পূর্বসূত্র: বাংলা চলচ্চিত্র ধর্ষণের প্রতিবাদে!
১/১২/১৩ তারিখে 'সেলিব্রেটিং লাইফ ফিল্ম মেকিং ওয়ার্কশপ' নিবেদিত 'ফিল্ম স্ক্রিনিং' দেখতে চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমীতে গিয়েছিলাম। এক সময় ওখানেই আবৃত্তি চর্চা করতাম। এই প্রিয় প্রাঙ্গণে সময় কাটাতে খুব ভালো লাগে। তাই দেশীয় মুভির প্রদর্শনী হচ্ছে জেনে ছুটে গিয়েছিলাম। খুব তৃপ্তি নিয়ে যে ফিরে আসবো সেটা কিন্তু আগে ভাবিনি। প্রত্যাশা কম ছিল বলে না, উপাদেয় উপাদান বেশি ছিল বলেই এই তৃপ্তি। একই মুভিমালা আমি পরপর দুটো শোতে দেখেছি। একবার বেলা ২টার শো, আরেকবার বিকাল ৪টার। শেষের শোটাতে যখন বিদ্যুৎ বিভ্রাট হলো, অনেকে হল ছাড়লেও আমি অন্ধকারেই অপেক্ষায় ছিলাম, শো ফের শুরু হওয়ার। মুভি দেখতে ক্লান্তি কিসের বলুন? তাছাড়া শর্ট ফিল্ম একবার না, কমপক্ষে দুই বার দেখতে হয়!
মোট ছয়টি শর্ট ফিল্ম দেখানোর কথা ছিল কিন্তু পাঁচটি দেখানো হয়েছে। '২বি' শিরোনামেরটা কেন দেখানো হয়নি জানি না। পরপর যে পাঁচটি ওয়ার্কশপ মুভি বা এক্সপেরিমেন্টাল ছবি দেখানো হয়েছে সেগুলো হলো- আ টেলিভিশন ভাইরাস, কাঠ গোলাপ, কানা মাসুদ, জোকের তেল এবং এক্সোটিক। সেদিন ঘরে ফিরেই মুভিগুলোর রিভিউ লিখেছিলাম। গেল দিনগুলোতে ব্লগে পোস্ট করার মুড হয়নি। আজ মুড হলো, পোস্ট সংখ্যা বাড়ানোর ঝামেলায় না গিয়ে সবকটি নিচেই দিয়ে দিলাম!
পাঁচটি মুভি রিভিউ
মুভি: আ টেলিভিশন ভাইরাস (A Television Virus)
সময়: ৩৪:০০ মিনিট
একজন মানুষ একটি ইলেকট্রনিক্স দোকানের লিফলেট বিলি করছে। লিফলেটে টিভির যে কোন সমস্যা শতভাগ গ্যারান্টিতে ঠিক করে দেয়ার নিশ্চয়তা দেয়া আছে। বিনিময়ে লিফলেট বিলিকারী সেই দোকান থেকে নিয়মিত বান্ডিল করে টিভি রিমোট নিয়ে আসে। কি কাজ তার এতো রিমোট দিয়ে?
