অসহায় জামিলারা
শারমিন আক্তার
-মা তোর জামাই বুঝি ফির বিয়া করবি ।
-কি কস? বিয়া করবি ক্যা ?
-হ মা সেই তনে তো মোক পাঠালি । ট্যাকা নিবা । বিশ হাজার ট্যাকা নিয়ে গেলে আর করবলাই । বিয়ার তিন বছর হল ডিমেনের ট্যাকাতো পুরা পাই নাই । তাই ট্যাকা নেয়ার তনে মোক পাঠালি । মাঝে মাধ্যি ট্যাকার তনে মার ধরও করে মা । তোক মুই কও নাই মা কষ্ট পাবু বলে । ভাবিছনু মার খায়া যদি ডিমেন শোধ হয় তে হোক । কিন্তু কিছুই হল না মা । চামড়ার ব্যাবসা করবি । তাই ট্যাকা নিয়ে যাবা কছে । না হলি ট্যাকার তনে ফির বিয়া করবি । এক জাগাত বিয়ার কতাও চলোছে । মেলাই গুলা নাকি ট্যাকাও দিবা চাছে । মা মোক বিশ হাজার ট্যাকার ব্যাবস্থা করে দি মা । লোকটা অতটা খারাপ নয় । খালি এ্যানা ট্যাকার লোভ বেশী।
-কোত্তে তোক মুই বিশ হাজার ট্যাকা দিম মা ? যে জমি কোনা তোর বাপের আছলো সেটা তো তোর বিয়ার সময় বিকে তোর বিয়ার খরচ পার করা হলো । জামাইক কিছু ট্যাকাও দেয়া হল । অ্যানা কিছু ট্যাকা আছলো সেটা তোর বাপের চিকিৎসার পাছেই খরচ হয়া গেল মা । মুই তোক একন কোত্তে ট্যাকা দিম ক? কোত্তে ? তোর বাপটা যদি বাঁচে থাকলো হয় তালে হয়তো..।
আর কোন কথা বলতে পারলো না জামিলার মা । কান্নায় ভেঙে পড়লো সে । স্বামীর মৃত্যুর সাথে সাথে সে এত বেশী অসহায় হয়ে পড়েছে যে সংসার রক্ষায় মেয়ার অস্থিরতা দেখেও নির্বাক দর্শক হওয়া ছাড়া আর কিছুই করার নেই তার ।
-তালে কি বিশ হাজার ট্যাকার তনে মোর সংসারটাই ভাঙে যাবি মা ? গরীবের মেয়ের কি কোন অদিকার নাই ? পড়বা চাসনু পড়ান নাই । ট্যাকা নাই । আব্বার অসুখ । দিনেন বিয়া । আর পড়া হলনা । একন সংসার করবা চাছো । সেটাও আর হব লাই । মোর গুছানো সংসার একন অন্য কেউ নিয়ে নিবি মা । মাত্র বিশ হাজার ট্যাকার তনে ....।
গলা ভারী হয়ে এলো জামিলার । কান্নায় ভেঙে পড়লো সে । কান্নায় তার সাথে তার গরীব, অসহায় মাও একাত্বতা ঘোষণা করলো । সমতালে কেঁদে যাচ্ছে ওরা । এ ছাড়া আর কিই বা করার আছে জামিলা ও ওর মায়ের । মেয়ের বিয়ের পর বাড়ির জমিটা বন্ধক রেখে ¯স্বামীর চিকিৎসার খরচ জুগিয়েছে জামিলার মা। তারপরও স্বামীকে বাঁচাতে পারেনি সে । এখন মানুষের বাসায় কাজ করে নিজের কোন মতেপেটের ভাত জোগায় সে ।
মাঝে বিশ কিছু সময় চলে গেছে । জামিলার স্বামী আবার বিয়ে করেছে । এক ¯স্বচ্ছল পরিবারের মেয়েকে ।পঞ্চাশ হাজার টাকা নাকি পণও পেয়েছে তার স্বামী । সতীনের ঘরে ¯^ামীর অবহেলা ও সতীনের হিংসাপনায় টিকতে না পেরে অসহায় মায়ের সংসারেই ফিরতে হল জামিলাকে । আজ কাল কি মেয়ের সংখ্যা বেড়ে গেছে নাকি ? সতীনের ঘরে বাবা মারা যে কিভাবে মেয়ে পাঠায় ? তাও আবার পণ সমেত । হায়রে সৌভাগ্যবান পুর“ষ জাতি ! এই জন্যই হয়তো গ্রামে একটা কথা প্রচলিত আছে- দূর্ভাগার গর“ মরে আর সৌভাগ্যবানের বউ মরে । বিয়ের বাজারে বিপত্নীক পুরুষের কত দাম ! কখনও কখনও বউ না মরলেও ক্ষেত্র বিশেষে দাম থাকে চাঙা । অথচ মেয়েদের দাম গরুর চেয়েও যেন কম ।
মায়ের পাশাপাশি জামিলাও মাঝে মাঝে এর ওর বাড়িতে কাজ করে মায়ের সংসারের চাকা সচল রাখে ।
