থেকে। আমরা যদিও মিউনিখ থেকে প্রায় আড়াইশ কিলোমিটার দূরে থাকি, তারপরেও আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে দেশের অনেকেই উৎকণ্ঠিত। বাবা মা-তো আছেনই, বেশ কয়েকজন বন্ধু ফেসবুকে মেসেজ দিয়ে খবর জানতে চাইল আমরা সবাই ঠিকঠাক আছি কিনা।
মিউনিখের ঘটনাটা অবশ্যই ভয়াবহ একটা ঘটনা, এর মাত্র কয়েকদিন আগে ফ্রান্সের ট্রাক চালকের ঘটনা এবং বাংলাদেশের গুলশানের টেররিস্টদের ঘটনা ঘটে গেছে। সবাই এখন সামান্যতেই উৎকণ্ঠিত হয়, দেশে তো নিরাপত্তা কোনোকালেই ছিল না, এখন সুদূর ইউরোপেও এইসব হচ্ছে। এবং এই নিয়ে সবচেয়ে বেশী চিন্তিত আমার স্ত্রী। তার ধারণা জার্মানিতেও আর কয়েকদিন পরে রাস্তা ঘাটে বের হওয়া যাবে না, সবাই ঘরে তালাবন্ধ করে বসে থাকবে।
ঘটনাগুলো অবশ্যই খারাপ, তারপরেও মিউনিখের ঘটনার আমি যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করি যে এইসব ঘটনা এখনই ঘটছে এমন না, আগেও এর চেয়ে খারাপ ঘটনা ঘটেছে, এবং এইসব নিয়ে বেশী চিন্তা করে মনের শান্তি এবং রাতের ঘুম নষ্ট করা ছাড়া কাজের কাজ কিছু হবে না। এতে অবশ্য কাজের কিছু হয় নি, বরং সবকিছুতেই আমি বেশী বুঝি – এই ধারণাটা আমার স্ত্রীর আরও গাড় হয়েছে।
যেকোনো কারণেই হোক, আমাকে ভুল প্রমাণ করার জন্য গত দুইদিনে আনসবাখে একজন সিরিয়ান আত্মঘাতী বোমা মারল, একইসাথে রয়েটলিঙ্গেনেও আরেকজন সিরিয়ান চাপাতির কোপে একজনকে মেরে ফেলল। রবিবারে আমি ক্রিকেট খেলে ফিরে দেখি দেশ থেকে অনেকগুলো মিস কল ফোনে। বাসায় ফিরে স্ত্রীর জরুরী ঘোষণা শুনলাম, জার্মানির অবস্থা খুবই নাজুক। এই দেশে নিরাপত্তা বলে কিছু নেই। আমাদের মেয়েদেরকে নাকি কারাতে এবং কুংফুর কোর্সে ভর্তি করানো হবে। আমাদের সাথে ক্রিকেট খেলে অনেকগুলো আফগানী ছেলে। এদেরকে ক্লাবে রাখা ঠিক হবে না, এবং কোনভাবেই বাসায় আনা যাবে না, ইত্যাদি।
টেরর আক্রমণে মৃত্যুর সংখ্যা, ইউরোপের সাথে বাকি বিশ্বের তুলনা
তুলনামূলক চিত্রঃ আমেরিকানদের হাতে আমেরিকানদের মৃত্যুর সংখ্যা টেররদের হাতে আমেরিকানদের মৃত্যুর দশগুণ।
সবকিছুতে বেশী বোঝার থিউরিটা প্রমাণ করার জন্য আমি রাত ব্যাপী ইন্টারনেটে টেরর নিয়ে গবেষণা করলাম। এবং তার ফলাফল থেকে কিছু তথ্য অন্যদের জানানোর জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলাম।
টেররিজমের মূল উদ্দেশ্য বেহেস্তে যাওয়া নয়, বরং এর মূল উদ্দেশ্য হল মানুষের মধ্যে ভয় ঢুকিয়ে দেয়া। এই কাজে একজন সুইসাইড বোম্বার যতটুকু না কার্যকরী, তারচেয়ে বেশী কার্যকরী হল মিডিয়া। এবং ফেসবুক অবশ্যই আমাদের নতুন প্রজন্মের ভয় ছড়ানোর আরেকটি কার্যকরী মাধ্যম। মিডিয়ার কল্যাণে আমরা মুহূর্তের মধ্যে পৃথিবীর সব খারাপ ঘটনা জেনে যাচ্ছি, বিশেষ করে যেখানে কয়েকজন মানুষ মারা গেছে। এবং দেশের মানুষের জার্মানিতে প্রবাসীদের জন্য উৎকণ্ঠা এবং মিডিয়ার প্রচার দেখে মনে হয়, টেররিস্টদের মূল উদ্দেশ্য সফল। চারদিকে একটা ভয় ভয় আবহ। বনের বাঘের বদলে মনের বাঘে সবাই কাবু হয়ে আছে।
