মাহি এবং... (অনিয়মিত পার্ট)
তিনঃ
আম্মা বেশ মনমরা হয়ে অফিস করেন। সন্ধায় বাসায় এসে আমার খোঁজ খবর নেন। আমি থাকি মামার বাড়ী আর বুয়ার কাছে। আমি আজিবন আমার বাড়ী বলতে পরিচয় দিয়েছি মামার বাড়ী, ঠিকানাঃ ১২১, বি.কে. মেইন রোড (পূর্ব), খুলনা-৯০০০ আর গ্রামের বাড়ী হিসেবে আমার খালার বাড়ী। আমদের ভাড়া বাসা আর মামার বাড়ী একই এলাকায়। বিশাল বাড়ী। বাড়ী ভরতি বিভিন্ন ধরনের গাছ। শুধু আমগাছিই ছিল প্রায় ১০/১২ টা। পুরো বাড়িটা ১ বিঘার উপর জায়গা নিয়ে। যারা বিঘার হিসাব বোঝেননা তাদের জন্য বলছি, ১ বিঘায় মোট ১৪৪০০ স্কয়ার ফুট। মামার বাড়িটা ছিল পুরো জমিটার ঠিক মাঝখানে। আর চারিদিকে শুধু গাছপালা। গেট দিয়ে ঢুকে হাতের বাদিকে পাশের বাড়ীর সিমানা দেয়াল। সেই দেয়াল ধরে একটা প্রায় ৬ ফুট চওড়া কাঁচা ইটের রাস্তা চলে গেছে বাড়ীর গেট পর্যন্ত। রাস্তার ডান দিকে বিভিন্ন ফল আর ফুল গাছের একটা বাগান। বাগানের মাঝে ঘাসে ঢাকা বাচ্চাদের খেলার জায়গা। বাগানের পরেই ছিল একটা লম্বা ২ রুমের মাটির ঘর। গোলপাতার ছাউনি দেয়া। সামনে একটা লম্বা বারান্দা। এই দুইটা ঘরের একটাতে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছিলেন আমার বড় মামার শ্বশুর আর পাশের ঘরটাতে প্রথমে ছিল ছোট মামা আর তার পরে ছিলেন পলাশ দাদা। আমার মামাতো ভাই। সবচেয়ে বড় ভাই।
এই ঘরের পাশেই ছিল একটা অপেক্ষাকৃত ছোট দোচালা ঘর। তিন কামরার। এখানে থাকতেন বারি মামা। বারি মামা হলেন আমার বড় মামির বড় ভাই। সেই বাসায় এক ঘরে থাকতো হাসি আপা, খুশি আপা আর মিলি আপা, বারি মামার তিন কন্যা। মাঝের ঘরে বারি মামা, মামি আর বনি। বনি তখন এই এতটুকুন বাচ্চা। কি নাদুসনুদুস আর ফর্সা। সামনে ছিল একটা বসার ঘর। সেখানে মেহমানরা আসলে থাকতেন আর পেছনে একটা ছোট্ট খাবার ঘর। খাবার ঘর থেকে বের হয়েই হাতের বাম দিকে নিচু পিচ্চি এক মাটির রান্নাঘর। এটারও গোলপাতার ছাউনি এবং অবশ্যই মাটির চুলা। রান্নাঘরে মাথা নিচু করে ঢুকতে হতো। চুলোর উপর ছিল একটা মাচা। মাচা ভরতি রান্নার শুকনা কাঠ। বারি ছিলেন গ্রামের চেয়ারম্যান। ওনাকে ছোট বেলায় আমরা দারুন ভয় পেতাম। মামার একটা চোখে খুব ছোট বেলায় বক ঠোকর দিয়েছিলো। এটা থেকে অনুমান করা যায় মামা বেশ শান্ত ছিলেন। মামা দীর্ঘদিন ছিলেন ইউরপের, লন্ডন শহরে। পরবর্তী সময়ে ছিলেন বি.আর.টি.এ.-এর বিভাগীয় ম্যানেজার। মোদ্দাকথা অনেক শিক্ষিত।
