শারমিন আকতার
সমাজে সবাই মুখে মুখে নারীর গুণের প্রশংসা করলেও প্রকৃত অর্থে আমাদের অনিয়মে ভরা এই সমাজে নারীর সুন্দর, যৌন আবেদনময় দেহই সবচেয়ে বেশী মূল্যবান মনে হয় এবং নারী ও তার পরিবারের জন্য বিশাল বড় মাপের একটা পূঁজি । নারীর দেহের মূল্যায়ন নানাভাবে করা হয় আমাদের সমাজে । আর নারীর এই দেহ ভিত্তিক চাহিদা নারীকে একটা পণ্যে পরিণত করে ফেলেছে । আর শুধুমাত্র দেহের ভিত্তিতে নারীর মূল্যায়নের জন্যই নারীদের মাঝেও ঢুকে গেছে সৌন্দর্য তথা দেহ চর্চার প্রতিযোগিতা । আর মেয়েদের এই মানসিকতার ভিত্তিতে শহর থেকে গ্রামের আনাচে কানাচে গড়ে উঠছে নারীর দেহ মর্দন ও সৌন্দর্য চর্চার আবাসন নানা ধরণের বিউটি পার্লার । এই জন্যই দেখা যায় যে একজন চিন্তাশীল নারী যে মানুষের চিন্তাধারাতে পরিবর্তন আনার যোগ্যতা রাখে তার চেয়ে সে নারীকে বেশী মর্যাদা দেয়া হয় যে নারী তার নিজের ও অন্য একটা মেয়ের দেহকে বেশী সুন্দর করে সাজাতে । কোথায় কিভাবে নারীর যৌন আবেদনময় দেহ তার জন্য বিশাল পূঁজি সে বিষয়ে কিছু সামাজিক চিত্র দেখা যাক-
বিয়ের ক্ষেত্রেঃ
মানুষের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিয়ে । আর এই বিয়ের সময় দেখা যায় নারীর দেহ যত সুন্দর তার তত বেশী দাম । নারী যত সুন্দর তাকে তত ভালো ঘরে বিয়ে দেয়া যায় । এই কারণে গরীবের সুন্দরী মেয়ের অনেক বড় ঘরে বিয়ে হতে দেখা যায় । আর একটু অসুন্দর হবার কারণে অনেক বড় লোক ঘরের মেয়েরও ভালো ঘরে বিয়ে হয় না; একটা গরীব ছেলে দেখে বাবা-মাকে বিয়ে দিতে হয় অনেক কিছু দিয়ে ।
তারপরও কোন ছেলে অর্থ লিপ্সা বা পরিবারের চাপে কোন অসুন্দরী মেয়ে যাকে দেখলে যৌন আবেদন অন্য পুরুষের বা তার স্বামীর তেমন জাগে না তাকে নিয়ে বাইরে বেড়াতে বের হতে চায় না খুব একটা । বন্ধু বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনের বাসায় তাকে নিয়ে ঘুরতে যেতে স্বামী নারাজ।বাইরে বেড়াতে যাবার ক্ষেত্রে স্ত্রীর সঙ্গ এড়িয়ে চলতে চায়; স্ত্রী তার সাথে ঘুরতে অনেক আগ্রহী থাকার পরও । আর অন্যদিকে যদি স্ত্রী অনেক সুন্দরী তথা যৌন আবেদনময়ী হয় তাহলে তাকে নিয়ে স্বামী এখানে সেখানে অকারণে ঘুরে বেড়াতে খুব বেশী মাত্রায় আগ্রহী হয়ে উঠে । যেন সুন্দরী বউ মানুষকে প্রদর্শন করায়ে আত্মতৃপ্তির স্বাদ আস্বাদন করতে চায় !
যে সমাজে যৌতুক প্রথা ব্যাপকভাবে প্রচলিত; যেখানে কোন ছেলে যৌতুক না নিয়ে বিয়ে করলে সেই ছেলেকে বোকা, বলদ ভাবা হয় সেখানেও অনেক ছেলেকে বলতে শোনা যায়- “মেয়ে যদি অনেক সুন্দরী হয় তাহলে সে যৌতুক ছাড়া বিয়ে করবে ।” অর্থাৎ মেয়ে শুধু অতিরিক্ত মাত্রায় সুন্দরী হলে মেয়ের বাবাকে যৌতুক দিতে হচ্ছে না । এখানে মেয়ের সুন্দর তথা যৌন আবেদনময় দেহ তার পরিবারের কাছে এক বিশাল মাপের পূঁজি তাকে বড় পরিবারের ভদ্র ছেলের সাথে বিয়ে দেবার ক্ষেত্রে ।
এই সুন্দর দেহের কারণেই একটা নারী ও তার পরিবার নানা সুবিধা পেয়ে আসলেও একটা কথা গ্রামে প্রচলিত আছে “গরীবের সুন্দরী বউ থাকতে নেই ।” তবে এর প্রভাব গরীব স্বামী ও যদি তার স্ত্রী সৎ হয় তার জন্য অমঙ্গলের কারণ হলেও এর পেছনেও কিন্তু রয়েেছে নারীর যৌন আবেদনময় দেহের মোহ । তার সুন্দর, সুডৌল দেহের জন্যই প্রভাবশালী লম্পট পুরুষেরা গরীব স্বামীর আর্থিক দুর্বলতার সুযোগে তার স্ত্রীকে ভোগের চেষ্টা চালায় । অনেক ক্ষেত্রে হয়তো সফলও হয় ।
