১
১৯৮৯ সালের এক সকাল।
রোমিল্ডোর খুব সকালে ওঠার অভ্যাস। ঘুম থেকে উঠে তাঁর দিনের প্রথম কাজ হয় তিন ছেলেকে বিছানা থেকে তোলা। তিন ছেলের জন্য একটি মাত্র বিছানা, রাতের বেলা একটু কুয়াশা পড়ে ঠাণ্ডা হয়ে আসে এই অঞ্চলে। তিন ছেলে একটি চাদর নিয়ে টানাটানি করে মেঝেতে ঘুমায়। রোমিল্ডো আর্দ্র মনে ঘরে ঢোকেন। একমাত্র ছোট বিছানায় দুইটি মেয়ে ঘুমিয়ে। একটু টাকা হাতে জমলেই ছেলেগুলোর জন্য তিনি আলাদা বিছানা কিনবেন। ঘরের জানলার দরাজটা ভাঙ্গা, সেখান দিয়ে হুহু করে ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকছে।
ছোট ছেলেটি চাদর কাড়াকাড়িতে সবসময় পিছিয়ে থাকে। ছেলেটার নগ্ন পা বের হয়ে আছে, সেখানে শীতে কুঁকড়ে যাবার চিহ্ন ফেলে অন্য একটা কিছু রোমিল্ডোর নজরে পড়ল। ছেলেটার পা দুটো একটু বাঁকা। ছেলেবেলায় অপুষ্টিতে ভুগে ভুগে রিকেট রোগেরর আঘাত এখনও স্পষ্ট। ছেলেটার গায়ে ছেঁড়া একটা হলুদ জার্সি, পেছনে ১০ নম্বরের পাশের নামটা এখন আর পড়া যায় না। রোমিল্ডো জানেন সেখানে জিকোর নাম। তার ছোট ছেলের স্বপ্নের ফুটবলার জিকো।
রোমিল্ডো কাজে বের হবার আগেই সবাইকে ঠেলে ঘুম থেকে উঠিয়ে দেন। না, কারই স্কুলে যাবার তাড়া নেই। স্কুলে দেবার পয়সা রোমিল্ডোর নেই। এই সময়টাতে রেকিফে অনেক টুরিস্ট আসে। তিন ছেলের দায়িত্ব সেখানে সুভিনিয়ার বিক্রি করা। যেদিন ভাল বিক্রি হবে, সেদিন বিকেলে তাদেরকে বিচে ফুটবল খেলতে দেবার অনুমতি দেয়া হয়, নতুবা নয়। রোমিল্ডো তাঁর স্ত্রীর কথায় জানেন, প্রায় সময়ই বিক্রি ভাল হয় না। তবুও তিন ছেলে অনেক রাত পর্যন্ত বীচে ফুটবল খেলে তবে বাড়ি ফেরে। বড় ছেলেটা বখে গেছে, সে নাকি লুকিয়ে চুরিয়ে ড্রাগ নেয়। রোমিল্ডো তাদেরকে এখন আর কিছু বলেন না, তিনি জানেন এই অবস্থা পরিবর্তনের জন্য তিনি কিছু করতে পারেন নি।
রোমিল্ডো নিজেও মাঝে মাঝে লুকিয়ে অফিস ফেরার পথে বীচের পাশে দিয়ে হেঁটে ফেরেন। তাঁর ছোট ছেলেটার পা দুটো একটু বাঁকা হলেও ছেলেটা ভাল খেলে। শুধু ভাল না, বেশ ভালো। ভাল খেতে না পেলেও তার গতি অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষিপ্র, বাঁ পায়ে দুর্দান্ত শট। ছেলেটার মধ্যে মেধা আছে, একটা পেশাদারী ক্লাবে ঢুকিয়ে দিতে পারলে মন্দ হতো না। সেটা সম্ভব নয় তিনি জানেন। একট দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে রোমিল্ড মন্ত্রমুগ্ধের মতন ছোট ছেলেটার খেলা দেখেন।
