অন্তরালে....
শারমিন আক্তার
-ঐ সারাদিন কোনটে আছলু রে ?
- গরু চরাছো ।
- মিছা কতা । গরু চরাছিস নয় ? তাহলে গরু গেল কোটে ?
আলিম মিয়া কথা কয়টা শেষ করা মাত্রই ছেলে ¯^পনের গালে জোরে একটা থাপ্পড় মারলো ।
- ওহ !
জড়সড় হয়ে গেল স্বপন । ভয়ে এক ফোঁটা কঁদলোও না সে। ঠাঁয় দাড়িয়ে রইলো । সেখান থেকে এক পা নড়ার সাহসও হলনা তার ।
স্বপনের মা তার কাছে এসে কিছুটা নরম গলায় বলল
-স্বপন গরু কোটে থুয়ে আছিস বা ? সারাদিন গেল গরুটা একবারও বাড়িত আসে নাই । আর তুই কোটে আছলু সারাদিন ?
মায়ের কন্ঠে কিছুটা নম্রতার আভাস পেয়ে স্বপন এক নিঃশ্বাসে বলতে লাগলো
- মা মজনুর খড়ত আছে গরুটা । গরু চরাতে চরাতে মুই সাকিলের সাথে বাটুল দিয়ে পাখি মারবা গেছনু । আর এই পাকে শয়তান মজনু শালা গরুটা ধরে নিয়ে গেছে । কারও খ্যাত খাই নাই মা । এমনি এমনি ধরে নিয়ে গেছে ব্যাটা। আর খড়ৎতে গরু নিয়ে আসপা গেছনু সাকিলের তে দশ ট্যাকা নিয়ে । দেই নাই গরুটা । চল্লিশ ট্যাকা চাছে । এই তনে তো গরুটা আর নিয়ে আসপা পার নাই ।
ছেলের কথাগুলো এতক্ষণ বেশ ধৈযের সাথে শুনলো আলিম মিয়া । এবার সে বেশ রেগে গেল । পাগলা কুত্তার মত তেড়ে গিয়ে স্বপনের গলা এক হাতে চেপে ধরে পিছনের দিকে ঠেলতে ঠেলতে বলল
-চল্লিশ ট্যাকা নাগবি নয় । চল্লিশ ট্যাকা । ট্যাকা কি গাছত ধরে ? নাকি তোর নাঙে দিয়ে যায় ? সারাদিন টৈ টৈ করে ঘুরে বেড়াবু । আর খড়ত তে গরু আনবা নাগবি নয় ? কুত্তার বাচ্চা......?
-আ.....ব্বা ! আ...ব্বা ! খু...উ..ব না..গছে ।
খুব চাপা স্বরে অনেক কষ্টে কথাগুলো বলল স্বপন ।
-নাগছে নয় ? একন নাগছে ?
দেয়ালের সাথে আরও জোরে স্বপনকে চেপে ধরলো আলিম মিয়া । আলিম মিয়ার স্ত্রী দ্রুত স্বামী ও সন্তানের কাছে এগিয়ে গিয়ে সবামীর হাত থেকে ছেলেকে ছাড়ানোর চেষ্ট করতে করতে বলল
-কি করোছেন ? ছলের গলাততে হাত ছাড় । ওর দম বন্ধ হয়া যাবি তো । ছাড়তো....
স্বামীর হাত থেকে ছেলেকে ছাড়ানোর ব্যার্থ চেষ্টাই চালালো সে । আলিমের শক্ত হাত থেকে ছেলেকে ছাড়াতে পারলো না কোন ভাবেই । বরং শক্ত হাতের ঝঁটকায় পড়ে গেল মাটিতে । এদিকে মাটির দেয়ালে ঠেস দিয়ে রাখা ছেলের বুক ও পেটের উপর এলো পাথাড়ি লাথি মারতে লাগলো আলিম মিয়া ।
হঠাৎ সে খেয়াল করলো দেয়ালের সাথে ঠেসে ধরা ছেলের শরীরটাকে আর সহজে ধরে রাখতে পারছে না সে । একবার “ মা’’ বলেই মাটিতে পড়ে গেল নিস্তেজ শরীরটা ।
স্বপনের অসাড় শরীর পড়ে আছে দেয়াল ঘেসে । আলিমের এবার হুস ফিরলো । সে চমকে উঠে বলল
-অ্যা !স্বপন কি হছে বা ? কি হছে তোর ?
স্বপনের শরীরটাকে এবার সত্যিকারের স্নেহময় বাবার মত জাঁপটে ধরে বেশ মমতা মাখা কন্ঠে নরম সূরে আলিম মিয়া বলল
- বাজান স্বপন ! কতা ক বা । কতা ক । কি হছে তোর ?
