এই বছরের আগেও ব্রাজিল আরেকবার বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজন করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে ১২ বছর বন্ধ থাকার পর ১৯৫০ সালে ইউরোপের কোন দেশ রাজি না থাকায় শেষমেশ ব্রাজিলে আয়োজিত হল সেবারের বিশ্বকাপের। সেই বিশ্বকাপে দুইটি দেশের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ থাকল।
বিশ্বকাপের আমেজ বাংলাদেশে
যুদ্ধে পরাজিত পর্যুদস্ত প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া একটি জাতি জার্মানি। জার্মানির প্রায় প্রতিটি সেতু বোমার আঘাতে তখন পানির নিচে, প্রতিটা কলকারখানায় চিমনি দিয়ে তখনও উৎপাদনের বদলে কামানের গোলার ধোঁয়া বের হয়। দেশ হিসেবে তাদের কোন নিজস্ব আত্মপরিচয় নেই বললেই চলে। আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স আর রাশিয়া চার ভাগে ভাগ করে নিয়েছে দেশটিকে। তাদের দয়ায় জার্মানদের অধিকার নির্ধারণ হয়। তারা কি করতে পারবে, আর কি পারবে না – সেটা চার মিত্র দেশগুলো মিটিং করে ঠিক করে দেয়। ফুটবল তাদের রক্তে মিশে থাকলেও, জার্মানিতে কোন প্রফেশনাল ফুটবল দল গঠনের অনুমতি মিলে নি। পাড়ায় মহল্লায় অবহেলায় জার্মানরা মাথা নিচু করে তাদের ফুটবল চালিয়ে গেল, হয়তো কোন একদিন যদি আবার বিশ্ব অঙ্গনে প্রতিযোগিতার অনুমতি পাওয়া যায় – সেই আশায়। সেই আশা পূরণ হল না। জাপান এবং জার্মানি ১৯৫০ এর বিশ্বকাপে খেলার অনুমতি পেল না।
চার বছর পর বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি সয়ে আসার সাথে সাথে ১৯৫৪ তে অবশেষে সেই অনুমতি মিলল। তখনও জার্মানিতে ফুটবল মানে এমেচার পর্যায়ের খেলা। প্রফেশনাল কোন ক্লাব নেই, শুধুমাত্র স্থানীয় উদ্যোগে কোন ধরনের বেতন ভাতা ছাড়াই খেলোয়াড়রা তাদের অবসরে খেলা চালিয়ে যাচ্ছিল। সেই এমেচারদের দিয়ে গড়া জার্মান দল চুয়ান্নর বিশ্বকাপে কোয়ালিফিকেশন খেলে জিতে গেল সবাইকে অবাক করে দিয়ে।
পুসকাসের হাঙ্গেরি তখন সর্বকালের অন্যতম সেরা দল। গ্রুপ পর্যায়ের খেলায় তারা কোরিয়াকে ৯-০ তে হারানোর পাশাপাশি জার্মানিকে ৮-৩ গোলে তুলো ধুনো করল। জার্মানি টুর্নামেন্ট থেকে বাদ পড়ে যায় যায় বলে। সবাই ভাবল এমেচারদের নিয়ে আর কতদূর যাওয়া যায়। বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই যে করেছে – এইতো অনেক।
বহির্বিশ্বের মতামতের সাথে দ্বিমত দেখিয়ে দেশ থেকে সমর্থন অব্যাহত থাকল। জার্মানির রাস্তায় রাস্তায় মানুষ জানাল, হারি জিতি, তোমাদের সাথেই আছি। তুরস্কের সাথে প্লে-অফ খেলায় জার্মানরা ফিরে এলো স্বরূপে। জার্মানি -৭ তুরস্ক-২, শেষ আটে ব্রাজিল, হাঙ্গেরি, উরুগুয়ে, ইংল্যান্ডের সাথে জার্মানিও যোগ দিল।
হাঙ্গেরি জাতীয় দল, ১৯৫৪
প্রাক্তন চ্যাম্পিয়ন উরুগুয়ে এবং ব্রাজিলকে উড়িয়ে দিয়ে হাঙ্গেরি অপ্রতিরোধ্য ভাবে ফাইনালে। সেটা নিয়ে অবশ্য কারও বিস্ময় নেই। পুশকাস, ককসিসের সর্বকালের সেরা দল ফাইনালে খেলবে, এবং বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হবে – সেটাই তো স্বাভাবিক। তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী অপ্রত্যাশিত ভাবে জার্মানরা, যাদের কিনা বিশ্বকাপে খেলাই অনিশ্চিত ছিল, যাদের কিনা কোন প্রফেশনাল ফুটবল ক্লাব নেই, যাদের খেলোয়াড়দেরকে কিনা অনেকটা ব্যক্তিগত উদ্যোগে টুকিয়ে টাকিয়ে যুদ্ধ বিধ্বস্ত পশ্চিম জার্মানি থেকে জড়ো করা হয়েছে।
জার্মান দল, ১৯৫৪
ফাইনাল খেলার ৮ মিনিটের মধ্যে ইনজুরিতে আগের দুই ম্যাচ বসে থাকা পুশকাস এবং চিবোরের গোলে ২-০ তে এগিয়ে গেল হাঙ্গেরি। সবাই বলাবলি করতে লাগল, এইবার এক ডজন গোল দিয়ে মাঠ ছাড়বে পুশকাসের দল। ফাইনালের আগে সাড়ে চার বছর পর্যন্ত অপরাজেয় হাঙ্গেরি, একটানা ৩২ টি আন্তর্জাতিক খেলায় তারা জিতেছে। মাঠে উপস্থিত জার্মান ধারাভাষ্যকার হের্বাট সিমারমান পর্যন্ত বললেন, পুশকাস হল ফুটবলের ঈশ্বর, তার সাথে খেলার সৌভাগ্যই জার্মানদের জন্য অনেক। এখানে জয় পরাজয় মুখ্য নয়, শুধু নয়ন ভরে পুশকাসের খেলা দেখাই বড় প্রাপ্য।
সিমারমানকে বিস্মিত করে দিয়ে জার্মানরা খেলায় ফিরে এলো প্রথমার্ধেই দুইটি গোল শোধ দিয়ে। দ্বিতীয় অর্ধে পুশকাসের হাঙ্গেরির একচেটিয়া আক্রমণ একে একে ফিরিয়ে দিল জার্মান গোলকিপার টনি টুরেক। একইসাথে গোলপোস্টে লেগে ফিরে গেল অনেকগুলো শট। শেষমেশ বাঁ পায়ের জাদুতে দুইজন প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে খেলার ৮৪ মিনিটে জয়সূচক গোলটি করলেন হেলমুট রাহন। জার্মানি প্রথমবারের মতন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন!
