শারমিন আকতার
নারী জাতির বহু বছরের লাঞ্চনা, গঞ্জনা এবং অবহেলার বিষয়টা অনুধাবনের মাধ্যমে অনেকেই ধারণা করতেন এবং করেন যে পরিবার ও সমাজে সত্যিকারের মানুষ হিসাবে নিজেদের অধিকার ও মর্যাদা পেতে হলে নারীকে অবশ্যই অর্থ উপার্জনে সক্ষম হয়ে উঠতে হবে । অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে উঠলে নারীরা ধীরে ধীরে তার প্রাপ্য স্বাধীনতা অর্জন করতে পারবে। কিন্তু নারী মুক্তি আন্দোলনের প্রায় শত বছর পর এর ব্যতিক্রম রূপ আমাদের চোখের সামনে ধরা পড়ল । পরিবারে ও সমাজে দেখা দিল নানা অবক্ষয় । বিবাহ বিচ্ছেদ, স্বামী-স্ত্রীতে সারাক্ষণ কোন্দল লেগেই আছে । কেন এমন হচ্ছে?
নারীরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হলেও তাদের উপার্জিত অর্থ কি তারা ব্যয় করার স্বাধীনতা পাচ্ছে? নিজের উপার্জিত অর্থ নিজের পছন্দমত জায়গায় ব্যয় করতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা মেয়েদের আদৌ আমাদের পরিবার এবং সামাজগুলোতে রয়েছে কিনা সে ব্যাপারে কয়েকটা বাস্তব চিত্র দেখা যাক ।
কেস স্টাডি-১
নাদিরা পারভিন। একটি কলেজের লেকচারার । মাস শেষে প্রায় ২২ হাজারের মত টাকা পায় । তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে প্রতি মাসে তার বেতনের টাকা জমা হলে সে প্রতি মাসে শুধু চেকে সাইন দেয় । অর্থ ব্যয়ের স্বাধীনতা তার ঐ পর্যন্তই । সমস্ত টাকা তার হাজবেন্ড তুলে নেয় এবং নিজের পছন্দ মত খাতে ব্যয় করে । স্ত্রীর হাতে মাসে ৪-৫ শত টাকা তুলে দেয় তার রিক্সা ভাড়া বাবাদ ।নিজের জন্য কি, স্বামী-সন্তানকে কিছু গিফট দিতে চাইলেও তাকে স্বামীর কাছ থেকে চেয়ে নিতে হয় বা স্বামী এনে দেয় যদি তার মর্জি হয় । মেয়েদের হাতে টাকা থাকা উচিৎ নয়, এতে সমস্যা হয় নাদিরা পারভিনের স্বামীর বিশ্বাস । তাই সে তার পাওয়ার খাটিয়ে স্ত্রীর সমস্ত টাকা হাতিয়ে নেয় ।
কেস স্টাডি-২
মরিয়ম জামিলা ।ব্যাংক কর্মকর্তা । মাসে প্রায় ৪০ হাজারের মত বেতন সে পায় । সে আবার নাদিরা পারভিনের মত সমস্ত টাকা স্বামীর হাতে তুলে দিতে নারাজ । সে তার বেতনের পঞ্চাশ শতাংশ বেতন পাওয়া মাত্র স্বামীর হাতে তুলে দেয়ার চেষ্টা করে । আর বাকি পঞ্চাশ শতাংশের মধ্য থেকে কিছু বাবা-মাকে দেয়, কিছু সঞ্চয় করে আর কিছু নিজের শখ এবং স্বামী-সন্তান বা আত্মীয়-স্বজনকে গিফট দিতে মন চাইলে সেখান থেকে ব্যয় করে । কিন্তু সমস্ত টাকা মরিয়ম জামিলা স্বামীর হাতে তুলে না দেয়ায় কিন্তু প্রায়ই তাকে স্বামীর ক্রোশের শিকার হতে হয় ।মাঝেই মাঝেই তাকে বকা-ঝকা শুনতে হয় । বাকি পঞ্চাশ শতাংশ টাকা কোথায় সে ব্যয় করেছে তার ১ টাকা পর্যন্ত হিসাব চাই স্বামীর । হিসাব ঠিক মত না দিতে পারলে সমস্যা । কোন মাসে যদি বাবা-মার প্রয়োজনে একটু বেশী দেয় তাহলে শুরু হয়ে যায় সংসারে গণ্ডগোল । এই গণ্ডগোলের রেশ ধরে অনেক সময় গায়েও হাত পড়ে তার । প্রায়ই নাদিরা পারভিনদের মতো চাকুরীজীবী মহিলাদের উদাহরণ দিয়ে সমস্ত টাকা হাতানোর চেষ্টা চালায় বিভিন্ন কায়দায় ।
কেস স্টাডি-৩