পাশ্চাত্যের ইন্ডিপেন্ডেট শর্ট মুভিগুলোর একটি বড় অংশ হরর থিমের। টেলিভিশন ভাইরাস তেমন নির্দিষ্ট ঘরানার মুভি না। এখানে প্রাচ্যের ঢঙে গোথিক থিমের সঙ্গে সাইকোলজিকাল থিমের সুস্বাদু মিশেল হয়েছে। ATV-কে বলা যায় সুপার ন্যাচারাল সাইকোলজিকাল থ্রিলার। মুভির ধরণ অনুসারে এটা খুব ভালো প্রচেষ্টা। এই মুভিটি দেখতে গিয়ে ইন্ডিয়ার 13B (২০০৯) মুভিটির কথা মনে পড়ে গেছে। আশা করি ATV-র পরিচালক মাধবন অভিনীত 13B দেখেছেন।
চলচ্চিত্রে রং, আলো-ছায়া ও আবহসঙ্গীতের ব্যবহার অবশ্যই 'ব্যবহারিক' হতে হবে। মানে প্রয়োজন মাফিক। এসবের যে কোনটির মাত্রার তারতম্য দৃষ্টিকটু ও শ্রুতিকটু লাগবে। ATV-র এই তিনটি বিষয়ে আমার প্রতিক্রিয়া সামান্য মিশ্র।
মুভির গল্পটি আকর্ষণীয় ছিল। তাছাড়া ক্যামেরার সৃষ্টিশীল ব্যবহার তথা শট টেকিংয়ের নান্দনিক ভঙ্গি ভালো লেগেছে। মুভির টাইম ফ্রেমে যেহেতু কোন কার্পণ্য করা হয়নি তাই মূল চরিত্রের সমস্যার সূত্রপাতে আরেকটু সময় দেয়ার দরকার ছিল। টিভি যন্ত্রটির প্রতি তার ভালবাসাটা আরও স্পষ্ট করা হলে ইমোশনাল অ্যাটাচমেন্ট বাড়ত।
ATV-র কাস্টিং, চিত্রনাট্য, পরিচালনা, প্রধান অভিনেতার পারফরমেন্স প্রশংসনীয়। এডিটিংয় ও টাইটেল ডিজাইনের কাজ দারুণ হয়েছে। একটি বিশ্বাসযোগ্য 'স্পেশাল ইফেক্ট' আছে মুভিটিতে, যা কিনা আবার 'টুইস্ট' বা 'চমক'!
আচ্ছা পরিচালক, কাকাকে এতো ডাকাডাকির পরেও যেখানে তার ঘুম ভাঙল না সেখানে টিভি টেনে নিয়ে যাওয়ার সময় সামান্য শব্দের উৎপত্তিতে ঘুম ভাঙল কেন? বিব্রত হবেন না। কেউ জিজ্ঞেস করলে একটু ভারিক্কি চালে বলে দিয়েন- ঘুম তখন ডেল্টা লেবেল থেকে থেটা লেবেলে নেমে গিয়েছিল!
রেটিং: ৪/৫
ক্রিটিক'স কাট: ৩.৫/৫
মুভি: কাঠ গোলাপ (Kath Golap)
সময়: ৪:১৭ মিনিট
চলচ্চিত্রের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো কাস্টিং। এই কাজটি শর্ট বা এক্সপেরিমেন্টাল মুভির ক্ষেত্রে একটু বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এখানে স্টার পাওয়ারের কোন কারিশমা নেই। তাই বলে যাকে তাকে ধরে এনেও কাজ চালানো যায় না। অভিনয়ে কোন হাতেখড়ি নেই তেমন কুশীলব দিয়ে ছবি বানাতে হলে পরিচালককে অবশ্যই আনকোরাদের থেকে অভিনয় বের করে আনার দক্ষতা ও ক্ষমতা থাকতে হবে। এক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাস ঘাটতি থাকলে অভিনয় জানেন কিন্তু অপেশাদার তেমন আর্টিস্ট নেয়া নিরাপদ।
স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবিতে যেটা করা সুবিধাজনক বলে মনে করি তা হলো, পরিচিত মুখ ও টাইপ কাস্টদের এড়িয়ে যাওয়া। কাঠ গোলাপে এটা করা হয়নি, ভুল হয়ে গেছে। স্বামী-স্ত্রী চরিত্র দুটি টাইপ কাস্ট হয়ে গেছে।