বারিমামাদের ঘর পার হয়েই ছিল আর একখানা ছোট তিন রুমের বাড়ি। বারিমামাদের চেয়ে একটু ছোট। দীর্ঘদিন আমরা এই ঘরটাতেই ছিলাম। এরপরেই ছিল আমাদের কলঘর। একেবারে উত্তর দিকের দেয়াল ঘেঁষে। এরপরেই পাশাপাশি একটা বাথরুম আর একটা টয়লেট। আমার বড় মামার বড় মেয়ে, সপ্না আপু। ওর বিয়ের সময় জামাই আসার আগে আমি নিজ হাতে সেই টয়লেট পরিষ্কার করেছিলাম। যদিও তার জন্য আমার অন্যান্য আপুদের আমাকে অনেক অনেক প্রসাংশা করতে হয়েছিল। এতো প্রসাংশা সহ্য করতে না পেরে আমিও রাজি হয়েছিলাম। সেই টয়লেটের পরেই ছিল ঘাসে ঢাকা দারুন সুন্দর এক লন। এই লন অভিজাত এলাকার লন নয়। এই লনে মুরগি, হাঁস, ছাগল, গরু সব ঘুরত। এদিক ওদিক তাকালে তাদের টাটকা বা শুকনো বিস্টাও চোখে পড়ত। লনটা ছিল উত্তর দিক দেয়াল ঘেঁষা। আর শেষ হয়েছে আমাদের বাড়ীর পশ্চিমের সীমানা দেয়ালের কাছে। লনের মাঝামাঝি আর দক্ষিন দিকের সীমানা দেয়ালের পাশ থেকে ৬/৭ ফুট পায়ে চলার মাটির রাস্তা রেখে অসম্ভব সুন্দর টলটলে এক পুকুর। ছোট ছোট মাছে ভরা। সেই পুকুরের পশ্চিমেও ছিল আরও একটা মেঠো পথ। আর পথের উপর থেকে বেঁকে গিয়ে পুকুরের অর্ধেক পর্যন্ত ছিল আমাদের সেই সময়কার “ট্রি-হাউজ”। বড় একটা আমগাছ। আমি আর আমার পিঠাপিঠি বোন, স্নিগ্ধা আপু...আমাদের দুজনেরি খেলার অন্যতম পছন্দের জায়গা ছিল সেটা। সেই আমগাছের পাতার নিচে লুকিয়ে থাকলে বাইরে থেকে বঝা যেতোনা। সেই আমগাছের উপর থেকে বেহিসেবিবার লাফিয়ে পড়েছি আমাদের পুকুরে। আহ কি আরাম ছিল ওই সময়টার মধ্যে.....
আর পুরো বাড়ীর ঠিক মাঝখানে ছিল বিশাল কাঠের এক দোতালা বাড়ি। বাড়ীর দরজা ছিল দুইটি। একটা সামনে আর একটা পিছনে। পেছনের দরজাটা সেই লনের সাথে। মাটি থেকে প্রায় ৩ ফুট উপরে শুরু হয়েছে নিচ তলার মেঝে। সেই কারনে ঘরে ঢোকার প্রধান ফটকে একটা চমৎকার সিঁড়ি। দুই দিকে বসার ব্যবস্থাসহ রাজকীয় সিঁড়ি। সিঁড়ি বেয়ে উঠলেই লম্বা একটা বসার ঘর। যার পূর্ব দিকের পাশে একটা বড় খাট এবং পশ্চিম দিকের পাশে একটা ছোট খাট। এই ছোট খাটটাই ছেলেবেলায় ছিল আমার দখলে। পুরো বাড়িতে ঘর ছিল মোট তিনখানা ঘর। সবগুলো ঘরের সাথে ছিল একটা করে জানালা। লোহার রডের জানালা। ঘরের পেছন দিকে ছিল মামির রসুই ঘর। এই ফাঁকে একটা কথা বলে রাখি, আমার জন্ম এই বাড়িতেই। আমার জন্মের কিছুদিন পরেই জন্ম হয় আমার এক মামাতো বোন, স্নিগ্ধার। বয়সে সে আমার তিন চার মাসের ছোট হলেও বাচ্চা বয়স থেকে আমি জানতাম যে সে আমার চেয়ে বয়সে বড়। তাই ওকে ছেলেবেলা থেকেই আমি স্নিগ্ধা আপু বলে ডাকতাম।
