সাইকোপ্যাথের ছাঁয়া
শারমিন আক্তার
নাবিলার বিয়ের পর তিন বছর কেঁটে গেল । স্টুডেন্ট লাইফেই বিয়ে হওয়ায় সংসার, পড়াশুনা সব মিলিয়ে বেশ চাপেই ছিল সে। বাবার আর্থিক সংকট ও মায়ের অসুস্থতার জন্য পড়া শেষ হওয়ার কয়েক বছর আগেই বিয়ের পিড়িতে বসতে হয়েছিল তাকে । ওর মায়ের খুব ইচ্ছা মেয়ের জামাই দেখেবে । তাই তাড়াহুড়ো করেই কোনমতে ধার-দেনা করে তাকে বিয়ে দিতে হয়েছিল । কিন্তু তার মা আল্লাহর রহমতে এখন মুটামুটি সুস্থতার সাথেই দিন পার করছে । অকারণে মেয়েটাকে বিয়ে দিয়েছিল সে সময় এত তাড়াহুড়ো করে। বেশ ভাল স্টুডেন্ট ছিল নাবিলা । রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্সের স্টুডেন্ট ছিল সে । গত বছরই এম. এস–সি. শেষ করল কোনমতে । আবার পড়া শেষ হতে না হতেই কোল জুড়ে এল এক ফুঁটফুঁটে সোনা মনি । সোনামনির বয়স এখন পাঁচ মাস ।
নাবিলা আজকে সকালে হঠাৎ স্বামীকে বলল
-তুমি আমাকে চার-পাঁচ হাজার টাকা দিতে পারবে ?
-এতগুলো টাকা? কি করবে তুমি এতটাকা?
-না মানে ।
লজ্জায় সংকুচিত হয়ে যাচ্ছিল নাবিলা । সে বলতে পারছে না কেন তার এত টাকা দরকার ।
তার স্বামীও আর কিছু বলল না । সোজা অফিসে যেতে উদ্দ্যত হল । নাবিলা এবার অনুনয়ের দৃষ্টিতে স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলল
-কিছু বলছো না যে । দিতে পারবা না চার হাজার টাকা ?
-এতগুলো টাকা কি করবা তুমি?
-আমি কিছু করবো না । আব্বাকে দিব । গত মাসে সুদের উপর ধার করে আম্মার চিকিৎসা করাইছিল । লোকটা চাপ দিচ্ছে অনেক । অনেক অপমান করে নাকি গেছে । যদি দিতে চার হাজার টাকা । খুব উপকার হত ।
¯স্বামীর কাছ থেকে বাবা মার জন্য চাইতে নাবিলার খুব লজ্জা করে । তাছাড়া শশুর-শাশুড়ীর জন্য খরচ করার মানুসিকতাও তেমন একটা নেই তার স্বামীর । তাই বলার সাহস পায়না নাবিলা। আজ বিয়ের পর দ্বিতীয় বারের মত বাবার জন্য স্বামীর কাছে হাত পাতলো সে ।
-ধার দাওনা পিজ ।
-ধার ।
একটু যেন শিথিল হল নাবিলার স্বামী।
-কবে পরিশোধ করবে ?
-কবে? তা তো শোনা হয়নি ।
-শুনিও সামনে মাসে দিতে পারবে নাকি ?
-সামনে মাসে?
-হ্যা আমি একটু ক্রাইসিসে আছি । টি.এ.,ডি.এ বিল পাচ্ছিনা ঠিক মত কয়েক মাসে থেকে ।
-তাই । তোমারও সমস্যা ।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল নাবিলা । তারপর কন্ঠে এবার কিছুটা ঝাঁজালো ভাব এনে বলতে লাগলো
-গত মাসে কাজের মেয়ের বাবাকে দুই হাজার টাকা ধার দিলে। আমাকে কালকেই বললে বলে দিতে তাদের টাকা পরিশোধ করতে হবেনা । অথচ আমার বাবাকে ধার দিতে না দিতেই পরিশোধের তারিখ শুনতে চাচ্ছো ? কি আশ্চর্য্য ব্যাপার !
নাবিলার স্বামী কিছুটা থতমত খেয়ে গেল ।
-তার মাসের টাকা থেকে কেঁটে নেব ।
-কিভাবে কেঁটে নিবে ? মাসে মাসে তো তার নামে খোলা ডি.পি.এস. এ জমা হচ্ছে এক হাজার করে । তার উপর যখনই তার বাবা আসে তার হাতে দেয় হয় পাঁচ-সাতশো টাকা । কজের মেয়ে সংসারের কাজ করলে পেমেন্ট পায় । আমি কি কোন কাজ করি না ? আমি কি একটা টাকাও পেতে পারি না?