শুধু যৌনকর্মীটির মেকআপ না, অন্য চরিত্রের মেকআপেও নজরদারির দরকার ছিল। অসুস্থ স্বামীটিকে অসুস্থ মনে হয়নি। স্ত্রীর সংলাপ হয়েছে হুমায়ূন আহমেদ স্টাইলের। একে 'হুমায়ূনি টাইপ কাস্ট' তার ওপর 'হুমায়ূনি সংলাপ' - শর্ট ফিল্মের জন্য আভিজাত্যহীন। পরীক্ষামূলক কাজে 'জনপ্রিয় ধারা' পরিহার করা ভালো। আমি তো মনে করি কোন সংলাপই প্রয়োজন ছিল না এই ছবিটিতে।
শর্ট ফিল্ম হচ্ছে মূলত থিম নির্ভর, আর থিম 'ডিটেল' নির্ভর। এই ছবির 'ডিটেলে' কাজ করার প্রয়োজন ছিল। ছবিটি দৈর্ঘ্যে বেশি ছোট। ফুল ফোটার আগেই যেন উবে গেল। গন্ধ নেয়ার সময় পেলাম না। এই ফুলের হয়তো গন্ধ নেই। কিন্তু শুঁকতে তো দিতে হবে! ছবির মূল থিমটি জীবন-ঘনিষ্ঠ, প্রচেষ্টার জন্য সাধুবাদ।
মুভি রেটিং: ৩/৫
ক্রিটিক'স কাট: ২.৫/৫
মুভি: কানা মাসুদ (Kana Masud)
সময়: ১১:০০ মিনিট
মাসুদের এক চোখ 'কানা'। তাই সে চোখে একটা কালো চশমা পড়ে। সে লালবাগ কেল্লার 'গাইড'। খদ্দেরকে কেল্লা ঘুরিয়ে দেখাতে দেখাতে আংশিক সত্য ও আজগুবি তথ্যের মিশ্রণে ইতিহাসের ধারা বর্ণনা করে। সে দুঃখী, কারণ কেল্লার দেয়ালে নিজের নামের সঙ্গে যোগ (+) চিহ্ন দিয়ে কার নাম লিখবে খুঁজে পায় না। আহারে! হঠাৎ কেল্লাতে একাকী একটি মেয়েকে দেখে সে। মেয়েটি একটু অন্যরকম। কি রকম?
বেশ কয়েক বছর আগে পুরনো ঢাকার চকবাজারে মাসখানেক ছিলাম। তখন লালবাগ কেল্লায় একাধিক বৈকালিক ভ্রমণে কখনও কোন গাইড দেখিনি। এখন গাইডের উৎপত্তি হয়েছে নাকি? যা হোক, 'কানা মাসুদে' লালবাগ কেল্লার দৃশ্যায়ন দেখে আমি নস্টালজিক হয়ে পড়েছিলাম! লালবাগের ক্যানভাসে কালো চশমার কালো বর্ণের কানা মাসুদের দিকেও চোখে আরাম নিয়ে তাকিয়ে থাকা যায়। লোকেশন সুন্দর হলে কোন কোন পরিচালক ডিসকভারি চ্যানেলের লোক হয়ে যান। স্থানের সৌন্দর্য প্রদর্শনে মগ্ন হয়ে পড়েন বেশি। কিন্তু কানা মাসুদের পরিচালক যথেষ্ট পরিমিতি জ্ঞানের পরিচয় দিয়েছেন। ধন্যবাদ।
কেল্লাতে দেখলাম বায়োস্কোপ এসেছে। বায়োস্কোপ দেখনেওয়ালা শিশুবৃন্দ মাসুদকে আসলেই টিটকারি করলো কিনা বোঝা গেল না। ঘটনা অস্পষ্ট। ইমোশনাল টাচ মিসিং। অন্যদিকে বায়োস্কোপওয়ালার হৃদপিণ্ডের দামামা চেহারায় ধরা পড়ে গেছে, মুভিতে প্রথম অভিনয়ের কারণে হয়তো। রিটেক প্লিজ!
এই মুভিতে আমার প্রিয় দৃশ্যটি এমন: আজান হচ্ছে, অন্য মেয়েরা মাথায় কাপড় দিচ্ছে, এই মেয়ে দেয় না কেন? মুভির শেষে একটা 'টুইস্ট' আছে। বিশ্বাস করুন, হলের জনতা আগে থেকে তা মোটেও আঁচ করতে পারে নাই। টুইস্ট সার্থক।
আচ্ছা পরিচালক, কেল্লার ভেতরে কি সাইকেল চালানোর ব্যবস্থা আছে? মুভির একটি চরিত্রকে দেখলাম টিং টিং করে বেল বাজিয়ে সাইকেল চালাচ্ছিল! ঘটনাটা কি?