ওই সময় আমার খেলার সাথি ছিল আমার মামাতো ছোট ভাই বিভাস আর ওর মামাতো ছোট ভাই বনি। বিভাসই ছিল আমার সবচেয়ে কাছের। আমি যেটা করতাম ও সেটা বিনা বাক্য ব্যায়ে মেনে নিয়ে আমাকে অনুসরণ করত। আমার কঠিন আজ্ঞাবহ ভাই। আমার সবচেয়ে কাছের। আমার নিজের মায়ের পেটের কোন ভাই নেই। এখন যদি ভাই শব্দটা মনে করি, তো সাথে সাথে আমার বিভাশের কথাই মনে হয়। ওর চেহারাই চোখের সামনে ভেসে ওঠে। স্নিগ্ধা আপু জন্মের পর আমার আম্মা একবার হঠাৎ করে নাকি দারুন অসুস্থ হয়ে পড়েন। এতো অসুস্থ যে আমাকে উনি বুকের দুধও খাওয়াতে পারতেন না। তখন আমার মামি একই সাথে আমাকে এবং স্নিগ্ধা আপুকে ওনার বুকের দুধ খাইয়েছেন। সেই হিসেবে মামি আমার দুধ মা এবং বাকিরা সবাই আমার দুধ ভাই বোন। পলাশ দাদা আমার বড় দুধ ভাই। তারপর সপ্না আপু, শান্তা আপু, স্নিগ্ধা আপু এবং সর্বশেষে আমার ভাই বিভাশ। অতি বেশি ছোট করে আমার ছোট্ট বাড়ি আর পরিবারের কথা বললাম। কারন এরা সবাই একটা সময় আমার জীবনের একটা অবিছেদ্দ অংশ হয়ে গিয়েছিলো। অতি কৃতজ্ঞ চিত্তে আমি আমার অংশদের কথা স্মরণ করছি।
আমার বড় মামা ছিলেন পরিবার প্রধান। মামা চাকরি করতেন খুলনা সিটি কর্পোরেশনে। আমার মামার সাথে আমার আম্মার দূরত্ব ছিল দেখার মত। কেউ কারো সাথে কথা পর্যন্ত বলতেননা। আম্মা বলতেননা ভয়ে আর মামা রাগে। আম্মা ছেলেবালায় ছিলেন অসম্ভব ব্রিলিয়ান্ট। আম্মাদের সময় ক্লাস ফাইভ, সিক্স এবং ক্লাস এইট, এই তিন ক্লাসেই বৃত্তি পরীক্ষা হতো। আম্মা তিন ক্লাসেই ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পান এবং তারচেয়েও আশ্চর্যজনক বিষয় হোল আমার আম্মা সেই তিন ক্লাশের বৃত্তি পরীক্ষাতেই পূর্ব এবং পশ্চিম, দুই পাকিস্তানের ছেলে মেয়েদের মধ্যে ১ম হন। অবিশ্বাস্য। আমার আম্মার এই অবিস্মরণীয় রেজাল্টের কারনে আমাদের গ্রামে তার নামে একখানা ইস্কুলের নামকরন হয়। ইশকুলখানা এখনও আছে।
মামা আম্মার সমস্ত কিছু দেখশোনা করতেন। আম্মার এইরকম অস্বাভাবিক রেজাল্টের কারনে সেই সময় বাগেরহাট গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা (পরবর্তীতে ডি.ডি. এডুকেশন খুলনা) আম্মাকে বিনা বেতনে আবাসিক সুবিধাসহ বাগেরহাটে নিয়ে আসেন। বাগেরহাট তখন জেলা শহর। আম্মার মুখেই শুনেছি, মামা তখন গ্রাম থেকে আম্মার সাথে দেখা করতে আসতেন। ঘিয়ের বয়ম হাতে নিয়ে মামা দাড়িয়ে থাকতেন গার্লস হোস্টেলের গেটে। নিজের প্রায় সমস্ত পরিশ্রমের অনুপ্রেরণা ছিল বড় আদরের ছোট বোন। মামার ইচ্ছে ছিল বোন তার ডাক্তার হবে। কিন্তু নিজস্ব কিছু ভুল সিদ্ধান্তের কারনে অকালে ঝরে যেতে হয় আম্মাকে। মন ভেঙে যায় বড় মামার। সেই যে কথা বন্ধ করলেন আম্মার সাথে আর বলেননি। বড় অভিমানী পরিবার আমার।