কাঁতর কন্ঠে কথাগুলো বলল নাবিলা ।
-আমি কি তোমাকে দিই না ? যা খাইতে চাও, পরতে চাও এনে দিই না আমি?
-শুধু খাইলে পরলেই সব শেষ হয়ে যায় ? আর কিছুই লাগে না? নিজের বাবা-মাকে কিছু দিতে ইচ্ছে করে না ? কাজের মেয়েই তো তার বাবা-মার জন্য অনেক করছে । আর আমি ? শুধু সাক্ষী গোপাল হয়ে বাবা-মার কষ্ট দেখে যাচ্ছি ।
কিছু করতে পারি না । দিতেও পারি না । আমার কি ইচ্ছে করে না বাবা-মাকে দিতে । চার-পাঁচশো টাকা করে যদি দিতে পারতাম তাও শান্তি পেতাম । বাবা-মারও কষ্ট কিছুটা কমতো ।
-সেটা চাকুরী করে দিও । আমি তোমাকে পড়াবো । তারপর তোমার জন্য কাজের মেয়েকে মাসে এক হাজার করে টাকা দিব । আর পারবো না আমি । তোমার ভাইয়েরা কি করে ? তারা দিতে পারে না তোমার বাবা মাকে? আমার বাবা-মা যখন বেঁচে ছিল তখন তো আমার বোনেরা আব্বা-অম্মাকে দেয় নি । ভাইয়া আর আমিই আব্বা-আম্মার চিকিৎসা থেকে শুরু করে সব খরচ চালিয়েছি ।
-কাজের মেয়ে তো মেয়ে । সে কিভাবে দিতে পারে ?
-কাজের মেয়ের সাথে নিজেকে তুলনা করছো?
-তুলনা করছি না । তার মতও হতে পারলে অনেক নিজেকে অনেক ধন্য মনে করতাম। বাবা-মার পাশে দাড়াতে পারতাম ।
-হও কাজের মেয়ে ।
চলে গেল নাবিলার স্বামী । নাবিলা আর কিছু বলল না । কি বা বলার আছে তার ? খুব চাকুরী করতে ইচ্ছে করে তার । কিন্তু স্টুডেন্ট লাইফে বিয়ে তারপর পড়া শেষ হতে না হতেই বাচ্চা আসলো কোলে । চাকুরীর জন্য পড়ার সুযোগই তো তার হয়নি । চাকুরী পাবে কি করে ? প্রাইভেট জবের জন্য ভাইবা দিতে চায় । কিন্তু তার স্বামী প্রাইভেট জব করতে দিবে না । তাই আর সে জন্যও ট্রাই করা হয় না । কলেজে লেকচারার পদে ঢুকতে তার খুব ইচ্ছে করে । কিন্তু সে জন্য ঘুষ লাগবে । ঘুষ দেবে কে? স্বামীর একটাই কথা চাকুরীতে কোন ঘুষ দিতে সে পারবে না । নিজ যোগ্যতাই চাকুরী পেতে হবে । এত শর্ত সাপেক্ষে তার সামনে এখন আর দুটি পথ খোলা । ব্যাংকের জব ও সরকারী জব । এই দুটো জব তো এত সহজ না । বই লেজ ধরে পড়ে থাকতে হবে সারাক্ষণ । সে সময় কোথায় নাবিলার হাতে । পড়ার সময়ও ভালভাবে পায় না সে ।
নাবিলা এবার রাগে-দুঃখে নিজের মাথায় বাড়ী দিতে লাগলো । যোগ্যতা থাকতেও চাকুরী না পাওয়ার কষ্ট । ক্ষমতা থাকার পরও বাবা-মাকে সাহায্য করতে না পারার অক্ষমতা দিন দিন তাকে যেন অস্বাভাবিকতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে । তার ভিতরে মাঝেই মাঝেই খুঁজে পাওয়া যায় সাইকোপ্যাথের ছাঁয়া ।সংসারে মেয়েরা এভাবেই যিম্মি হয়ে থেকে অথবা কোন কোন মেয়ে স্বামীকেই যিম্মি করে রেখে অস্বাভাবিক ও অমানবিক জীবন যাপন করছে । আর পুরুষরাও বর্তমানে কেমন যেন জাতহীন জাতিতে পরিনত হয়েছে । স্ত্রী শক্ত ও স্বামী নিয়ন্ত্রণে চৌকস হলে তার দাস হয়ে থাকে । আর নরম ও সরল হলে তার ভগবান হয়ে বসে ।