মহি এবং...(অনিয়মিত পার্ট)
একঃ
আজ হঠাৎ করে একটা চিঠি পেলাম। কেউতো আজকাল আর চিঠি লেখেনা। মোবাইলের এস.এম.এস., ই-মেইল, ফেইসবুক, টুইটার আরও কত কি...। তাই এই সময়ে চিঠি পেয়ে আমি জারপর নই অবাক। ঘরের বাইরের বিউটিফিকেসনের জন্য একটা মেইল বক্স রেখেছি। কোন একটা পুরনো ইংরেজী সিনেমায় এরকম একটা মেইলবক্স দেখেছিলাম। সেটা ছিল খুব সম্ভাবত একটা ওয়েস্টার্ন মুভি। বিশাল বড় পাহাড়ি ভ্যালীর মাঝখানে খুব চমৎকারকাঠের বাড়ি। দেখলেই আরাম লাগে এমন বাড়ী। বাড়ীর চারিদিকে কাঠের ব্যাড়া। সেই বাড়ীতে ঢোকার যে গেট, সেটাও কাঠের। আর গেটের বাইরে একটা ছোট্ট মেইলবক্স। তেপায়ার ওপর দাঁড়ানো। অমন বাড়ী আমার স্বপ্নে অনেক আছে। বাস্তবে তাই শুধু ছোট্ট এক মেইলবক্স বানিয়ে ঘরের বাইরে ঝুলিয়ে দিয়েছি। যেহেতু চিঠি আসার কোন সম্ভাবনা আর জীবিত নাই তাই ডেকোরেশনটা আর একটু সুন্দর করার জন্য আমার বউ সেই মেইলবক্সের ভেতর দিয়ে একটা মানিপ্লান্ট গাছ লাগিয়ে দিয়েছে। নিয়মিত গাছের যত্ন নেয়া হয়, পানি দেয়া হয়। যার কারনে আমার সাধের মেইলবক্সের ভেতরে কিছু কাঁদা পানি জমে থাকে। বাইরে থেকে বোঝা যায়না। আজই প্রথম বুঝলাম। ডাকপিয়ন ঠিকানা দেখে চিঠি রেখে গেছে চিঠির বাক্সে। সন্ধায় ঘরে ঢোকার সময় দেখি একটা সাদা, মোটা, চারিদিকে লাল বর্ডার দেয়া খাম অর্ধেক আমার মেইলবক্স থেকে বের হয়ে আছে। আমার চিঠির বাক্সে প্রথম চিঠি। তাও আবার বিদেশ থেকে। রানির মাথার চুরি করা কোহিনূর আমার বাংলার কাঁদায় ঢেকে গেছে।
আমার বউ অবাক হোল আমার চেয়েও বেশি। মুখটা দেখি বেশ হাসিখুশি। কিন্তু সেই হাসিখুশি চেহারার মাঝেও আমি ঠিকিই চিনচিনে একটা দুশ্চিন্তা দেখতে পাই। এটা আবার সবাই দেখতে পাবেনা। আমি হাসতে হাসতে বললাম, পরী..এখনো আমার ডিম্যান্ড দেখো। কত মোটা চিঠি। এদিকে কৌতূহলে আমার নিজেরি অবস্থা খারাপ। কোনমতে জামাকাপড় বদলে, একটু ফ্রেশ হয়েই খামটা নিয়ে বসলাম। বউও দেখি গুটিসুটি মেরে আমার পাশে এসে বসলো। ধীরে ধীরে খাম খুলে চিঠি বের করলাম। আমি চিন্তাও করিনি যে চিঠি পাঠিয়েছেন মাহি ভাই। সেই লন্ডন থেকে। আর এটাকে ঠিক চিঠি বলা যাবেনা। উনি আসলে প্রায় ১৫/২০ পাতার একটা লেখা পাঠিয়েছেন। এক বসাতেই লেখাটা আমি পড়েছি। লেখাটা পড়ে কখনো হেসে উঠেছিতো কখনো চোখে পানি টলমল করে উঠেছে। তবে যেটা আমাকে নাড়িয়েছে সেটা হোল, আমি আমার ভেতর একধরনের তীব্র শূন্যতা অনুভব করেছি। মাহি ভাইয়ের মুখে গল্প শোনার সময় আমার ভেতর এমন শূন্যতা কখনো কাজ করেনি। উনি অবশ্যই অনেক ভালো লেখকও।
আমি কোন রকমের কাটছাঁট না করে সেই লেখাটা হুবাহু তুলে দিলাম....
