"খেলার সপ্তম গোলকে উৎসর্গ করব আমাদের স্ত্রীদের জন্য, আর অষ্টম গোল আমাদের কুকুরদের জন্য", "মুখে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে মাঠে খেলব, এরা আবার ফুটবল পারে নাকি!" ১৯৮২ সালের হট ফেভারিট জার্মানির খেলোয়াড়রা সেইবারই প্রথমবারের মতন বিশ্বকাপে সুযোগ পাওয়া আলজেরিয়ার বিরুদ্ধে প্রথম ম্যাচে নামার আগে প্রেসে এই ধরনের অবহেলা সূচক মন্তব্য করেছিল। রুমানিগের জার্মানি তখন বাছাই পর্বে সব দলগুলোকে উড়িয়ে দিয়ে বিশ্বকাপের মূল পর্বে উন্নীত হয়েছে। তারা বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্নে উদ্বেগ, আলজেরিয়ার মতন দুবলা দলের বিপক্ষে কে কে হ্যাট্রিক করবে, এই নিয়ে তাদের মধ্যে হাস্য তামাশা চলছে। এমনকি দলের কোচ পরবর্তীতে স্বীকার করেছেন, সবার হাস্যরস হতে হবে বলে, খেলার প্রস্তুতি হিসেবে আলজেরিয়ার ভিডিও ফুটেজ দেখান নি খেলোয়াড়দের।
খেলার পর ফলাফল লেখা হলঃ আলজেরিয়া-২ জার্মানি-১। বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় অঘটনের একটি।
এর চেয়েও ন্যক্কারজনক ঘটনার জন্ম দিল প্রথম রাউন্ডের শেষ খেলায় মুখোমুখি দুই নাৎসি জমানার মিত্র রাষ্ট্র জার্মানি এবং অস্ট্রিয়া। গ্রুপে আলজেরিয়া এবং অস্ট্রিয়া দুই দলই চার পয়েন্ট নিয়ে গ্রুপের শীর্ষে, জার্মানিকে পরের রাউন্ডে উঠতে হলে অস্ট্রিয়াকে হারাতে হবে। তবে গোল ব্যবধান ১-০ হলেই শুধু জার্মানি এবং অস্ট্রিয়া দুই দলই পরের রাউন্ডে উঠতে পারবে। অন্য যেকোনো ফলাফলে আলজেরিয়ার দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠা নিশ্চিত।
২৫শে জুন, ১৯৮২। এল মলিনন স্টেডিয়াম, স্পেন। জার্মানি-১ অস্ট্রিয়া-০। দশ মিনিটের মাথায় জার্মানি গোল করার পর বাকি আশি মিনিট অস্ট্রিয়ার দুই একজন খেলোয়াড় ছাড়া বাকিরা শুধু বল দেয়া নেয়া করল।
জার্মান ধারাভাষ্যকার এবারহার্ড স্ট্যানিয়াক খেলার এক পর্যায়ে কমেন্টারি ত্যাগ করলেন। অস্ট্রিয়ান ধারাভাষ্যকার রবার্ট সিগার পর্যন্ত বললেন, আপনার টিভি বন্ধ করে দিতে পারেন, আজকের খেলায় আর যাই হোক, গোল হবার কোন সম্ভাবনা নেই।
মাঠের স্প্যানিশ দর্শকরা দুয়ো দিয়েছে, "কু সে বেসেন (ওদের চুমা খেতে দাও)" বলে। জার্মান অনেক সমর্থকরা এই পাতানো খেলার অপবাদে জাতীয় পতাকা পর্যন্ত পুড়িয়েছে।
আলজেরিয়া যোগ্য দল হয়েও বিশ্বকাপ থেকে বাদ পড়ে গেল। তবে দুই ধনী দেশের এই পাতানো খেলা নিয়ে ফিফা কোন উচ্চবাচ্য করল না। এইবারের বিশ্বকাপের উরুগুয়ের সুয়ারেজের মতন কাউকে ব্যান তো দুরের কথা, এক পয়সা ফাইনও করা হল না। সিংহভাগ ইউরোপিয়ান শিক্ষিত সাংবাদিক সমাজ চোখ বুঝে সামনের খেলায় মন দিলেন।
আমরা দ্রুত অতীত ভুলে যাই। অনেকে আবার খেলার মধ্যে রাজনীতি খুঁজতে চান না। তবে শেষ খেলায় জার্মানদের আমেরিকার বিরুদ্ধে গোল করার অনীহা দেখে জার্মান মৌন সমর্থক হয়েও ভাল লাগে নি। ঘানা যদিও জিতে নি, কিন্তু রাগ হয়েছে সবার উরুগুয়ের সুয়ারেজকে নিয়ে মাতামাতি করা নিয়ে। কেউ কথা তোলেনি, যেই জার্মানি পর্তুগালের বিরুদ্ধে গণ্ডায় গণ্ডায় গোল দিয়েও বারবার আক্রমণ চালিয়ে গেল পরের গোল দেবার জন্য, সেই জার্মানি আমেরিকার সাথে খেলায় এতটা নিষ্প্রাণ থাকল! জার্মানিতে বসে এই প্রথম খেলায় জয়ের পর সমর্থকদের সবচেয়ে কম উল্লাস লক্ষ্য করলাম। এমন প্রাণহীন উদ্দেশ্যবিহীন খেলা দেখে জার্মানদেরও প্রায় কোন উচ্ছ্বাস নেই!
খেলায় কাউকে সরাসরি সমর্থন দেই না। যেখানে নিজের দেশ নেই সেখানে কারও পক্ষে লাফালাফি করাকে অপ্রতুল মনে করি। তবে এইবার দ্বিতীয় রাউন্ডে যখন জার্মানি আলজেরিয়ার মুখোমুখি হবে, তখন আফ্রিকানদের জন্য প্রার্থনা করব। ঠিক যেমন ৯৮ সালের বিশ্বকাপে আমেরিকাকে হারিয়ে রাজনৈতিক শোষণের জবাব দিয়েছিল ইরান, সেইরকম ৮২ সালের অপমান এবং নির্লজ্জ পাতানো খেলার প্রতিশোধ নিয়ে জার্মানিকেও এইবার ঘরে ফেরত পাঠাক আলজেরিয়া!
বিশ্বকাপ ফুটবল শুধু একটা খেলা নয়, এর মধ্যে জড়িত অনেক জাতির ইতিহাস, আবেগ আর প্রজন্মের অহংকার।
#বিশ্বকাপ_ভাবনা