তবে নারী যখন মেনোপেজ দশায় চলে যায়, তার যৌন চাহিদা কমে যায়, তার থেকে যৌনতা ভিত্তিক কোন ধরণের প্রত্যাশা করার আর কোন সুযোগ থাকে না; নারীর জীবনের প্রায় ৫০ বছর পার হয়ে যায় তখন হয়তো দেহের ভিত্তিতে নারীকে আর মূল্যায়ন করা হয় না । তখন শুধু তখনই দেখা হয় তার গুণগুলো । কিভাবে সন্তানকে ভালভাবে মানুষ করছে? পরিবার কিভাবে আগলে রেখেছে? কিভাবে সবাইকে সুখী রেখেছে? সবার সাথে তার সম্পর্ক কেমন? এসবের ভিত্তিতে নারীর মূল্যায়ন ।
চাকুরীর ক্ষেত্রেঃ
মানুষের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুইটা প্রয়োজন রয়েছে । যে দুটো প্রয়োজন পূর্ণ করার চাহিদা প্রত্যেকটি মানুষের অবশ্য কাম্য। তার একটা হল যৌন চাহিদা আর একটা অর্থ চাহিদা । এই দুই চাহিদার ক্ষেত্রেই নারীর মূল্যায়ন দেহের ভিত্তিতে হয় । অথচ সেখানে পুরুষের মূল্যায়ন ক্ষেত্রে তার দেহ নয় তার মেধা ও যোগ্যতা মূল মানদণ্ড ।
সরকারী চাকুরীর ক্ষেত্রে নারীর দেহ ভিত্তিক মূল্যায়ন সেভাবে না হলেও অধিকাংশ প্রাইভেট জবে সুন্দর দেহ বিশিষ্ট নারীর মূল্যায়ন সবচেয়ে বেশী । প্রাইভেট চাকুরীর ক্ষেত্রে সৌন্দর্যের জন্য মেয়ের অন্যান্য যোগ্যতাও ছাড় দেয়া হয় । যে মেয়ে যতো আবেদনময় করে নিজেকে উপস্থাপন করবে তাকে ততো বেশী স্মার্ট ভাবা হয় !
মিডিয়া ও চলচ্চিত্র শিল্পে নারীর সুন্দর দেহ সবচেয়ে বড় পূঁজি । যদি সে সুন্দর ও যৌন আবেদনময় দেহের অধিকারী হয় তবেই সে এই ক্ষেত্রে কাজ করার যোগ্যতা রাখে । অনেক অসুন্দর পুরুষ নিউজ রিডার, চলচ্চিত্র ও নাটকের নায়ক দেখা যায়, কিন্তু অসুন্দর মহিলা নিউজ রিডার বা নায়িকা খুঁজে পাওয়া যাবে না । এক্ষেত্রে সুন্দর ও যৌন আবেদনময় দেহই নারীর মূল পূঁজি । আর সে দেহ যদি প্রভাবশালী পুরুষদের ভোগ করার সহজ সুযোগ তৈরি করে দেয় তাহলে তো এক লাফে জিরো থেকে হিরো বনে যায় !
ছাত্র জীবনেঃ
ছাত্র জীবনেও দেখা যায় যে, যে মেয়ে সুন্দরী এবং যৌন আবেদনময়ী অধিকাংশ ক্ষেত্রে সে মেধাবী ছাত্র ও শিক্ষকদের কাছ থেকে সহায়তা পায়; বিশেষ সুবিধা লাভ করতে পারে যদি সে দেহ প্রদর্শনের মাধ্যমে তাদের অন্য রকম প্রত্যাশা পূর্ণ করার হালকা ইঙ্গিত বা নিশ্চয়তা দেয় । মেয়ে লিপ্সু শিক্ষকদের কাছ থেকে স্পেশাল সুবিধা পেয়ে থাকে । এমন কি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে কোন সুন্দরী মেয়ের যদি প্রভাবশালী কোন শিক্ষকের সাথে ভালো সখ্যতা থাকে তাহলে সেই সখ্যতা আর তার সৌন্দর্যের আধার আবেদনময় দেহের কারণে সে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের আসন পর্যন্ত দখল করতে তার মেধা বা যোগ্যতা যতই কম থাক না কেন!
পরিশেষে বলতে চাই নারীকে পণ্য ভাবার এই প্রবণতা থেকে আমাদের সমাজের মানুষগুলোকে বের হয়ে আসতে হবে । পুরুষদেরকে যেমন তাদের মেধা, যোগ্যতা, মননশীলতার ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হয় সেরকম মূল্যায়ন করতে হবে নারীকেও । নারীকে যৌন আবেদনময় দেহের ভিত্তিতে মূল্যায়নের মাধ্যমে তাদেরকে পণ্য না ভেবে যদি তাদের মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হয় তাহলে নারীর প্রতি যে বৈষম্য প্রদর্শন করা হয় তা বহুলাংশে কমে আসবে । পুরুষ নারী মিলে সৃষ্ট এই সমাজে ভারসাম্য ফিরে আসবে ।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে নভেম্বর, ২০১৬ ভোর ৬:৩৫