মুভি রেটিং: ৩.৫/৫
ক্রিটিক'স কাট: ৩/৫
মুভি: জোঁকের তেল (Joker Tel)
সময়: ১০:০০ মিনিট
সিনেমা হলের সামনের ক্যানভাসার লোকটি এমন ওষুধ বিক্রি করেন যা পুরুষের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়, যেমন-তেমন ওষুধ না- বিশেষ শক্তিবর্ধক ও নারী বশীকরণ ওষুধ। এই ওষুধের গুণ হলো মেয়ে ছেলের জালে বাধা পড়বে, আজীবন ছেলের সেবা করে যাবে, পুরুষ তার নামের স্বাক্ষর রাখতে পারবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। এই ওষুধ কারও প্রয়োজন হলে বিস্তারিত পত্রিকায় দেখুন। আমাদের ক্যানভাসার সাহেব নাকি আবার পত্রিকায় (কোন পত্রিকা? মানবজমিন?) বিজ্ঞাপন দেন। যুবক ভাই ও ছাত্র বন্ধুদের জন্য মূল্য হ্রাস আছে। জোঁকের তেল কেমন কাজে দেয় সেটা মুভিতেই দেখানো হয়েছে।
ক্যানভাসিংয়ের ফাঁকে ফাঁকে ঝাল মুড়ি বানানোর কায়দা-কানুন দেখিয়ে আমাদের অখণ্ড মনোযোগ ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন পরিচালক। কারণ বাঙালির দুইটা জিনিসে খুব আগ্রহ, রাস্তার পাশের ক্যানভাসিং ও খাবারের রেসিপি। এই মুভির প্রথম দৃশ্যে দুটোই আছে। শিক্ষিত-অশিক্ষিত বাঙালির আরেকটা প্রবল আগ্রহের বিষয় হলো গালিগালাজ। এই মুভিতে চাহিদাসম্পন্ন গালিগালাজ আছে। ভাগ্য ভালো আমাদের দেশে প্যারেন্টাল গাইডেন্স রেটিং নাই। থাকলে এই মুভি নির্ঘাত R (Restricted) রেটিং পেত। ভাগ্য ভালো এই মুভি বাণিজ্যিক মুক্তি না হওয়ার কারণে সেন্সর বোর্ডে যাই না। গেলে পরে একটি দৃশ্যে শুধু 'বিপ' 'বিপ' 'বিপ' শুনতাম।
সবার চোখে না পড়তে পারে, কিন্তু একটা দৃশ্যের অযত্নের ছাপ আমার চোখে লেগেছে। পথের ধারের ভাসমান দোকান থেকে ক্যানভাসারের কেনাকাটার দৃশ্যে অনতিদূর থেকে হেঁটে আসা মানুষ ক্যামেরাকে দেখে জলদি এক পাশে সড়ে যাচ্ছে, দুই বার এমনটা হয়েছে। এটা খুব ছোটখাটো বিষয় হলেও পরিচালককে এমন ছোটখাটো বিষয়েও নজর দিতে হয়। কারণ এই ব্যাপারটা ফলে মুভির প্রোডাকশন ভ্যালু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমি যখন কোন মুভি দেখি, আমি চাই না আমার মাথায় থাকুক যে আমি কোন মুভি দেখছি। তাই এমন কিছু চোখে পড়লে মুভি দেখার আমেজে বিঘ্ন ঘটে।
জোঁকের তেলের প্রধান অভিনেতা ভালো কাজ করেছেন। বাস্তব অভিজ্ঞতা ছাড়া ক্যানভাসিংয় অতো সোজা না। স্ক্রিন টাইম স্বল্প হলেও নারী চরিত্রটির কথা বিশেষ করে না বললে হচ্ছে না। চরিত্রটিতে যে ধরণের দৃঢ়তা ও স্টোন ফেসের প্রয়োজন ছিল সেই প্রয়োজন মিটেছে।
জোঁকের তেল নামটা প্রদর্শনীর ব্যানারে ইংরেজিতে Joker Tel দেখে প্রথমে ভেবেছিলাম 'জোকার টেল' কিনা। ভাবনাটা মনে হয় মন্দ হয়নি, ক্যানভাসাররা জোকারদের চেয়ে কম কিসে?