রাস্তা পার হতে হতে রোমিল্ডোর বুকটা খালি হয়ে আসে। দরিদ্রতা থেকে তিনি বের হতে পারছেন না। ছেলেদেরকে স্কুলে দেবার পয়সা নেই। তিনি নিজেও ফুটবল ভালবাসেন, ছেলেদেরকে সব সময় উৎসাহ দেন খেলা চালিয়ে যাবার। তাঁর ক্ষীণ আশা যদি একটা ছেলেও পেশাদারী ফুটবলার হতে পারে। দারিদ্রতা থেকে বের হয়ে আসার আর কোন পথ রোমিল্ডোর জানা নেই।
বাসের জন্য বেশ খানিকটা পথ হাঁটতে হয়। তাঁর মতন কেরানীর জন্য এটা সাধারণ একটা ঘটনা। ব্রাজিলের উত্তরাঞ্চলের এই শহরটি অত্যন্ত অবহেলিত, পেলে জিকো রোনালদো বা রোমারিওর মতন খেলোয়াড়রা সবাই অপেক্ষাকৃত ধনী দক্ষিণাঞ্চল থেকে বের হয়ে এসেছে। রেকিফের মতন দরিদ্র শহর থেকে কিছু একটা হবে- এই আশা করা অকল্পনীয়। রোমিল্ডো নিজেও সেটা জানেন। ভোরবেলায় তিন ছেলের চাঁদর নিয়ে টানাটানির দৃশ্যটা তাঁর চোখে আবার ভেসে আসে। তাঁর চোখ ভিজে আসে, রাস্তা পার হতে গিয়ে তিনি একটু অসতর্ক হয়ে যান। চোখ মুছতে গিয়ে তাঁর মনে হয় যেন চারদিকে কাঁপিয়ে কেউ যেন হর্ন দিচ্ছে। শব্দটা কেমন যেন পরিচিত, প্রতিদিন তিনি যেই বাসে করে অফিসে যান সেই বাসটারই হর্ন মনে হচ্ছে না?
২
রোমিল্ডোকে মুমূর্ষ অবস্থায় হাসপাতালের নিচে ফেলে রাখা হয়েছে। জরুরী বিভাগে তাঁর মতন আরও অনেক রোগী পড়ে আছে এখানে সেখানে। বাসের নিচে চাপা পড়ে তাঁর মুখ থেঁতলে গেছে। তাঁর ইনস্যুরেন্স করা নেই, সেক্ষেত্রে হয়তো তাকে অপারেশন থিয়েটারে নেয়া হতো। তিনি প্রচণ্ড ব্যথায় ছটফট করতে করতে আবিষ্কার করলেন তাঁর ছোট ছেলেটা শক্ত করে তাঁর হাত ধরে বসে আছে। ছেলেটার অপুষ্টিতে ভোগা ভেতরে ঢুকে থাকা চোখ দুটোতে একফোঁটা পানি নেই। ছেলেটার পরনে জিকোর অস্পষ্ট নাম লেখা ১০ নম্বর একটা হলুদ জামা। তাঁর মনে পড়ল, ছেলেটার এইটাই একমাত্র জামা।
রোমিল্ডো কথা বলতে পারছেন না। শুধু ছেলেটার হাতটাতে আলতো করে চাপ দিয়ে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে মনে মনে বললেন, খেলাটা ছাড়িস না বাপজান!
