অনামিকা চক্রবর্তীঃ
আমাদের সমাজে অনেক নারীকে পতিতা বা বেশ্যা হিসাবে আখ্যায়িত করা হয় । যদি তাদের শুচিতা কোনভাবে লঙ্ঘিত হয় । আমি বলব নারীর শুচিতা তো পুরুষের কারণেই লঙ্ঘিত হয় । সেখানে নারী তো এককভাবে একা একা নিজেকে অপবিত্র ও অশুচিতে রূপান্তরিত করে না, সেখানে পুরুষের ভূমিকা ৮০% । তাহলে সেসব পুরুষ যারা নারীকে পতিতা বা বেশ্যা বানিয়ে দিল তারা কেন পতিত বা বেশ্যা হল না? শুধু নারীকে পতিতা বা বেশ্যার লেবেল দিয়ে সমাজের আস্তাকুড়ে ফেলে দিয়ে তার মর্যাদা হরণ করা হল ? সব সময় নানা কায়দায় নানা ক্ষেত্রে নারীকে সমাজচ্যুত ও অচ্ছুৎ করে উপহাসের পাত্রে পরিণত করা হয় ।
তবে হা প্রথমে বলে নিতে চাই আমি অবশ্যই পতিতাবৃত্তিকে সমর্থন করছি না, কখনও করিও না বরং একটা নারীকে তার এই অপমানিত জীবন থেকে কিভাবে তুলে আনা যায় সেটা নিয়ে সমাজকে ভাবতে বলছি । এই সমাজে পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যেসব আইন বিধান করা হচ্ছে সবই তো পুরুষ কেন্দ্রিক । পুরুষের জন্যই নারীকে সাজানো হচ্ছে । অবশ্য নারী বিষয়ক কিছু আইন তৈরি হলেও সেটা অবলা নারীদের জন্য সেভাবে কার্যকর করতে কেউ এগিয়ে আসে না । কিছু কিছু ক্ষেত্রে কার্যকর হবার সম্ভাবনা তৈরি হলেও তা নানা হুমকি- ধুমকিতে বন্ধ হয়ে যায় । তাই অবলা নারীর আর অবলাদশা ঘুচে না ।
আমাদের দেশে যেসব নারীরা পতিসবৃত্তির সাথে জড়িত আছে বা কোনভাবে জড়িয়ে গেছে তাদের মধ্যে ৯৯ শতাংশই এ পেশা থেকে বের হয়ে আসতে চায় । তারা পুনর্বাসনের মাধ্যমে একটা সুন্দর ও সুস্থ জীবন ফিরে পেতে চায় । কিন্তু সমাজ তাদের জন্য সে অবস্থান তৈরি করে নি বরং পুরুষের মনোরঞ্জনের জন্য পতিতাবৃত্তিকে একটা পেশা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ফুটপাত থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের জন্য লাইসেন্সের ব্যবস্থা করে দেয় । আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন ছাত্রী যদি কোন হোটেলে পতিতা বৃত্তিকালে ধরা পড়ে যায় তখন তাকে হল থেকে বিতাড়িত করা হয় যদি না তার কোন প্রভাবশালী মহলের পৃষ্ঠপোষকতা থাকে ।
তাহলে দেখুন এখানে নারীকেই এই পেশায় যাবার জন্য লাইসেন্স দেয়া হচ্ছে । আবার এই নারীকেই যে কাজে লাইসেন্স দেয়া হল সে কাজ করার সময় ধরা পড়লে তাকে লাঞ্চিত করা হচ্ছে । মানে যত দোষ নন্দ ঘোষ । পুরুষের জন্যই নারীকে পতিতা বা বেশ্যা বানানো হচ্ছে আবার পুরুষের জন্যই তাকে সামাজিক ভাবে নিঘৃত করা হচ্ছে । পুরুষের সমস্ত চাহিদা জোগান দেয় সমাজ । তাদের পড়ার অর্থ থেকে শুরু করে বিকৃত যৌন চাহিদা নিবারণের খোরাক পর্যন্ত জুগিয়ে দিতে এতোটুকু কার্পণ্য নেই!! তাদের বৈধ- অবৈধ সমস্ত কিছুর জোগান দেয়ার দ্বায় এই সমাজের । আর তাদের সেই চাহিদা পূরণের জন্য নারীকে যত নিচে নামানো যায় ততই নিচে নামানো হয় ।
কোন নারী স্বেচ্ছায় এই পেশায় আসে না । তাদেরকে বাধ্য করে এই পেশায় আনা হয় । এই পেশায় কোন ভাবে জড়িয়ে পড়ার পর আর সুস্থ সমাজে ফেরার পথ তাদের থাকে না । অথচ যাদের মনোরঞ্জনের জন্য এসব নারীদের বলির পাঠা হতে হল তারা কিন্তু দিব্বি সমাজে নিজেরা সঠিক মর্যাদার সাথেই বসবাস করছে!