সেই অভিমানী পরিবারকে সাথে নিয়ে দারুন দারুণ সব স্মৃতিতে কাটতে লাগলো আমার দুরন্ত শৈশব। কি ছিলোনা সেই শৈশবে। সব, সব কিছু ছিল সেখানে। অতি মাত্রায় ছিল। শুধু ছিলোনা আমার বাবা। মাঝে মাঝে মনে হত একটা পার্মানেন্ট বাবা থাকলে দারুন হত। সারাদিন আমি বাঁদরামি করে রাতে বাবার কাছে সেই সব গল্প করতাম। বাবা দারুন অবাক হয়ে শুনতেন সেই সব দুঃসাহসিকতার গল্প। কিন্তু আসলে কেউ ছিলোনা সেই সময়। আম্মা ছিলেন। সব ভালোবাসা নিয়ে ছিলেন। কিন্তু বাবা ছিলেননা। ছিলেননা বলাটা ভুল হবে। ছিলেন, তবে অনেক দুর দেশে। মরুভুমির মাঝে। সেও হয়তো তার সন্তানের কথা চিন্তা করতো। ছেলের মাথাটা বুকের মাঝে রেখে ছেলেকে গল্প বলতে বলতে হয়তো নিজেই ঘুমিয়ে পড়তো। কিন্তু বাস্তবে ছেলে সারাদিন দুস্টমি করে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়তো রাতের কোলে। রাত, বড় নিঃসঙ্গ সহচর।
বিভিন্ন দুস্টমির কারনে প্রায় প্রতিদিনই কপালে উত্তম মাধ্যম জুটতো। একবার বাঁদরামির পরিমান অতি বেড়ে গেলো। বয়স তখন সম্ভাবত ৬/৭ বছর হবে। আম্মা ছিলেন অফিসে। আমার তখন অনুমতি ছিল বাসার আশেপাশে অথবা সর্বচ্চ বড় মামাদের বাসা। সেখানে হঠাৎ করেই এলাকার এক বন্ধুর প্রলোভনে প্রলুব্ধ হয়ে চলে গেলাম স্টেডিয়ামে ফুটবল খেলা দেখতে। স্টেডিয়াম আমার বাসা থেকে অনেক দূরে। ছোট সাইজের কারনে বিনে টিকেটে খেলা দেখেছিলাম। সেটা ছিল আসলে এক বিরাট দুঃসাহস। জীবনে প্রথমবার স্টেডিয়ামে খেলা দেখার সময় মনেই ছিলোনা পরের অবস্থার কথা। সন্ধায় বাসায় ফিরে দেখি আম্মা তখনো আসেননি। ওই সময় আম্মা একটু দেরি করে বাসায় ফিরলে আমি আমাদের বাড়ীওয়ালার বাসায় থাকতাম। সেই সন্ধায় ছোট্ট আমি মনের আনন্দে সবাইকে বলে ফেললাম আমার স্টেডিয়ামে গিয়ে খেলা দেখার বিষয়টা। সবাই অবাক। বুঝলাম, আমি না বললেও আম্মার কানে যাবে এই কথা। ভয়ে জমে গেলাম। আম্মা অসম্ভব রাগি। আব্বা বিদেশে চলে যাওয়ার পর তার রাগটা আরও বেড়ে গেছে এবং আমার তখন বদ্ধমূল ধারণা যে, সেই রাগ শুধু মাত্র আমাকে তীব্র মাইর লাগালেই কমে। আমার স্পষ্ট মনে আছে, আম্মা আমাকে এতো মারতেন এতো মারতেন যে, সেই মার খাওয়ার মধ্যে আমি বারবার বলতাম পানি খাবো। আম্মা তখন পানি দিতেন। ওই পানি খাওয়ার সময়টুকু মার বন্ধ থাকতো। তারপর আবার শুরু।