হেলমুট রাহন
১৯৫৪ এর বিশ্বকাপ বিজয় জার্মান জাতির জন্য শুধু সামান্য একটি খেলার জেতা নয়। এই বিজয় পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করল, তাদের হারিয়ে যাওয়া আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে এনে দিল। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খেলার অধিকার না থাকার পরও মাথা নত করে হাল ছেড়ে না দেবার উদ্যম তাদেরকে আবার বিশ্বের দরবারে ফিরিয়ে আনল। সেই থেকে আর পিছু ফিরতে হয়নি তাদের। শুধু ফুটবল নয়, জাতি হিসেবেও তারা খুব অল্প সময়ের মধ্যে হিটলারের অপকীর্তিকে পেছনে ফেলে বিশ্বে তাদের অবস্থানকে পুনরুদ্ধার করল।
১৯৫৪ সালের বিশ্বকাপ জয়ী জার্মান দলের খেলোয়াড়দের সাক্ষর
বাংলাদেশ ফুটবল খেলতে পারে না বলাই বাহুল্য। সামান্য পাকিস্তান, মালদ্বীপের মতন দেশেরাও আমাদেরকে পেছনে ফেলে ফিফার র্যাঙ্কিং এ উপরে চলে গেছে, বাস্তবতাকে স্বীকার করে নিতেই হয়।। তারপরও রাত দুইটায় সবাই জেগে খেলা দেখবে, বাড়িতে বাড়িতে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনার পাশাপাশি জার্মানির পতাকাও দেখা যাবে। আমরা শুধু খেলার মাঠে তারকাদের দেখব, মেসি রোনালদোর পায়ের জাদু দেখে বাহবা দেব। খেলায় হেরে কেউ কেউ আত্মহত্যাও করবে। তবে খেলার পেছনে এই তারকাদের, আর তাদের কঠোর পরিশ্রমের কথা কেউ ভাবব না। একটি একটি করে জাতি নিজেদেরকে বিশ্বের ময়দানে নিজেদের তুলে ধরার জন্য যখন বছরের পর বছর অনুশীলনে ব্যস্ত, আমরা তখন একটির পর একটি বিশ্বকাপ নিয়ে পরীক্ষা পেছানোর দাবি তুলব। একটি বিশ্বকাপ শেষ হলে আবার চার বছর শীত নিদ্রায় সময় গুনব পরের বিশ্বকাপের অপেক্ষায়।
প্রতিটি সফল জাতি আর তার ইতিহাসের পেছনেই রয়েছে অনেক অনেক কষ্ট আর আত্মত্যাগ। টিভি থাকলেই খেলা দেখা যায়, খেলা বুঝলেই বিজাতীয় দলের জন্য পর্যন্ত আনন্দ পাওয়া যায়। তবে কষ্ট সহ্য করে দাঁতে দাঁত চেপে কঠোর পরিশ্রম ব্যতীত সাফল্য মেলে না। কেউ কেউ জীবনের সার্থকতা খোঁজেন, এক জীবনে কতগুলো বিশ্ব কাপ দেখে যেতে পেরেছেন -এই হিসেব করে। যুদ্ধে হেরেও জার্মানরা অন্তত বিশ্বাস করেছিল যে, তারাও পারে। জার্মানির মতন সফল না হলেও, জাপানও দেখিয়েছে তারাও অতীতকে কিভাবে পেছনে ফেলে উঠে দাঁড়াতে হয়। একদিন আমাদের মানুষগুলোও টিভি বন্ধ করে ছাদে লাল সবুজ পতাকা উড়িয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে আঙ্গুল দিয়ে বলবে, আমরাও খেলব বিশ্বকাপে!
সেই বিশ্বকাপের অপেক্ষায় থাকলাম। এক জীবনে যদি একবারও আসে তো তাই সই।
আদনান সাদেক, ২০১৪
স্টুটগার্ট, জার্মানি।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জুন, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:২০