কোন পুরুষই চাপে পড়ে বা বাধ্য হয়ে পতিতার কাছে রাত্রী যাপন করতে যায় না । বরং সে নিজের ইচ্ছায় স্বতস্ফুর্তভাবে অবৈধ নারীসঙ্গ লাভের আশা নিয়ে যায় । কিন্তু অনেক পতিতা নারী আছে যাদেরকে জোর করে সেই পতিতাবৃত্তির পেশায় ঢুকিয়ে দেয়া হয় । “নিরন্তর” ছবির কাহিনী দেখলে দেখা যাবে নায়িকা কখনও বেশ্যাবৃত্তির সেই জঘন্য পেশায় যেতে চায় নি । কিভাবে যেন পরিবারের মানুষদের অভাবের তাড়নার কারণে এবং কৈশোরের লাঞ্ছনার কষ্ট বুকে নিয়ে এই পেশায় গিয়েছিল । কিন্তু সে বারবার ফিরে আশার আকুল আকাঙ্ক্ষা বুকে নিয়ে ছিল । কিন্তু ফিরে আশার সুযোগ তার পরিবার ও সমাজ তো তাকে করে দেয় নি বরং যখন তার এসব কুকৃত্তি জানাজানি হল তখন কিন্তু সমাজ ও পরিবারের মানুষগুলোও তাকে এড়িয়ে চলতে লাগলো । তাকে অচ্ছুৎ বলে ঘৃণা করতে লাগলো, বকাঝকা করতে লাগলো । কিন্তু্ল সে হোটেল বা রেস্তোরাঁয় রাত্রী যাপনকালে যেসব পুরুষ বারবার তার শুচিতা নষ্ট করেছে তাদেরকে কেউ কিন্তু সমাজে হেনস্থা করছে না বরং তারা যে অন্য নারীর অন্য দেহের স্বাদ আস্বাদন করে বেড়ায় মাঝরাতে ভেজা বেড়াল হয়ে সেটা কেউ জানেই না । বা জানলেও ‘পুরুষরা একটু এমনই হয়’ এই শ্লোগানের বদৌলতে ছাড় পেয়ে যায় । আর নতুন নতুন নারী দেহের স্বাদ আস্বাদন করে বেড়ায় প্রতি রাতে ।
যে পুরুষ নিজের ইচ্ছায় বারবার নারীর দেহে চষে বেরিয়ে যৌন চাহিদা মিটিয়ে নিজে আনন্দ-ফুর্তি করে করে সে কেন পতিত হল না? পতিতার সাথে রাত্রী যাপনকালে পতিতা নারীর শুচিতা নষ্টের সময় সে কি নিজের শুচিতা নষ্ট করে নি? তার কি অর্গাজম হয় নি? নিজের সমস্ত অর্গাজম ম্যাটেরিয়াল নারীর দেহে ঢুকিয়ে দেয়ার ক্ষমতা তার আছে বলেই কি সে পতিত নয় ? সেই কারণেই কি সমাজে পুরুষ বেশ্যা শব্দটা প্রচলিত নাই । সেই কারণেই কি বেশ্যা বা পতিতা শব্দটা নিত্য স্ত্রীবাচকই রয়ে গেছে । যত নষ্ট অপবিত্র শব্দ সব নারীর জন্য বরাদ্দ । পুরুষের জন্য একটা বাজে শব্দও সৃষ্টি হল না বাংলা সাহিত্যে?