মুভি রেটিং: ৩.৫/৫
ক্রিটিক'স কাট: ৩/৫
মুভি: এক্সোটিক (Exotic)
সময়: ১৩:৪০ মিনিট
এক্সোটিক মুভিটি দেখে আমার প্রথমে যার কথা মনে হয়েছে তিনি হলেন জনাব মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। ফারুকী সাহেব যে ধরণের ছবি (দ্রষ্টব্য: ব্যাচেলর, থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার) বানাতে আগ্রহী এই মুভিটি ঐ ধারায় পরে। নর-নারীর দৈহিক সম্পর্ক যেখানে উপজীব্য। কিন্তু ফারুকী সাহেব যেখানে ব্যর্থ হয়েছিলেন এক্সোটিক সেখানে সফল হয়েছে। মি. ফারুকী হয়তো বলবেন, 'আরে এরা তো আমার থেকে দেখে শিখেছে!'। বুঝলাম। কিন্তু আপনিও নিশ্চয় কারও থেকে দেখে শিখেছেন! এরা তো ঠিক ভাবে শিখল, আপনি শিখলেন না কেন? পরিচালকের সামাজিক দায়বদ্ধতা এড়িয়ে যান কেন? না ফারুকী সাহেব, আপনার ক্রেডিট আমি অস্বীকার করবো না! ছেলে-মেয়েরা নিশ্চয় আপনার কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছে। তারা গণহারে 'লিটনের ফ্ল্যাটে' যাওয়া শিখেছে। 'লিভ টুগেদারে' উৎসাহী হচ্ছে। মুখের ভাষা জগাখিচুড়ী মার্কা ও খিস্তি-খেউরে সমৃদ্ধ হয়েছে। আপনি তরুণ সমাজের উগ্র-আধুনিকতার রূপকার। আপনার ঋণ আমরা অস্বীকার করতে পারি? আপনি আবার ক্রেডিট গ্রহণে পিছপা হবেন না যেন!
এক্সোটিক একটি সাহসী পদক্ষেপ। হাল ফ্যাশনের আধুনিক ছবি। এক জোড়া কপোত-কপোতী (পড়ুন: প্রেমিক-প্রেমিকা) হন্য হয়ে খুঁজছে একটা নির্জন জায়গা। কেন? পাল্টা প্রশ্ন করি, কপোত-কপোতী নির্জন জায়গা কেন খোঁজে? তাদের কথা শুনে মনে হলো এমন অভিযান প্রায় হয়; সবসময় নাকি মেয়েটি জায়গা 'ম্যানেজ' করে। কিন্তু আজ পূর্ব নির্ধারিত স্থান ফসকে গেছে। এখন কী হবে? না করে যে উপায় নেই! দৈহিক চাহিদা বলে কথা।
এই পরিচালক সংলাপের পাশাপাশি ছবির ডিটেলেও নজর দিয়েছেন। খাসা কাজ করেছেন। আরে নাটক হচ্ছে সংলাপ নির্ভর। ছবিতে থাকতে হবে ডিটেল। অনেক পাঠক হয়তো ভাবছেন এই 'ডিটেল' আবার কি জিনিস? একটু সাধারণ করেই বলি- ধরুন, দিশেহারা কপোত-কপোতী ভাবছে এখন কি করা যায়? চিত্রনাট্যকারের ইচ্ছা চরিত্রযুগলকে হোটেলে নিয়ে যাবেন। এটা দুই ভাবে করা যায়। এক. নায়ক বা নায়িকা সংলাপে বলছে, 'চল হোটেলে যাই'। দুই. সংলাপ উহ্য রেখে নায়ক-নায়িকার মাঝখানে হঠাৎ চোখে পড়ার মতো করে 'হোটেল সোহাগের' নাম ফলকটি প্রদর্শন করা যেতে পারে। এখানে চরিত্রের মনের ভাব ও পরবর্তী অ্যাকশন ঐ সাইন বোর্ডে প্রকাশ পেয়ে গেছে। তাই সংলাপ বাহুল্য হয়ে গেল।
এক্সোটিকের শেষটা আন্দাজ করতে পেরেছিলাম। কিন্তু আন্দাজটা সত্য হওয়ার আগে-পরে চমকের রসদ আছে! কপোত-কপোতীর একান্ত অন্তরঙ্গ মুহূর্তগুলো খুবই সতর্কতা এবং দক্ষতার সাথে চিত্রায়ন করা হয়েছে। শর্ট নির্বাচনে খুব একটা ভ্রান্তি হয়নি।
শেষের দৌড় দৃশ্যটার ব্যাপারে একটু বলি। এই ট্র্যাকিং শটটি দেখে আমার ফ্রাঁসোয়া ত্রুফোর The 400 Blows (১৯৫৯) ও লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও অভিনীত Revolutionary Road (২০০৮) মুভি দুটির কথা মনে পড়ে গেছে। আশা করি এক্সোটিক পরিচালক মুভি দুটি দেখেছেন।
এই ধরণের ছবি করতে সত্যিকারের কপোত-কপোতীর প্রয়োজন হতে পারে। আচ্ছা পরিচালক, এই কপোত-কপোতী জোড়া কি সত্যিকারের? সেক্ষেত্রে বাস্তব অভিজ্ঞতা অভিনয়ের পূর্বশর্ত ছিল কি?