মাইর খাওয়ার ভয়ে আমি খুব মজার একটা কাজ করে ফেললাম। একই দিনে জীবনের দুইটা কাজ প্রথমবার করা। একঃ স্টেডিয়ামে গিয়ে খেলা দেখা, দুইঃ নিজে নিজে বাবাকে একটা দারুন চিঠি লিখে ফেলা। চিঠিতে কি লিখেছিলাম তা পুরপুরি মনে নেই। তবে মার খাওয়ার আশঙ্কার কথা ছিল। ছিল কিছু অভিমানী কথা। লিখেছিলাম, আজ যদি আব্বু এখানে থাকতেন তাহলে অবশ্যই এতো চমৎকার এক দুঃসাহসী কাজের জন্য আমাকে মার খেতে হতনা। আম্মা সাহসিই করতেননা। আব্বা ছিলেননা। কিন্তু দারুন ব্যাপার হোল আমি সেদিন মার খাইনি। চিঠিটা হাতে নিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল আম্মা যদি চিঠিটা দেখেন তাহলে নিশ্চয়ই আব্বার ভয়ে আর মারবেননা। আম্মা পড়েছিলেন সেই চিঠি। সেদিন রাতে ঘুমন্ত আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার মায়ের সেই আকুল হয়ে কাঁদার স্মৃতি আমার স্পষ্ট মনে আছে। আমি ওই রাতেই আমার মাকে আমাকে মারা সমস্ত মারের জন্য ক্ষমা করে দিয়েছি। আমার বাবাকে লেখা সেই চিঠি কখনো পোস্ট হয়নি। এখন মাঝে মাঝে মনে হয়, আমার আম্মা তার জীবনে একটা বড় ভুল করেছিলেন ওই চিঠিটা আব্বাকে পোস্ট না করে। আব্বা যদি কোনদিন সেই ছোট্ট আমার তাকে উদ্দেশ্য করে লেখা প্রথম চিঠিটা একবার পড়তেন তাহলে সে কনদিন আমাকে ফেলে বিদেশে থাকতে পারতেননা। কোনদিনও না। আমি পরম নিশ্চিন্তে আমার একপাশে আমার বাবা আর একপাশে আমার মাকে নিয়ে ঘুমাতাম।
জাতিস্মর, অনেকক্ষণ ধরে সব ভারি ভারি কথা বলছি। নিজেরই কেমন অসস্থি হচ্ছে। এবার একটু হাল্কা গল্প বলি। ওই যে বলেছিলাম, যে আমার বাবার সাহসিকতা নিয়ে একটা মজার গল্প বলবো। এখন সেটাই বলছি।
সময়টা আমার এস.এস.সি. পরীক্ষার ৩ মাস আগের। আমার বাবা থাকতেন মধ্যপ্রাচ্য এর কোন এক দেশে। দীর্ঘদিন মরুভূমিতে থাকার পরেও কেন জানি ওনার মনটা বালি হয়ে যায়নি। তাই হঠাৎ করেই স্ত্রী, পুত্র-কে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য ছুটে আসলেন বাংলাদেশে। আমার বাবার স্ত্রী মানে আমার শ্রদ্ধেয় আম্মা (আল্লাহতালা ওনাকে দীর্ঘজীবী করুন) কিন্তু বেজায় শক্ত মানুষ। লৌহ মানবী। মেয়েদের বিষয়ে একটা কথা ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছি, গায়িকা শেহরিন তো সুরে সুরে আরো চমৎকার করে বলেছেন যে, “ বুক ফাটে...