- আপনার নামটা জানতে পারি?
- মোহাম্মদ শফিউল ইসলাম।
- থাকেন কোথায়?
- ঐ আফনারে যেখান থেকে তুললাম। মিরপুর পল্লবী।
- পরিবার আছে?
- আছে স্যার।
- আমাকে স্যার বলছেন কেন, আমি কি আপনার স্যার? আপনি সিএনজির চালক, আমি একজন যাত্রী মাত্র। এখানে কেউ কারও স্যার নয়। ঠিক না?
- এইডা একটা সত্যি কথা বলছেন অবশ্য।
- ছেলেমেয়ে আছে?
- জী স্যার। তিন ছেলে। শাওন, শাফি আর হইল গিয়া শিয়াকির। বড়টা ক্লাস এইটে পড়ে, ছোটগুলান থ্রি আর ফোরে।
- আবার স্যার বলছেন?
- সব প্যাসেঞ্জারদের স্যার বলে অভ্যাস হইয়া গেছে। আর বলবো না।
- বউ ছেলে সবাই পল্লবী থাকে?
- তারা দেশের বাড়িত থাহে। ঢাকায় খরচ পোষাবার পারি না।
- সিএনজি চালিয়ে সবার খরচ চালাতে পারেন?
- কষ্ট হয়। পড়ালেখার জন্যে অনেক টাহা চলে যায়। মনে করেন, বড় পোলার জন্য দুইজন প্রেয়াইভেট শিক্ষক লাগে। সামনে এইটে উঠবে। ভাল শিক্ষক না থাকলে ফলাফল ভাল হইবে না। আশা আছে, ছেলেরা মানুষ হবে।
পল্লবী থেকে উত্তরা যাচ্ছিলাম সন্ধ্যের দিকে সিএনজিতে করে। ঢাকায় শুক্রবারেও অসম্ভব জ্যাম। এই সময়টা আমি চালকদের বিভিন্ন ধরণের প্রশ্ন করি। দেশে আছি অল্প কয়েকটা দিন। লেখার মতন তেমন কিছু পাচ্ছি না। সমকালীন বন্ধু বান্ধব বা আত্মীয় স্বজনদেরকে বড় বেশী বৈষয়িক মনে হয়। তাদের মধ্যে অনেক মার প্যাঁচ থাকে। সরল প্রশ্ন করলে অন্য মানে খুঁজে। এদের সাজানো গোছানো জীবনের বিলাসিতার গল্প লিখতে ভাল লাগে না।
এই ধরণের খেঁটে খাওয়া মানুষগুলোকে খুব সহজে অনেক রকম প্রশ্ন করা যায়। এদের সরলতা বড়ই আপন লাগে। যেমন এই মানুষগুলোকে নাম জানতে চাইলে সুন্দর করে আসল নামটা বলে।
দেশে আসার পর সবাই আমাকে বলে দিয়েছে সিএনজিতে নাকি ভাড়া ঠিক করে না উঠলে চালকরা নানা রকম ঝামেলা করে। মিটার থাকলেও কেউ মিটারে যায় না, চড়া ভাড়া চায়। তাও নাকি আবার সব গন্তব্যে যেতে চায় না।
আমি ভাড়া ঠিক করে উঠিনি। ওঠার সময় বিনীত ভাবে চালককে বলেছি, উত্তরার একটু ভেতরের দিকে যেতে হবে, আপনি কি আমাকে অনুগ্রহ করে নিয়ে যাবেন? চালক সাথে সাথে মাথা নেড়ে দরজা খুলে দিয়েছে। আপাতত মনে মনে আমার চ্যালেঞ্জ, এই চালকটিকে মিটারের ভাড়াতেই সন্তুষ্ট করা যায় কিনা। ব্যাপারটা সহজ হবে না। চালক আমার বেশভূষা দেখে আর যাই হোক ফকিরা পার্টি আশা করছে না। নামার পরে ভাল বকশিস দেবে, এমন আশা করছে নিশ্চয়ই মানুষটা।
- আমারও আপনার মতন তিন সন্তান। তবে সবগুলো মেয়ে। আপনার মিটার ঠিক আছে?
- মিটার তো আছে, তয় সেইডা দিয়া কি আর চলে?
- চলে না কেন?
- ছয়শ টাকা সরকারে ঠিক করসে, আর মালিকরে দিতে হয় হাজার টাকা। কেমনে মিটারে চলি কন।
- সরকার ঠিক করলে কেন হাজার দিতে হবে?
- এইডাই তো কথা। নইলে গাড়ি দেয় না। এইডা দেহার তো কেউ নাই।
- আচ্ছা, আপনি কি আমার কাছে মিটার থেকে বেশী ভাড়া আশা করছেন?
- আপনারা বড়লোক মানুষ। আল্লাহ আপনাগো বেশী দিসে। আপনারা দুইটা পয়সা বেশী না দিলে কেমনে হইব!