রেটিং: ৪/৫
ক্রিটিক'স কাট: ৩.৫/৫
শর্ট ফিল্ম পাঁচটি বানিয়েছেন: ধীমান, হাসান ও সিদ্দিক (আ টেলিভিশন ভাইরাস), মিজানুর রহমান বিপ্লব (কাঠ গোলাপ), হুমায়রা বিলকিস (কানা মাসুদ), মাহফুজা আকতার (জোঁকের তেল), রিয়াদ আরফিন (এক্সোটিক)।
নির্বাহী প্রযোজক ছিলেন: বিটপী দাস চৌধুরী এবং রাফি হোসেন।
কোর্স/ওয়ার্কশপ পরিচালনা করেছেন: নূরুল আলম আতিক, অমিতাভ রেজা এবং মেজবাউর রহমান সুমন।
আয়োজনে: স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক ও দি ডেইলি স্টার
লক্ষণীয়, এই প্রথম একই মুভির দুই ধরণের রেটিং দিয়েছি। 'মুভি রেটিং' বিবেচনা করবেন দর্শক/পাঠকবৃন্দ। 'ক্রিটিক'স কাট' বিবেচনা করবেন 'পরিচালক/নির্মাতাবৃন্দ'। এখানে 'মুভি রেটিংয়ের' কাজ হচ্ছে দর্শকদেরকে একই সঙ্গে মুভিটির গুণগত মান ও দেখা না দেখার বিষয়ে পরামর্শ দেয়া। অন্যদিকে, 'ক্রিটিক'স কাট' হচ্ছে নির্মাতাদেরকে তাদের কাজের বিশ্লেষণের পর প্রদত্ত স্কোর/রেটিং, যেন তারা এই রেটিংয়ের ভিত্তিতেই নিজেদের কাজের/আত্মমূল্যায়ন করতে পারে।
প্রিয় নির্মাতাবৃন্দ, আপনাদের সবার কাজ আমি ঠিক ততোটা মনোযোগ দিয়ে দেখেছি, যতোটা মনোযোগ দিয়ে প্রিয় ডিরেক্টরদের কাজগুলো দেখি। আপনাদের কাজ নিয়ে আমার মুগ্ধতা আগেই প্রকাশ করেছি। কিন্তু শুধু মুগ্ধতার কথা বললে তো স্তুতি হয়ে যায়, তাই রিভিউতে নির্মোহভাবে আপনাদের কাজের গঠনমূলক আলোচনা করেছি। সংক্ষেপে আরও দুটি কথা উল্লেখ না করলে রিভিউ অসম্পূর্ণ থেকে যাচ্ছে।
ডিজিটাল মাধ্যমে কাজ করলে ছবির 'সিনেমাটিক লুকের' জন্য এডিটিংয়ে বিভিন্ন ইফেক্টসের আশ্রয় নিতে হয়। অর্থাৎ কালার বা রং নির্বাচনের ব্যাপারটা এসে যায় যা। 'ফিল্ম' মাধ্যমেও রঙের ব্যাপারটা সমান গুরুত্বপূর্ণ। যা হোক, মুভির 'সিনেমাটিক লুক' দিতে গিয়ে যে কালার টোন ব্যবহার হবে সেটি যেন সংশ্লিষ্ট ছবির টোন বা সিনেমার ভাষার সঙ্গে অবশ্যই সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। দ্বিতীয় কথাটি হলো, মুভির আবহসঙ্গীত। সবকটি মুভিতে দেখলাম প্রচুর ইলেকট্রনিক মিউজিক ব্যবহার করা হয়েছে। শব্দহীন সময় খুব কম। ইফেক্ট সাউন্ড ব্যবহারে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। মুভিগুলো দেখতে দেখতে আমার মনোযোগ প্রায় মিউজিকে চলে যাচ্ছিল। মুভি উপভোগ করতে বসে কেউ যদি মিউজিক উপভোগে মশগুল হয়ে পড়ে সেটা খুবই ভয়ংকর কথা! শাক দিয়ে মাছ ঢাকার অপবাদও চলে আসতে