মূখ ফোটেনা”। আম্মার বিষয়টা আরো গভীর। আমরা বাপ-বেটা পুরোপুরি কনফিউজ ছিলাম যে, আম্মার কোনটা বেশি ফাটে বা ফোটে। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, ছেলেবেলাটা আমার কেটেছে কি বিপুল আতংকে। আর আমার বাবার তো “সুপার আতংকে”। সুপার আতংক আসলে আমার নামকরণ এবং বংশ পরক্রমায় সেটা আমি পেয়েছি (দয়া করে তুমি ভেবনা যে, আমি আমার স্ত্রীকে দোষ দিচ্ছি। ব্যাপারটা আসলেই বংশীয়)।
আবারো গল্পে ফিরি। পড়তাম খুলনা পাবলিক কলেজ-এ। প্রত্যেক বছর আমাদের শিক্ষা সফরে নিয়ে যেত ইস্কুল কর্তৃপক্ষ। ওই বছরটাতেই কি কারনে যেন শিক্ষা সফরের আয়োজন করা হয়নি। আমরা তখন ইস্কুলে মোস্ট সিনিওর ভাই। সুতরাং এস.এস.সি. পরীক্ষার আগে আমাদের কতিপয় দুষ্ট ছেলের ভালো রেজাল্ট করার প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে ইস্কুল কর্তৃপক্ষ রাজশাহিতে আমাদের শিক্ষা সফরের বাবস্থা করেন। এস.এস.সি. পরীক্ষার ঠিক তিন মাস আগে। আমরা তখন দারুন উত্তেজিত। কিন্তু লৌহ মানবী (মতান্তরে অত্যাচারিণী) আমার মা সেই উত্তেজনায় এক বোতল ঠাণ্ডা পানি ঢেলে দিলেন। লৌহ মানবীর ভাষ্য, “সারা বছর কোন লেখাপড়া করোনি। এখন এস.এস.সি-এর ৩ মাস আগে আবার শিক্ষা সফর? ইম্পসিবল”। ঘটনা সত্য।
প্রায় ১৫ দিন অক্লান্ত চেষ্টার পরও আমার লৌহ মানবী মায়ের মেজাজের লোহায় এক ফোঁটাও জং ফেলতে পারিনি। তাই শিক্ষা সফরের তিন দিন আগে শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে অনেক আশা নিয়ে লবিং করার চেষ্টা করলাম আমার বাবার কাছে। বাবা পুরো ব্যাপারটা জেনে আমার চেয়েও ভিত গলায় বল্লেন, “বাবা এই আইডিয়াটা বাদ দাও। সবাই মিলে বিপদে পড়ার কোন কারন দেখিনা”। শেষবার চোখ এবং নাকের আশ্রয় নিয়েও কোন লাভ হলনা। নোনতা স্বাদটা নিজের ভেতর রেখেই ভগ্ন হৃদয়ে বন্ধুদেরকে আমার না যাওয়ার বিষয়টা জানিয়ে দিলাম। দুইদিন ঘর থেকে বের হইনি। এই দুইদিনে কয়েকবেলা খাওয়াও বন্ধ করে দিয়েছিলাম। তারপরও রেজাল্ট একই। আমার শিক্ষা সফর যাওয়া বাতিল। একবার ইচ্ছে করেছিল পালিয়ে যাই। কিন্তু পর্যাপ্ত অর্থ এবং সাহসের কারনে সেটা সম্ভব হয়নি। আসল ঘটনার শুরু এখান থেকেই।
শিক্ষা সফরের দিন খুব ভোরে আজানের পরপরই আব্বু আমাকে ডেকে তোলেন। ঘুম থেকে উঠে আব্বুর চেহারা দেখেতো আমার আত্মারাম খাঁচা ছাড়া অবস্থা। মারাত্মক রকমের গম্ভীর চেহারা ছিল সেই সময় আব্বুর। প্রশ্ন করলেন...