১৫ বছরের রিভালদো হাসপাতালে ছোটাছুটি করল না। এই বয়সেও সে জেনে গেছে এই দেশে গরিবদের চিকিৎসা হয় না। মৃত বাবার হাত ধরে সে প্রতিজ্ঞা করল, একদিন সে বিশ্বসেরা ফুটবলার হবে।
৩
ঠিক দশ বছর পর, ১৯৯৯ সালে ফিফার বর্ষসেরা পুরস্কার হাতে নিলেন রিভালদো। জীবনের কঠিন তম সময়েও তিনি কাঁদেন নি। শুধু এই পুরস্কারটি নেবার সময় তিনি নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। তাঁর এই পর্যন্ত আসতে যেই মানুষটির অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে, তিনি আজকে নেই। আজকের এই স্বপ্ন রিভালদোর নয়, এই স্বপ্ন ছিল রোমিল্ডোর। তিনি সেটা দেখে যেতে পারলেন না।
তাঁর পরনে এখনও থাকে সেই হলুদ জার্সি, তাঁর পেছনে এখন আর জিকোর নাম নয়। ১০ নম্বর হলুদ জার্সিতে লেখা থাকে রিভালদো। ২০০২ সালে পেলে জিকোর উত্তরসূরি ১০ নম্বর জার্সি পরে ব্রাজিলের হয়ে বিশ্বকাপও জয় করলেন রিভালদো।
রিভালদোর জমকালো প্রাসাদ থেকে সমুদ্র দেখা যায়। একসময় এই বীচে তিনি টুরিস্টদের নুড়ি পাথর বিক্রি করতেন। এখন এই প্রাসাদ থেকে বের হলেই টুরিস্টরা তাঁকে জেঁকে ধরে, শুধু একটা অটোগ্রাফের জন্য।
৪
ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১৪।
১৮ বছরের বড় ছেলে রিভালদিনহোর সাথে বদলি খেলোয়াড় হিসেবে লিগের খেলায় নামলেন ৪১ বছরের রিভালদো। এই স্টেডিয়ামটির নামকরণ হয়েছে তাঁর বাবা রোমিল্ডোর নামে। রোমিল্ডো তাঁর ছেলের পেশাদারী একটি খেলাও দেখে যেতে পারেন নি। কিন্তু রিভালদো সেই অপূর্ণতা রেখা যাবেন না। খেলার শেষে বিশ্বকাপ, ইউয়েফা, কোপা জেতা রিভালদো বললেন, ছেলের সাথে ৩০টি মিনিট মাঠে থাকাটাই ছিল তাঁর বর্ণময় ক্যারিয়ারের সবচেয়ে স্মরণীয় অভিজ্ঞতা।
পুনশ্চঃ
বিশ্বকাপের খেলা নিয়ে চারদিকে মাতামাতি আর আলোচনার ঝড়ে ব্রাজিলের আনাচে কানাচে জেগে ওঠা সরকার বিরোধী বিপ্লবের আগুন চাপা পড়ে গেছে। বিশ্বকাপ আয়োজনে সরকারের ব্যয় হয়েছে নাকি প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলার। অনেক ব্রাজিলিয়ানদের দাবি- শুধু বিশ্বকাপ নয়, তারা চায় সামাজিক সমতা, সকলের জন্য স্বাস্থ্য এবং শিক্ষার সুযোগ।
বিশ্বকাপের ডামাডোলের মাঝে রিভালদোর একটা কথা কোথায় যেন চোখে পড়ে গেল। তিনি ব্রাজিলে বিশ্বকাপের আয়োজনের প্রতিবাদ করে লিখেছিলেনঃ “It’s shameful to spend so much money for this World Cup and leave the hospitals and schools in such a precarious state. At this moment we aren’t in shape to host the World Cup, we don’t need it, we need education and health.” এই লাইনগুলো পড়ে চমকে উঠেছিলাম। আমরা টিভির স্ক্রিনে খেলা দেখে হইচই করি, ফেসবুকে স্ট্যাটাস আপডেট দেই। রিভালদোই জানে, হাসপাতালে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করা পিতার অসহায় চোখের চেয়ে বিশ্বকাপ বড় নয়।
#আদনান_সাদেক #বিশ্বকাপ_ভাবনা
১৩ই জুন, ২০১৪
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জুন, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:২২