আজ মন্ডলের বাড়িতে কাজে এসেছে জামিলা । মন্ডল কি কাজে বাড়ির বাইরে গেছে ।মন্ডলের ছেলে মেয়েরা স্কুলে গেছে । তার স্ত্রীও কিছুক্ষণ আগে পাশের গ্রামে মায়ের বাড়ি গেছে । হঠাৎ তার মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়েছে ভাইয়ের থেকে একটু আগেই । জামিলার উপর বেশ আস্থা আছে মন্ডলের স্ত্রীর । তাই ঘরে তালা মারলেও বাড়ির দায়িত্ব তার উপর দিয়ে কয়েক ঘন্টার জন্য মায়ের বাড়ি গেছে সে । আপন মনে নিজের কাজ করে যাচ্ছে জামিলা । ধান ভর্তি বড় বড় তিনটি পাতিল চাপানো বিরাটাকায় চুল্লীতে শুকনা খড় ঠেলে দিচ্ছে সে । যেন ছোট খাট কোন বয়লারে ইন্ধন ঠেলছে । হঠাৎ বাসায় ফিরলো মন্ডল । তাকে দেখা মাত্র দ্র“ত কোমরে জড়ানো আঁচল খুলে শরীরটা ঢেকে নিল জামিলা ।
-তোর ভাবী কই?
-ভাবী সোতার পাড়া গেছে । চাচী নাকি হঠাৎ অসুস্থ হইছে ।
-ও হ তোর ভাবী ফোন করে জানাছলো । ভুলেই গেছো । তা তোর খবর কি?
-ভালই ।
-তোর মা তোক ফির বিয়া দিবি না স্বামীর সংসারত ফেরৎ যাবু ?
-জান না ।
বলেই লজ্জা রাঙা মুখে মাথা নীচু করলো জামিলা । মন্ডলের তীক্ষ দৃষ্টি জামিলার প্রতি । জামিলা সংকোচিত হয়ে আবার নিজের কাজে মনোযোগ দিল । আঁচলের কিছুটা টেনে ঘোমটা দেয়ারও চেষ্টা চালালো সে । কিন্তু নিজেকে আড়াল করার সব চেষ্টা যেন ব্যার্থ হয়ে গেল জামিলার । মন্ডল বাড়ির প্রধান দরজায় শিকল উঠিয়ে দিল । ভয়ে সংকিত জামিলা । মন্ডল পেছন থেকে জামিলাকে জাপটে ধরলো । জামিলা নিজেকে ছাড়ানোর অনেক চেষ্টা করলো । কিন্তু পারলো না । শক্ত বাহু যুগল যেন অক্টেপাসের মত আটকে রেখেছে জামলাকে । অভিজ্ঞ প্রেমিকের মত তাকে আন্দোলিত করার চেষ্টা চালালো মন্ডল । জামিলা আর নিজেকে ছাড়াতে পারলো না । মন্ডলের শক্ত হাতের বাঁধন ও কৌশলের কাছে যেন পরাজিত হল সে। পতিহীন জীবনে বহুদিনের বাসনা হয়তো তাকেও অপরাধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে । জামিলাকে পাজাকোলা করে ঘরে নিয়ে গেল মন্ডল । ঘরের দরজা লাগাতে উদ্যত হল সে। এমন সময় তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে এক দৌড়ে সোজা নিজের বাড়িতে পৌছে গেল জামিলা। ধর্মীয় চেতনা নাকি বিবেকের তাড়না তাকে এ যাত্রায় অবৈধ আদিম কাজ থেকে বিরত রাখলো ।
গ্রামের লোভী পুরুষদের হাত থেকে বাচাঁর জন্য শহরে তথা ঢাকায় চলে এল জামিলা । সে শুদ্ধভাবে বাঁচতে চায় । গার্মেন্টসে কাজের ব্যাবস্থাও হয়ে গেছে তার । তাদের পাশের গ্রামের এক শিক্ষিত, চাকুরীজীবী মেয়ের মাধ্যমে গার্মেন্টসে কাজ পেয়েছে সে । মেয়েটিও গার্মেন্টসে কাজ করে । তবে বড় পদে আছে । সহকারী ম্যানেজার সে । এখন সেই মেয়েটির বাসাতেই থাকছে জামিলা। মেয়েটি বেশ দরদী । প্রায়ই সে তার এলাকার অসহায় মেয়েদের জন্য গার্মেন্টসে কাজের ব্যাবস্থা করে দেয়। এমনকি প্রথম মাসের বেতন না পাওয়া পরযন্ত অনেককে নিজের বাসায় থাকার অনুমতিও দিয়ে দেয় বিনা বাক্য ব্যায়ে ।
জামিলা লায়লার কিচেনে সবজী কাঁটছে ।এমন সময় লায়লা এসে জামিলাকে বলল
-জামিলা আমাকে এক কাপ চা করে দিতে পারবা?