...তোমার শিক্ষা সফরের ট্রেন ছাড়বে কখন?
ভীত কণ্ঠে জবাব দিলাম...
...আব্বু, সকাল ৮.৪৫-এ।
বাবা আরো গম্ভীর কণ্ঠে বল্লেন...
...যাও, গোসল করে আসো। তোমার পড়ার টেবিলের উপর ২ সেট নতুন জিন্স প্যান্ট এবং শার্ট আছে। গোসল করে, নতুন কাপড় পরে, ব্যাগ গুছিয়ে বন্ধুদের সাথে যাও।
আমার খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু পেলাম ভয়। ভয়ে ভয়ে আদেশ পালন করে নতুন জামা কাপড় পরে আসলাম বাবার সামনে। দেখি উনি অলরেডি আমার ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছেন। আমার হাতে চাঁদা বাবদ ৩৫০ টাকা আর হাত খরচের জন্য আরও ৩০০ টাকা দিলেন। আমার ভয় তখনও কাটেনি। আবারো অনেক ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম...
...আব্বু ... আম্মুর পারমিশনটা?
আব্বু এবার বজ্র হুঙ্কার দিয়ে বল্লেন...
...তোমার আম্মু কি পেয়েছেন যে, কারো কোন ব্যাক্তিগত ইচ্ছা পুরন হবেনা? উনি যেমন তোমার মা, একইভাবে আমিও তোমার বাবা। আজ থেকে এই বাসায় আমার কথার উপর আর কারো কোন কথা চলবেনা।
মারহাবা...মারহাবা...মারহাবা...
এতো খুশি হয়েছিলাম সেদিন যে নাচতে ইচ্ছে করছিল। যত খুশি শিক্ষা সফরে যাওয়ার জন্য, তার চেয়েও বেশি খুশি হয়েছিলাম বাবার
বজ্রহুঙ্কার এর জন্য। ঘর আজ থেকে পুরুষ শাসিত। ওয়াও... আমার বোকাসোকা ভালোমানুষ বাবাটা যে আদতেই এত সাহসী এটা চিন্তা করেই আনন্দে লাফালাফি আবস্থা আমার।
যথারীতি আমার বন্ধুরা আমাকে রেলস্টেশনে দেখে জারপরনয় খুশি। অসম্ভব সুন্দর ৪টা দিন আর রাত আমরা একটা স্বপ্নের ভিতর দিয়ে গেছি (সেই গল্পগুলোও শোনাবো একদিন)। ৪টা দিন স্বপ্নের রাজ্য থেকে আম্মু, আব্বুর জন্য এত্তগুলো গল্প নিয়ে যখন বাসায় ফিরেছি, দেখি বাড়ি ভর্তি লোকজন। আমাকে দেখে সবাই যেন চাঁদ হাতে পেলো। অজস্র প্রশ্ন। কোথায় ছিলে, কে কে সাথে ছিল, কেন ইত্যাদি। আমিতো হতভম্ব। দৌড়ে ঢুকলাম লৌহ মানবীর ঘরে। লৌহ মানবী শয্যাশায়ী। পুরোই শিমুল তূলার মতো নরম। আমাকে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন মা।
...বাবা তুই কোথায় ছিলি? তোর বাবা কোথায়?
আমার চিন্তাশক্তি তখন পুরোপুরি ঘোলাটে। অনেকক্ষণ পর সব কিছু বুঝতে পেরে আমি ফিক করে হেঁসে ফেললাম। মাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, কোন টেনশন করোনা মা। আমি চলে এসেছি এখন আব্বুও চলে আসবেন। হোলোও তাই। সন্ধ্যার সময় হাতে একটা সিগারেট, সাদা পাঞ্জাবীর উপর একটা ঊলেণ শাল আর প্যান্ট পড়ে মারাত্মক লাজুক চেহারা করে অপরাধীর মতো আব্বূ ঢুকলেন মায়ের ঘরে।
মূল ঘটনা কি আপনারা বুঝতে পেরেছেন?