ভাল কথা, পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৯৭০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত পশ্চিম ইউরোপে টেরর আক্রমণে বছরে গড়ে ২০০-র বেশী মানুষ মারা গেছে। সেই সংখ্যা গত এক যুগে কমে ১০০-এর নিচে নেমে এসেছে। সুতরাং টেরর বাড়ছে, এবং ইউরোপ নিরাপত্তা হীন হয়ে পড়েছে – এটা বলা যাচ্ছে না। জার্মানিতে বছরে ৫০০-র উপরে মানুষ গলায় খাবার আটকে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যায়। সেই তুলনায় বছরে ১০-২০ জন মানুষ টেরর আক্রমণে মারা যাওয়া নিয়ে মিডিয়া তোলপাড়। কল্পনা করা যাক, খাবার গলায় আটকে যাওয়া মানুষের মৃত্যুর ছবি প্রতিদিন দুইবার করে সমস্ত বিশ্বের টিভিতে লাইভ দেখানো হচ্ছে। ফলাফল হিসেবে অনেকেই হয়তো খাবার খাওয়াই বন্ধ করে দিতে পারে। প্রতি বছর ধুমপানজনিত কারণে কয়েক কোটি মানুষ মারা যায়, এদের কয়জনকে নিয়ে মিডিয়াতে রিপোর্ট হয়? এমন অসংখ্য উদাহরণ দিয়ে প্রমাণ করা সম্ভব, যে টেররিজম নিয়ে যতটা লাফালাফি হয়, তারচেয়ে অনেক বড় বড় বিষয় মিডিয়াতে জায়গা পায় না।
তাহলে টেরর নিয়ে মিডিয়া এতো লাফায় কেন? আমার ধারণা এটা সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা আতঙ্ক সৃষ্টি করা ছাড়া আর কিছু নয়। মানুষ আতঙ্কিত হলে এমন অনেক কাজ করে যা কিনা সাধারণ বুদ্ধি বিবেচনায় কখনই করত না। এই আতঙ্ক সৃষ্টি না করলে 911 এর ঘটনার পর বুশ সরকার কি আফগানিস্তান এবং ইরাক দখল করার জন্য যথেষ্ট জনবল পেছনে পেত, কিংবা ডোনাল্ড ট্রাম্পের পোলের পয়েন্ট বাড়ত কি, অথবা আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্বের অস্রবিক্রির ব্যবসা দিনে দিনে আরও রমরমা হতো কি! জার্মানি গত দুই বছরে অসংখ্য যুদ্ধ বিধ্বস্ত ঘরছাড়া মানুষকে আশ্রয় দিয়েছে, মানবতার অসামান্য উদাহরণ তৈরি করেছে। তবে সবাই মানবতা বাদী নয়। ইংল্যান্ড তো এই ঘটনার অজুহাতে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে গেল। জার্মানিতেও এই ঘটনার বিপক্ষেও অনেকে আছে। সিরিয়ান কেউ আত্মঘাতী বোমা মারার সাথে সাথে তারা প্রশ্ন তুলেছে, এত শরণার্থী কেন আশ্রয় দেয়া হল, কেন তাদের পেছনে এতো টাকা খরচ করা হচ্ছে ইত্যাদি। তাদের এই বক্তব্য বেশিরভাগ মানুষ অগ্রাহ্য করেছে, এখন সাধারণ মানুষের মতামত বদলে দেবার একমাত্র উপায় হল, মানুষকে ভয় দেখানো।
ইসলাম ধর্ম ভাল না, ইউরোপে নিরাপত্তা নাই, চারদিকে সন্ত্রাস আর টেররিজমের রাজত্ব – এই খবরগুলো পাশাপাশি একটা অসাধারণ ব্যাপার ঘটল। মিউনিখে গোলাগুলির পরে মূল রেল স্টেশন সহ শহরের যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ করে দেয়া হয়। এই সময় কয়েক হাজার বিদেশী টুরিস্ট শহরে আটকা পড়ে যায়। তাদের থাকার জায়গা নেই, স্টেশন বন্ধ। অনেকেই রাস্তায় বাক্স পেটরা নিয়ে বসে থাকল। সন্ধের পরে একটা অভাবনীয় ঘটনা ঘটল। মিউনিখ শহরের অনেক বাসিন্দা টুইটার ব্যবহার করে তাদের বাসায় অচেনা অতিথিদের জন্য রাতে থাকার বন্দোবস্ত করে ফেলল। সেখানে বলা হল, আজকের রাতে আমার ঘরের দরজা খোলা থাকবে, কারো যদি রাতে থাকার কোন বন্দোবস্ত না থাকে, চাইলে আজকে আমার ঘরে থাকতে পার। একটু আগে যেই শহরে গুলি করে রাস্তায় আটজন মানুষকে নিথর করে দেয়া হল, সেই শহরেই অচেনা অতিথির জন্য সদর দরজা খুলে দিল অনেক মানবতা। ভয়কে জয় করার একটাই উপায় আছে, সেটা মিউনিখ বাসী আমাদেরকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।
#opendoor
আদনান সাদেক
লিওনবার্গ, জার্মানি।
২৫.০৭.২০১৬
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুলাই, ২০১৬ রাত ২:৩৩