-ক্যান পারুম না আপা ? আপনি যে কি কন ? এখনি দেছি । আল্লায় আপনার অনেক ভাল করবি আপা ।
আপনে যে আমার কি উপকার করছেন আপা ।
-থাক কি যে বল । তুমি আমার এলাকার বোন । তোমার জন্য এইটুকু করা আমার দয়িত্ব । আর মেয়েদেরকে আত্বনির্ভরশীল হতে হয় । বুঝতে পেরেছো । না হলে এই পুরুষ শাসিত সমাজে মেয়েদের কোন মূল্য নাই । সবাই চুষে খাবে । চারিদিকে সব শকুনের দল ।
-ঠিকই কইছেন আপা । মাইয়া মানুষরা অনেক অসহায় আপা । নিজের বাপ, স্বামী, ভাই কেউ তাদেরকে মূল্য দেয় না । মাইয়া বলে সবাই অবহেলা করে । আর গরীবের মেয়েরা তো আরও অবহেলা পায় । ট্যাকার অভাবে স্বামীও থাকেনা । আপনে না থাকলে যে আমার কি হইতো আপা ! আল্লায় আপনার অনেক ভাল করবি আপা।
-ঠিক আছে । আমাকে এক কাপ চা একটু ঘরে দিয়ে আসো না । প্লিজ..
-ঠিক আছে । দিয়ে অসুছি আপা । আপনে যান । আমি অসুছি ।
গার্মেন্টস থেকে ফিরে আজ খুব তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লো জামিলা । কিচেনের পাশেই একটা ছোট ঘরে থাকে সে। হঠাৎ দরজায় কলিং বেল বাজার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল জামিলার । বিছানা থেকে গাঁ টা তুললো সে । মোবাইলে সময় দেখলো । রাত দেড়টা বাজে । এত রাতে কে এসেছে ? জামিলা নিজের ঘরের দরজা না খুলে জানালার পাশে দাড়ালো । বন্ধ দরজার দিকে কিছুটা ভীত দৃষ্টিতে তাকালো সে । এমন সময় লায়লা ঘর থেকে বের হয়ে এল । । বেশ হাসি খুশী ভাব নিয়ে দরজা খুলে দিল সে। তারপর একটা লোকের হাত ধরে তাকে নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকলো । খুব যত্ন দিয়ে ঘরের দরজা আঁটকে দিল । জামিলার বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠলো । সহজ সরল জামিলারও বুঝতে আর কিছুই বাকি রইলো না । সে ভাবতে লাগলো । আপাকে না কত্ত ভাল মানুষ মনে হইছিল । সেই এমনে ? গরীবের মেয়ে ঘরের অসহায়তার কারণে অনেকে সুযোগ খোঁজে । তাদের লোভী নজর থেকে কেউ নিজেক বাঁচপা পারে । কেউ পারে না । কিন্তু লায়লা আপা তো অসহায় নয় । সে কি করে এর শিকার হছে ? নোংরামীটাক ভালবাসা ভাবে বিয়ার আগে বিছানায় যাছে ! কি করে ? ছিঃ ছিঃ
আবহমান কাল থেকেই মেয়েরা সমাজে অবহেলিত । মেয়েদের এমন অবস্থার সুবাদে ক্ষমতার অপব্যাবহারের এই যুগে সমাজের লোভী, জঘন্য মানুষগুলো তাদের আদিম চাওয়া পূরণের জন্য নানা কায়দায় মেয়েদেরকে ব্যবহার করে আসছে । কখনও মেয়েরা অবহেলিত বলে অবহেলা পাচ্ছে । আবার কখনও উন্নয়ন ও আধূনিকতার নামে চলে অবহেলার আর এক নতুন মহড়া । সেটা আধুনিক মেয়েরা হয়তো বুঝতেই পারেনা । আর কখনও তা বুঝতে পারলেও বেশ দেরী হয়ে যায় । তখন আর কিছুই করার থাকে না । সমাজে মেয়েদের অবস্থান কি এরকমই রবে আজীবন ? এ থেকে মুক্তির কি কোন পথ নেই ?