মূল ঘটনাঃ
আমার বোকাসোকা ভালোমানুষ বাবা তাঁর ছেলের কষ্টটা অনুধাবন করেছিলেন। কিন্তু ভয়ও কাজ করছিলো তাঁর ভেতর। এই ভয়ও একধরণের ভালোবাসা। প্রচণ্ড ভালোবাসা। প্রচণ্ড ভালোবাসা বা ভয় শুধুমাত্র কাজ করে নিজের সবচে ভরসার আশ্রয়স্থলে। যাইহোক, সকালবেলা আমাকে শিক্ষা সফরে পাঠানোর উদ্দেশে যখন বাবা আমার ব্যাগ গুছিয়েছিলেন ঠিক একই সময়ে বাবা ওনার ব্যাগটাও গোছাতে ভোলেননি। আমাকে বাসা থেকে বিদায় দেয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে বাবাও ওনার ব্যাগেজ নিয়ে বেড়িয়ে পড়েছিলেন। আর ফলশ্রুতিতে, মা আমার সকালে উঠে বাবা/ছেলে কাউকে না পেয়ে আতঙ্কে অস্থির হয়ে শয্যাশায়ী।
আমার কিন্তু আর কখনো কোথাও যেতে বাসা হতে সমস্যা পোহাতে হয়নি। তখন খুব অবাক হয়তবা একটু কষ্টও পেয়েছিলাম, বাবার আচারণে। কিন্তু এই পরিণত বয়সে এসে যখন নিজের সন্তানের ইচ্ছে, খুশিগুলোর দিকে তাকাই তখন মর্মে মর্মে অনুভব করি বাবার স্নেহ আর ভালোবাসা। আপনা আপনি ঠোঁটে থাকে একটা হাসি আর চোখে সেই জল। এই ঘটনার দেড় মাস পরেই আব্বু আমাদের ছেড়ে চলে যান সেই না ফেরার দেশে। লৌহ মানবীও সেই শোকে তার লোহার খোলস ছেড়ে বের হয়ে আসেন। আমি অনেকদিন দেখেছি, মা আমার সব ভুলে কবরস্থানে গিয়ে সারাদিন বাবার কবরের পাশে বসে কবিতা শোনাচ্ছেন। কখনো রবিন্দ্রনাথ তো কখনো জীবনানন্দ।
আমি জানিনা, না ফেরার দেশে গেলে মানুষ কবিতা উপভোগ করতে পারেন কিনা। জানিনা এতো ভালোবাসা যে সন্তানের জন্য তাকে উদ্দেশ্য করে সেই না ফেরার দেশে গিয়ে বাবারাও কবিতা বলেন কিনা। যখন জগৎ সংসারের এই স্বার্থপর যুদ্ধের ময়দানে যুদ্ধক্লান্ত একজন সৈনিক হিসেবে ঘুমিয়ে পড়ি, তখন সেই ঘুমন্ত আমিকে ছুঁয়ে যাওয়া কোন ঠাণ্ডা বাতাসের পরশ আমার বোকাসোকা ভালোমানুষ বাবা পাঠান কিনা, তাও জানিনা। শুধু জানি খুব কঠিন কিছু শিক্ষা খুব সহজ করে বাবা আমার, আমাকে দিয়ে গেছেন। না, আমার জন্য নয়। তাঁর অতি আদরের নাতীর জন্য। আমি সর্বক্ষণ চেষ্টা করি তাঁর সেই শিক্ষায় নিজেকে আর আমার আদরের ধন দাদার নাতীকে শিক্ষিত করতে। সময় খুবই কম। আমি জানি, এই স্বপ্নের জগৎ ছেড়ে আমাকেও একদিন পাড়ি জমাতে হবে সেই না ফেরার দেশে। তাই বাবার জন্য এত্তগুলো গল্প তৈরি করে রেখেছি। কোন একদিন হয়তো সেই গল্পগুলোও তোমাকে শোনাবো।
(চলবে...)