স্বপনের মুখে স্নেহের পরশ মাখাচ্ছে আলিম মিয়া । কিন্তু তার আদর ও ভালবাসায় এতটুকু সাড়া নেই স্বপনের ।অসাড় শরীর অসাড়ই পড়ে রইলো । আলিম মিয়া এবার খুব উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো ।স্বপনের মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল
-এক গেলাস পানি নিয়ে আয় তো।
স্বপনের মা দৌড়ে এক গ্লাস পানি নিয়ে আসলো । স্বপনের বাবার হাতে পানির গ্লাস দিতে দিতে বলল -
-কি হছে ? মোর স্বপন কতা কছে না ক্যা ? কি হছে ?
আলিম মিয়া বউয়ের কথায় কর্ণপাত না করে দ্রুত ছেলের মুখে পানি ছিটাতে লাগল । না এবারও কোন সাড়া নেই । আলিম মিয়া এবার পাজা কোলা করে ছেলের শরীরটার অর্ধেকটা নিজের কোলে উঠালো । স্বপনের মুখটা হাত দিয়ে চেপে ধরে কিছুটা ফাঁক করে নিজের মুখ দিয়ে বাতাস দিল বেশ কয়েক বার । না এতেও কোন সাড়া নেই। তবে কি..... ?
আলিম মিয়া ছেলের জ্ঞান ফেরানোর জন্য আর কোন পদক্ষেপ নিতে পারলো না । ছেলের পাশেই দু হাতে নিজের মাথা চেপে ধরে ধপাস করে বসে পড়লো । আলিম মিয়ার স্ত্রী আর কোন প্রশ্ন করলো না আলিমকে । এবার সে স্বপনের নিস্তেজ শরীরটাকে আঁকড়ে ধরে গলা ফাঁটানো স্বরে বলতে লাগলো
-স্বপন !স্বপনরে ......কি হল বা...?
আলিম মিয়ার মা এ সময় কথা ছুটে আসল । দ্রুত ছেলের বউয়ের মুখ চেপে ধরে বলল
-চুপ কর বউ। চুপ কর ।
তারপর আস্তে আস্তে মৃদু স্বরে স্বপনের মাকে বলল
-ব্যাটার সাথে সাথে কি স্বামীকোও হারাবা চাস ? চুপ কর । চুপ কর । তাহলে সংসার চালাবি কে ? মানুষ জানাজানি হলে তোরিই ক্ষতি ।
আলিম মিয়া লোকটা খুব একটা খারাপ লোক নয় । গ্রামের সবাই তাকে ভাল লোক বলেই জানে । কিন্তু রাগ উঠলে বেচারা হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে । কি করে না করে সে ব্যাপারে কোন হুস থাকে না ।
পরদিন সকাল বেলা আলিমের বাসায় অনেক লোকের সমাগম ঘটলো । আলিমের স্ত্রীকে ঘিরে মহিলা ও বাচ্চারা দড়িয়ে আছে । অলিমের স্ত্রী কাঁদছে আর নাঁকি সূরে বলছে
-ও মোর স্বপন ! বা....জান তুই ক্যান গ...লাত দড়ি দিলু বা ? ও বাজান । ক্যা...ন গ..লাত দ..ড়ি দিলু ?
কিছুক্ষণ দম নিল । যেন অনেক ক্ষণ কান্না কাঁটি করে বেচারা বেশ হাঁপিয়ে উঠেছে । আবার বলতে লাগলো সূরে সূরে
-বা...পে না হয় এ্যানা চ..ড় মারি...ছে । তাই ব...লে গ..লাত দড়ি দিবা নাগবি বা ? ও বাপ রে .....
ও দিকে অলিম মিয়া গ্রামের কয়েক জন গন্য মান্য লোক নিয়ে থানায় গেছে । ছেলের গলায় দড়ি দেয়ার বিষয়টা নিয়ে থানায় অগে থেকে বলে রাখতে । যাতে পরে কোন ঝাঁমেলা না হয় ।
অলিমের বাড়ির গোয়াল ঘরের ছাদের সঙ্গে টাংঙানো দড়িতে ঝুলছে স্বপনের অসহায় নিস্পাপ শরীরটা । যা অনেক দিন এই পৃথিবীর আলো বাতাসে বেড়ে উঠে হয়তো শত বছর বাঁচার স্বপ্ন দেখেছিল । খেলা ছলে বন্ধুদের সাথে যেভাবে বট গাছের লতায় দোল খেত স্বপন; এখনও যেন সে ভাবেই বাতাসে দোল খাচ্ছে তার নিস্তেজ প্রাণহীন দেহটা ।