“হঠাৎ মনে হলো ঘটনাটা লিখে ফেলি। মনে হবারো একটা বিশেষ কারন আছে। সেটা এই মুহূর্তে বলতে ইচ্ছে হচ্ছেনা। তাহলে হয়তো মনে হবে আমার এই লেখাটা কারো লেখা থেকে প্রভাবিত। নিজের কাছে আমি নিজে বিশাল। যদি লেখা শেষ হতে হতে মনে হয় তাহলে কারনটা বলে ফেলবো।
ঘটনাটা খুব সাধারনঃ
আমার আম্মা সরকারী চাকুরে। টি এন্ড তি-তে অপারেটর। বেতন তখন কত জানিনা। বাবা থাকেন বিদেশে। প্রমান হিসেবে আমার কাছে তখন বেশ কিছু রাবার (এখন বাচ্চারা বলে ইরেজার), পেন্সিল কাটার আর পেন্সিল। সাথে বাবার বিদেশ যাওয়ার স্মৃতি।
স্মৃতিটাও বেশ মজার। তখন আমার বয়স বড়জোর ৬/৭ বছর। হঠাৎ করেই শুনলাম বাবা বিদেশে যাবেন। সেই সময় বিদেশ যাওয়াটা ছিল খানিকটা স্বপ্নের মতন। সেই যাওয়াটা বিদেশে ঘুরতে যাওয়ার মতো হলে অন্য বিষয়। কিন্তু আমাদের মতো পরিবারের লোকজন বিদেশ যেতো শুধুই ইনকামের জন্য। অর্থ উপার্জন। যে ভদ্রলোক যাবেন তাঁর মানসিক অবস্থার কথা কেউ কি চিন্তা করতো? তাঁর আসলেই যেতে ইচ্ছে করছে কিনা? সেটা জানিনা। তবে যেটা হতো, সেই বিদেশগামি মানুষটার পরিবার কোন একদিন সকাল থেকে সমাজে পেতো একটা আলাদা মর্যাদা। কারন দুইটা, এক- আশা করা যায় যে এই পরিবার এখন থেকে আরও বেশি সচ্ছলাতার মুখ দেখবে, দুই-এই মানুষটার মাধ্যমে হয়তো অন্য কোন পরিবারের আরও মানুষ বিদেশে যাওয়ার সুযোগ পাবে। কারন যাই হোক অথবা সেই মানুষটার মানসিক অবস্থা যাই হোকনা কেন, সেই বিদেশগামি মানুষটার আত্মীয়, স্বজন, বন্ধু, বান্ধব, পাড়াপ্রতিবেশি সবাই বেশ আনন্দের একটা সময় পার করতো। কিভাবে যে যাওয়ার সময় চলে আসতো কেউ বলতে পারতোনা।
তাই আমারও ব্যাপক আনন্দ। সেই সময়টাই আনন্দের। শুধু একটা উপলক্ষ দরকার। উপলক্ষ পেলেই আনন্দে দিন পার। বাবা, গোছগাছ শুরু করলেন। আম্মা মাঝে মাঝে একটু কাঁদেন আবার আব্বুর ব্যাগ গোছানোয় ব্যস্ত হয়ে পরেন। এভাবে কয়েকদিন চলতে চলতেই মহা আনন্দের খবর চলে আসলো। আমি আর আম্মা আব্বুকে প্লেনে তুলে দেওয়ার জন্য ঢাকায় যাবো। আমি আনন্দে ধেই ধেই করে, হই হই করে নেচে বেড়াচ্ছি। সেই আনন্দের মধ্যেই রওনা হলাম ঢাকার উদ্দেশে। খুলনা থেকে ঢাকা যেতে তখন প্রায় ১৮/১৯ ঘণ্টা লেগে যেতো। অনেকগুলো ফেরি পার হয়ে তারপর পৌঁছেতে হতো ঢাকায়। আর সেইসময়ের বাসগুলোও সেইরকম। মাঝঝখানে এক চিলতে করিডোর রেখে দুই দিকে দুইটা করে বসার সিট। শর্টকার্টে এখনকার ঢাকার লোকাল বাস। আমি বেশ কয়েকবার সেই বাসকে থামিয়ে যাত্রা আরও বিলম্বিত করেছিলাম। একবার বড় বাথরুম আর একবার ছোটটা।