জেসমিন মালিহা । সরকারী কর্মকর্তা । মাসে প্রায় ৩৫ হাজারের মত বেতন পায় সে । স্বামীর অঢেল টাকা থাকায় স্বামীর হাতে সে প্রতি মাসে নাদিরা পারভিন এবং মরিয়ম জামিলার মতো গুনে গুনে টাকা দেয় না । তার স্বামীর কখনও অতিরিক্ত টাকার প্রয়োজন হলে সে দিয়ে দেয় । অন্যথায় তার পছন্দসই খাতে উপার্জিত অর্থ ব্যয় করে থাকে সে । যেহেতু নাদিরা পারভিন ও মরিয়ম জামিলার মতো বাধ্যতামূলকভাবে সে স্বামীর হাতে নিজের উপার্জিত অর্থ তুলে দিতে নারাজ তাই জেসমিন মালিহার ঘরে চলে সবচেয়ে বেশী ঝামেলা । সে তার উপার্জিত টাকা ব্যয়ের জন্য নিজেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে চায় বলে বিরাট সমস্যায় পড়েছে । আস্তে আস্তে স্বামী-স্ত্রীতে দ্বন্দ্ব এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে বিবাহ বিচ্ছেদ হতে পারে যে কোন মুহূর্তে ।
অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে পরিবারের নারীরা শাশুড়ি, ননদের অবস্থান থেকে নিজেরাই নারীর স্বাধীনতা হরণে বিরাট ভূমিকা পালন করে থাকে । নিজের জন্য, নিজের মেয়ের জন্য বা নিজের বোনের জন্য অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে যে স্বাধীনতা চায় নিজের ছেলের বা ভাইয়ের স্ত্রীর জন্য কিন্তু সেটা চায়না । বরং পুরুষের আগেই তারাই বেশী বিরোধিতা করে সবচেয়ে বেশী । ছেলে বা ভাইকে সব সময় বুঝাবে মেয়েদের বেশী মাথায় তুলতে নেই, তাদের নিজের হাতে বেশী টাকা খরচ করার স্বাধীনতা দিতে নেই । বরং বউকে সব সময় নিজের কব্জায় রাখতে হয় ।
মুসলিম সমাজে সধারণত একটা কথা প্রচলিত আছে যে-
“ ইসলামে নারীর অর্থ উপার্জন নিষিদ্ধ ।”
তাই অনেক ধর্ম ভীরু নারী অর্থ উপার্জনের কথা মাথায় নেন না ধর্ম লঙ্ঘন হবে বলে । অথচ কোরআন বা হাদিসের কোথাও সুস্পষ্টভাবে সে ব্যাপারে কোন নিষেধাজ্ঞা নেই । বরং অনেক মহিলা সাহাবীকে ব্যবসা ও কুটির শিল্পের কাজ করে স্বাবলম্বী হতে দেখা গিয়েছে । তবে যেহেতু ধর্মীয় এবং বায়োলজিক্যাল দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে দেখা যায় যে সন্তানই পালনই নারীর মূল দায়িত্ব তাই সম্ভবত ইজমা এবং কিয়াসের মাধ্যমে নারীর অর্থ উপার্জনের বিষয়টাকে কিছুটা শিথিল করে দেখা হয়েছে ।বর্তমান সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় ইসলামী চিন্তাবিদ জাকির নায়েকের এক লেকচারের মাধ্যমে জানা যায় যে নারীদের জন্য শিক্ষকতা পেশাটা বেশ ভাল । এটা সন্তান লালনের মতো আদর্শ একটা বিষয়ও বটে ।
ইসলাম ধর্ম মতে নারীর উপার্জিত অর্থে স্বামী তথা পুরুষরা কোন ভাগ বসাতে পারবে না । নারী চাইলে তার উপার্জিত অর্থ স্বামীর সংসারে ব্যয় করতে পারবে আর না চাইলে করবে না । সে ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধীনতা তাকে দিয়েছে ইসলাম ।
অথচ নারীদের অর্থ উপার্জনের ব্যাপারে পরস্পর বিরোধী এই দুই মতের মধ্যে কিন্তু প্রথম মতটাই সমাজে প্রচলিত বেশী । কেন? কারণ আত্মপক্ষ সমর্থন । প্রতিটি ব্যক্তি, জাতি এমনকি প্রাণীর মধ্যে আত্মপক্ষ সমর্থনের প্রবণতা থাকে । সব সময় নিজের, নিজের জাতির জন্য মঙ্গলজনক পথ খুঁজে নেয়ার চেষ্টা চালায় মানুষসহ সকল প্রাণী । সেটা অন্যের জন্য যতই ক্ষতিকর হোক না কেন । নারী সারাদিন অন্যের গীবত করে সময় পার করলেও স্ত্রীকে একবারও বলে না এটা ইসলামে নিষিদ্ধ, আর চাকুরী করতে চাইলে ইসলামের ঝাণ্ডা তুলে তা দমিয়ে দিতে চায় সবাই ।