পারে। ছবি যে আবেগ তৈরি করতে পারছে না সেই আবেগ মিউজিক দিয়ে তৈরি করে ছবির দুর্বলতা পূরণের চেষ্টা কোন সিনেমাটিক অ্যাচিভমেন্ট বলে বিবেচিত হয় না। তাই মিউজিক ব্যবহারে ভীষণ সাবধানতা ও পরিমিতি বোধের পরিচয় দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, মিউজিকের বেমানান ব্যবহার একটি ভালো ছবিকে নষ্ট করে দিতে পারে। চলচ্চিত্রে মিউজিকের কাজ হচ্ছে ঘনীভূত আবেগকে জমজমাট করা, কখনও প্রয়োজনীয় মুড সৃষ্টি করা। সেলফ প্রমোশন বা মুভির ত্রুটি-বিচ্যুতি ঢাকা মিউজিকের কাজ না।
দুটি প্রাসঙ্গিক ছোট ঘটনা বলে এই লেখাটি শেষ করি। এই মুভি প্রদর্শনী শেষে যখন হল থেকে বের হলাম, তখন এক ভদ্রযুবক বললেন- 'এটা কি হলো ভাই! ছবি অর্ধেক অর্ধেক দেখিয়েছে? পুরো ছবি দেখায়নি কেন?' বুঝলাম বেচারা এ জাতীয় মুভির নয়া দর্শক। আমার তখন খুব মজার একটি কথা মাথায় এসেছিল! সেটা বলা থেকে নিজেকে বিরত রেখা বললাম, 'না তো ভাই, পুরো মুভি দেখিয়েছে। এগুলোকে বলে শর্ট ফিল্ম'। । এরপরে ওনার প্রশ্নটি ছিল- 'এগুলো কেন বানায়?' আমি হাসবো না কাঁদবো সেই চিন্তা বাদ দিয়ে বললাম, 'ভাই এই ছবিগুলো বানানোর প্রধানতম কাজ হচ্ছে মুভি নির্মাণে হাত পাকানো। চলচ্চিত্র নির্মাণে যারা নতুন তারা এগুলো বানাচ্ছে। অনেকে বানায় বড় ছবি বানানোর বাজেট স্বল্পতার কারণে। কেউ কেউ শুধু শর্ট ফিল্ম বানাতেই মজা পায়। এই স্বল্প দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র নির্মাতাদের কয়েকজন একদিন পূর্ণ দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র বানাবে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ হবেন বড় ডিরেক্টর'। শর্ট ফিল্ম নিয়ে আমার এই শর্ট স্পিচে ভদ্রযুবক মনে হয় সন্তুষ্ট হলেন। তিনি হাসিহাসি মুখ করে মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন 'আচ্ছা বুঝছি'। আমি বললাম, 'শুধু 'আচ্ছা বুঝছি' বললে হবে না। আমাদের উচিত এদের লক্ষ অর্জনে পাশে থাকা।' ভদ্রযুবক, 'কিভাবে?'। আমি, 'এই যেভাবে আপনি একটু আগে করলেন, আমরা এখন করছি - নতুন নির্মাতাদের চলচ্চিত্র দেখে এবং সেই চলচ্চিত্র নিয়ে আলোচনা করে'।