- ধরুন আমি আপনাকে মিটার থেকে একশ টাকা বেশী দিলাম। তাহলে কি আপনি খুশী হবেন।
- সেইডা আপনে যা খুশী হইয়া দেন আরকি।
- আপনাকে একশ টাকা আমি বেশী দিতেই পারি। তবে আপনি কি বুঝতে পারছেন যে এতে করে আপনি মানুষ হিসেবে আমার কাছে মাথা নত করে ফেলছেন?
সিএনজি চালক নীরব। আমি তাকে ফাঁদে ফেলে দেবার চেষ্টা চালিয়ে যাই।
- আপনি কিন্তু আমার চেয়ে বেশী পরিশ্রম করে সংসার চালান। আমাদের মতন শিক্ষিতরা যারা আপনাদের মালিক বা যারা আপনার গাড়ির যাত্রী, তারা কিন্তু আপনার চেয়ে কম শ্রম দিয়েও আপনার চেয়ে ভাল আয় রুজি করছে। সামান্য ৫০ টাকা বেশী পাবার জন্য নিজেকে ছোট করে ফেলছেন সেইসব কম শ্রমের মানুষদের কাছে – এইটা কি ঠিক হচ্ছে? এটা কি মানুষ হিসেবে আপনাকে ছোট করে ফেলছে না?
- এইডা ঠিক কথা বলছেন।
- আপনার ছেলেরা পড়াশোনা করে যদি বড় হয়, তারা যদি দেখে তাদের বাবা সামান্য বকশিসের জন্য অন্যদের কাছে মাথা নত করছে, তাহলে তারাও কি নিজেদের ছোট ভাববে না?
মোহাম্মদ শফিউল ইসলাম আমার কথার জবাব দেয় না। সিএনজির সাইড গ্লাসে তার খোঁচা দাঁড়ির রুক্ষ মুখের মধ্যে চোখগুলো একটু জ্বলে জ্বলে উঠে। আমি আর কোন প্রশ্ন করি না। শফিউল ইসলাম এখন তার তিন ছেলের কথা ভাবছেন। তার কষ্টের পয়সায় এই ছেলেগুলো একদিন পড়াশুনা শেষ করে মানুষ হবে। তখন তাদের বাবার কষ্ট দূর হবে। শফিউল ইসলাম নিজে দুইটা বাড়তি পয়সার জন্য নিজে ছোট হলেও কল্পনায় তার ছেলেরা মাথা উঁচু করে সত্যিকারের মানুষ হয়ে বড় হবে।
মিটারে ১৪৭ টাকা চল্লিশ পয়সা বিল দেখাচ্ছে। শফিউল ইসলাম কোন কথা না বলে অনেক সময় নিয়ে পাঁচশ টাকার নোটের ফেরতে গনে গনে ৩৫২ টাকা ফেরত দিল। আমি টাকাটা পকেটে ঢুকিয়ে ভাবলেশহীন মুখে ব্যাগ নিয়ে দরজার দিকে পা বাড়াই। শফিউল ইসলামের মুখটা একটু বিষণ্ণ। ভাড়া ঠিক করে এলে সে অন্তত আড়াইশ থেকে তিনশ টাকা পেত। সেই বাড়তি টাকায় হয়তো তার তিনটি ছেলের একমাসের বইয়ের খরচ আসতো।
মানুষটার সাথে আরেকটু নিষ্ঠুর হলাম। তার চোখের আড়াল হয়ে দরজা লাগানোর ভাব করলাম। শফিউল ইসলাম নিজের সাথে লড়াই করছে তখনো। আমাকে কি সে আরেকবার ডাক দেবে?
সেটার বদলে বাইরে সিএনজি স্টার্ট হবার শব্দ হল। মুহূর্তের মধ্যে দরজা খুলে বের হয়ে এসে শফিউল ইসলামকে থামালাম। আমার পরীক্ষা সফল হয়ে গেছে এরমধ্যেই।
ব্যাগ থেকে নিজের লেখা একটা নতুন বই বের করে সেখানে গোটা অক্ষরে লিখলাম,
„প্রিয় শাওন, শাফি ও শিয়াকির,
তোমাদের বাবার স্বপ্ন পূরণ হোক, তোমরা মাথা উঁচু করা মানুষ হও। ইতি আদনান।„
- আপনার ছেলেদের জন্য একটা সামান্য উপহার ছিল। এই বইটা তাদের পড়তে দেবেন।
- আপনের সাথে পরিচয় হইয়া বড় ভালা লাগল।
শফিউল ইসলাম চলে যেতে আমার ভেতরেও এক ধরণের অজানা আনন্দ হয়। কেন জানি মনে হতে থাকে, এই মানুষগুলো আর তাদের স্বপ্নগুলোর কথা লেখার জন্যই আমার লেখনী। শফিউল ইসলাম অনেকদিন পর বাড়ি ফিরে গভীর মমতায় তার ছেলের হাতে আমার বইটি তুলে দেবেন। তার ছেলে জার্মানির ডায়রি পড়তে পড়তে হঠাত করে চিৎকার করে উঠবে, বাপজান, বইয়ের মধ্যে একটা হাজার টাকার নোট!
#আদনান_সাদেক
ঘটনাকালঃ ২রা জানুয়ারি, ২০১৫।