অন্যদিকে জ্ঞান অর্জনে বিমুখ নারী জাতির মধ্য থেকে কেউ কেউ পুরুষের চাপানো মত না মেনে নিয়ে শুধু পুরুষদের সাথে দ্বন্দ্বই করে গেল অথবা কেউ কেউ পুরুষ যা বলছে তাই মাথা পেতে নিল । নিজেদের ধর্ম তাদের কি অধিকার দিয়েছে সে ব্যাপারে কোন জানার আগ্রহও নেই তাদের । কেউ আবার জেনে ফেললেই যে অধিদার পেয়ে গেল টা না । বরং তার জানাটাই অনেক ক্ষেত্রে তার মানসিক কষ্টের কারণ হয়ে যায় ।
আগে যেহেতু নারীরা অবলা ছিল, স্বাবলম্বী ছিল না; তাই স্বামীর অন্যায়েরও প্রতিবাদ তারা করার সেভাবে সাহস পেত না । কারণ এতে যদি স্বামীর সংসার থেকে বিতারিত হতে হয়! তাই হাজার কষ্ট হলেও স্বামীর শত নির্যাতন সহ্য করে তার সংসার আঁকড়ে ধরে থাকতো ।
কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে যখনই নারীরা স্বাবলম্বী হতে শিখলো এবং নারীর অধিকারের ব্যাপারে সচেতন হতে লাগলো তখন নারীরা আরও বেশী জটিলতায় পড়ে গেল । তখন পুরুষদের অন্যায়টাকে তাদের কাছে অন্যায় মনে হল । পুরুষদের নির্যাতন আর মুখ বুঝে সহ্য করার মানসিকতা তাদের থাকলো না । নির্যাতন, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শিখলো তারা । আর তখনই পরিবারগুলোতে দেখা দিতে লাগলো মহা বিপর্যয় । বিবাহ বিচ্ছেদ সহ নানা জটিলতা সম্ভবত এ কারণেই হচ্ছে ।নারীদের জন্য পুরুষ কর্তৃক নির্যাতনের চিত্র বদলে যাচ্ছে । ক্রমাগত স্নায়বিক যুদ্ধ চলছে প্রতিটি উপার্জনক্ষম নারীর পরিবারে ।এটা মানুষ কেন প্রতিটি প্রাণীর স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য । অসহায় নিরীহ কোন প্রাণী যখন ধীরে ধীরে সক্ষম হয়ে উঠে, নিজের দায়িত্ব নিজে নিতে পারে তখন অন্যের অন্যায় নির্যাতন, লাঞ্চনা মুখ বুঝে সহ্য করার প্রবণতা আর তার থাকে না ।এটাই স্বাভাবিক ।
নারীর যে অধিকার সেটা পুরুষের ত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত হবে । নারীর অধিকারের জায়গাটা সজীব রাখতে চাইলে পুরুষকে তার অন্যায় অবস্থান দখলের জায়গা থেকে নেমে আসতে হবে । নারীর জন্য একটা সম্মানজনক অবস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে পুরুষকেই । নারীর চাওয়া-পাওয়া,ভাল লাগা, মন্দ লাগা এগুলো বিষয়ের দিকে খেয়াল রাখতে হবে পুরুষকে । একা হাজার লড়াই করেও নারী তার প্রাপ্য স্বাধীনতা ও অধিকার সেভাবে হয়তো ভোগ করতে পারবে না; আর সেটা কখনও পারেও নি । বরং নারীরা এককভাবে নিজেদের অধকার এবং স্বাধীনতা আদায় করতে গিয়ে সমাজ ও পরিবারে দেখা দিচ্ছে মারাত্বক অবক্ষয় । তাই পুরুষ জাতিকে নারীদেরকে নিজের মতই স্বাধীন মানুষ বিবেচনা করা পুরুষকেই নারীর স্বাধীনতা উপভোগের ব্যবস্থা করে দিতে হবে যেহেতু পারিবারিকভাবে তারা নারীদের কর্তার আসনে অধিষ্ঠিত আছে এখনও ।নারীর স্বাধীনতা ও অধিকারের ব্যাপারে পুরুষকেই এগিয়ে আসতে হবে । তবেই কল্যাণ আসবে ।
পরিশেষে কবির ভাষায় বলতে চাই-
“পৃথিবীতে যত সৃষ্টি কল্যাণকর;
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর ।”
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ সকাল ১০:৫৪