নারী যেমন পুরুষের অর্গাজম ম্যাটেরিয়াল নিজের দেহে ধারণ করে সেরকম নারীর অর্গাজম ম্যাটেরিয়াল বহন করার মতো সিস্টেম পুরুষের শরীরে নেই বলেই কি ‘পুরুষ বেশ্যা’ সমাজে খুঁজে পাওয়া যায় না । অথচ পরিবারে পরিবারে খুঁজে দেখলে দেখা যাবে বাংলাদেশের অধিকাংশ পুরুষ জীবনের কোন না কোন সময় অবৈধ নারী সঙ্গ লাভের মাধ্যমে নিজের শুচিতা নষ্ট করেছে । দ্যা গার্ডিয়ানে প্রকাশিত গবেষণাধর্মী একটি আর্টিকেল “Why men use prostitutes” এ লেখক জুলি বিনডেল উল্লেখ করেন “যে প্রতি দশকে পতিতার কাছে যাওয়া পুরুষের সংখ্যা দিগুন হচ্ছে ।” তবে সমাজে অনেক ভাল পুরুষও আছে আমি অবশ্যই তাদেরকে ‘পবিত্রতম সুপুরুষ’ হিসাবে আখ্যা দিয়ে তাদেরকে এসব নোংরামির বাইরে রেখেছি । এক্ষেত্রে শুচিতা নষ্ট করা নারীর সংখ্যা পুরুষের চেয়ে অনেক অনেক কম হবে । তারপরও পুরুষের এতোটুকু সম্মানহানি হয় নি বীরদর্পে পরিবারে নিজের অবস্থান বহাল আছে ।
আর নারী নিজের ইচ্ছায় নয় বরং পরিবারিক বা সামাজিক নানা অবক্ষয়ের কারণে পতিতা হয়েছে । পুরুষের চাহিদা মেটাতে বেশ্যার লেবেল জোর করে তার কপালে তিলকের মতো সেটে দেয়া হল সে কিন্তু নিস্তার পেল না । এমনকি জীবনে কোন একবার যদি তার শুচিতার লঙ্ঘন ঘটে তাহলে সারা জীবন সেই দ্বায় তাকে বহন করে বেড়াতে হয় । এমনকি মৃত্যুর সময়ও তার জানাজা বা শবদাহের সময় লোক তার প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন করে তাকে বিদায় দেয় ।
আর পুরুষ যে বার বার নিজের শুচিতা নষ্ট করছে তার সেই শুচিতা নষ্টের মাধ্যমে তার লোমেরও কোন ক্ষতি হচ্ছে না । বরং পুরুষের অদম্য অবৈধ আদিম চাহিদা নিবারণের জন্যই সমাজের নানা জায়গায় ব্যঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে যৌনপল্লী । যেখানে নারীরা শুধু নারী সমাজ চ্যুত হয়ে পুরুষের অর্গাজম ম্যাটেরিয়াল বহন করে বেড়াবে । আর পুরুষ নিজের অর্গাজম ম্যাটেরিয়াল নারীর দেহে ঢুকিয়ে দিয়ে একটা পরিতৃপ্তির ঘুম দিবে । তারপর একবার গোসল করেই শুদ্ধ পরিশুদ্ধ হয়ে যাবে । যেন এতোটুকু অশুচিতার দাগ তার শরীরে লাগে নি । কারণ সমাজ নিয়ন্ত্রিত হয় পুরুষের চাহিদার জোগান ও সুবিধা তৈরির মাধ্যমে ।
পুরুষের প্রয়োজনেই নারীকে পতিতা বানানোর পর যদি তাদের পতিতা বা বেশ্যার লেবেল নিয়ে সমাজে আর মুখ দেখানর সুযোগ না থেকে থাকে তাহলে পুরুষ কেন পতিত হবে না ? তাদের অশুচিতার দ্বায়ে তাদেরকেও পতিত বা পুরুষ বেশ্যা হবার দ্বায়ে সমান পরিমাণ শাস্তির বিধান রাখা উচিৎ; তবে যৌন সংক্রান্ত এই পতিতাবৃত্তি বা অশুচিতার অবসান ঘটবে । নারীকে পতিতাবৃত্তির লাইসেন্স দিয়ে পুরুষের যৌন আকাঙ্ক্ষা অবৈধভাবে পূরণের ব্যবস্থা করে নারীকে শুধু অপমানিত করা হচ্ছে । এতে কখনও সমাজে শৃঙ্খলা আসবে না; এসেছে কি? বরং পতিতাবৃত্তি থেকে নারীকে বাঁচিয়ে এবং সামাজিক ও পারিবারিক নানা অবক্ষয় রোধের মাধ্যমে একটা নৈতিক মূল্যবোধ ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে । যেখানে পুরুষ নারীকে সম্মান করবে নারী পুরুষকে সম্মান করবে । আর একে অপরকে সম্মানের ভিত্তি হতে হবে নৈতিক ও সুন্দর চারিত্রিক গুণাবলী ।
লেখকঃ কলামিস্ট ও অ্যাক্টিভিস্ট
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ সকাল ১১:১৯