আমাদের সেই পুরো ভ্রমনের বেশিরভাগ সময়িই (যতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলামনা) দেখেছি ফুসফুস করে আম্মা আব্বাকে কবিতা শোনাচ্ছেন আর আব্বা আম্মার হাতটা ধরে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছেন। কখনো কখন কবিতার কোন লাইন শুনে আব্বা আম্মার হাতটা ধরে খুব আবেগের সাথে আস্তে করে চেপে ধরছেন। একটা স্পর্শে আকুল হয়ে বিলিয়ে দিচ্ছেন তাঁর সমস্ত ভালোবাসা। ভালোবাসার মানে আমি তখনো বুঝিনি, এখনো বুঝিনা। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ ভালোবাসার সিনেমাটা তাইোতো সেদিন থেকে হয়ে গেলো ১৮/১৯ ঘণ্টার।
ঢাকায় এসে উঠলাম আব্বুর এক বন্ধুর বাসায়। বল্টু না যেন বিল্টু আংকেল। সেই বাসায় দুই দিন থেকে আমরা রওনা হলাম এয়ারপোর্ট-এর উদ্দেশে। বাহন বেবি ট্যাক্সি। এখনকার সবুজ রঙের সি.এন.জি.- না। সেই সময়কার হলুদ রঙের বেবি ট্যাক্সি। একটাতে আমি, আব্বা আর আম্মা। আরেকটাতে আব্বার বন্ধুরা। আমি আব্বার কোলে বসা। যথেষ্ট বিরক্ত। কারন উনি আমাকে শক্ত করে বুকের সাথে জড়িয়ে রেখেছেন। আমি ছিলাম অসম্ভব দুরন্ত। এক জায়গায় এতক্ষণ ঝিম মেরে বসে থাকা আমার কম্ম ছিলোনা। কিন্তু আব্বা কেন যেন আমাকে শক্ত করে ধরে রেখেছেন। অনেক শক্ত করে।
হঠাৎ করেই দেখি আব্বার বন্ধুরা যে বেবি ট্যাক্সিতে সেটা আমাদের ওভারটেক করে চলে যাচ্ছে। ওমনি আমি চিৎকার জুড়ে দিলাম আর সেই সাথে আমাদের বেবি ট্যাক্সির ড্রাইভারের পিঠে দুমাদুম কিল। আমি ফার্স্ট হতে চাই, আমি ফার্স্ট হতে চাই। আম্মা বেশ জোরে ধমক দিয়ে উঠলেন। আব্বা তার চেয়েও জোরে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। হতে পারে দু/এক ফোঁটা বা আরেকটু বেশি চোখের পানি তাঁর চোখ থেকে গড়িয়ে পড়েছিল। আমি টের পাইনি।
শেষ পর্যন্ত আমাদের বেবি ট্যাক্সি ফার্স্ট হয়েছিলো। আমরা পৌঁছেছিলাম বহুল আকাঙ্ক্ষিত এয়ারপোর্ট-এ। তখনকার এয়ারপোর্ট এখনকার মতো ছিলোনা। অনেক ছোট একটা এয়ারপোর্ট ছিল সেটা। একটাই টার্মিনাল। উঁচু। পাহাড়ের মতো উঁচু। সেই পাহাড়ি পথ বেয়ে বেবি ট্যাক্সি উপরে উঠলো। আম্মা আর আব্বা দুজন বেশ কিছুক্ষণ হাট ধরে দাড়িয়ে থাকলেন। আব্বা আমাকে কোলে নিলেন। কপালে, চোখে, মুখে দিলেন অনেকগুলো চুমু। আব্বার মোচ ছিল। বেশ খানদানি মোচ। সেই মোচের গুঁতো লাগায় আমি বারবার মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিলাম। বাবা তাতে একটুও গা করলেননা। আদর করতে থাকলেন। তারপর বারবার পেছনে ফিরতে ফিরতে গিয়ে ঢুকলেন এয়ারপোর্ট-এর পেটে। আমি তখন ব্যস্ত দুর থেকে প্লেন দেখায়। জীবনে প্রথম প্লেন দেখলাম সেদিন। হতচ্ছাড়া প্লেন কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিশাল দূরে নিয়ে গেলো বাবাকে। আমার আর মার কাছ থেকে অনেক দূরে। এতো দূরে যেখানে চিঠি পৌঁছুতেও লাগে ৩০ দিন।
(চলবে...)