দ্বিতীয় ঘটনাটি মাসখানেক আগে সেই শিল্পকলা প্রাঙ্গণেরই কথা। এক তরুণ চলচ্চিত্রকর্মীর সঙ্গে পরিচয় শেষে আলাপ হচ্ছে। তার সারাদিনের শুটিংয়ের গল্প শেষে বললো, 'সামির ভাই, আমার কাজগুলো আমি বাংলাদেশে দেখাবো না। এখানে দেখালে সমস্যা আছে। শর্ট চুরি হয়। আইডিয়া চুরি হয়। আমার কাজ বিদেশের ফেস্টিভ্যালে পাঠাবো। ফ্রান্সে পাঠাবো। একদিন কান পুরষ্কার পাওয়ার ইচ্ছা আছে। আমাদের এখানে লোকে ছবি বোঝে না।' ছেলের কথা শুনে একটা ধাক্কা খেলাম! তার সামগ্রিক কথায় কিছু ছেলেমানুষি চিন্তা দেখে মর্মাহত হলাম। কিন্তু সদ্য পরিচয় দেখে তখন কিছু বললাম না। আজ বলি; তার ছবি নাক-কান-গোয়া-বার্লিন-পুসান জিতুক। এটা তো কোন সমস্যা না, দেশের গর্ব। কিন্তু কোন দেশের গর্ব? যে দেশকে সে নাক সিটকচ্ছে? যে দেশের দর্শকদেরকে সে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করছে? চেতনার কোথাও একটা বড় ধরণের সমস্যা আছে, বড় ধরণের গলদ! দেশের এক তরুণ চলচ্চিত্রকর্মীর মুখে তো দেশবিমুখতা শোভা পায় না! নিজের কথা ভাবি। এই যে আমি ব্লগে লিখছি, আমার ভালো লেখাগুলো কি সবার কাছে সমান বোধগম্য হয়? সব সময় কি সমান কদর হয়? তবু এখানে লিখি। কারণ আমি ব্লগিংটাকে ভালবাসি, এই ব্লগটাকে ভালোবাসি। এখানে যারা আসেন, তাদেরকে পছন্দ করি। তিন বছর আগে যে লেখার পাঠক ছিল না এখন সে লেখার পাঠক হয়েছে। লেখকের লেখার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পাঠকের মানও বাড়ছে। তেমনি চলচ্চিত্র দর্শকদেরও মান বাড়ছে। নির্মাতাদের এটা খেয়াল করতে হবে। শুধু বিদেশী বাহবা পাওয়ার জন্য ছবি বানানোর দিন শেষ। দেশের দর্শকদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে হলে দেশের দর্শকদেরকে টার্গেট করেই ছবি বানাতে হবে। নয়তো দেশ আর আপনার মাঝে কোন সম্পর্ক থাকবে না। সামনে দেশের চলচ্চিত্র শিল্পে যে প্রতিযোগিতা আসছে, যে হাওয়া বদল হচ্ছে এখন- সেই হাওয়ায়, সেই প্রতিযোগিতায় টিকতে হলে, এখানে জায়গা করে নিতে হলে নাক-কান-গোয়া-বার্লিন-পুসানের পুরষ্কারের চিন্তায় বিভোর না হয়ে বাংলাদেশের কথা ভাবুন, বাংলাদেশের জন্য ছবি বানান। কতো হাজার লোক আপনার ছবি দেখেছে সেটা বিবেচনা না করে, যারা দেখছে তারা উপভোগ করছে কিনা বিবেচনা করুন। ছবি ভালো হলে দর্শক অবশ্যই পাবেন। ছবি খুব 'হাই থটের' হলেও দর্শকের অভাব হবে না। কারণ আমরাও ইদানীং কিভাবে কিভাবে যেন 'হাই থটের' ছবি বুঝতে শিখে গেছি। আপনি ছবি বানান ভাই, আমাদেরকে দেখান। আপনার ছবি যদি আমরা একান্তই না বুঝি, আপনাকে ফ্রান্সে যাওয়ার টিকেট না হয় আমরাই কিনে দেব!
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই মে, ২০১৩ ভোর ৪:৪৩