নভে. 14, 2013দর্শন,সাইকোলজিফারাহ্ মাহমুদ
ব্রেনওয়াশিং নিয়ে প্রথম বার যখন লিখলাম, তখন ভাবি নি এই ব্যপারে আরো লিখতে হবে। অনেকেই প্রথম লেখাটুকু পড়ার পর আরো ডিটেইলস জানতে চেয়েছেন এ সম্পর্কে। তাই আবারো ব্রেনওয়াশিং নিয়ে লেখা… প্রথম লেখাটিতে আমরা ব্রেনওয়াশিং কী সেই সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা পেয়েছি। এবার আমরা একটু বিশদভাবে জানবো।
একটি ছোট্ট শিশুর কথা কল্পনা করুন, একটি সদ্যোজাত শিশু। ক্ষুধা লাগলে কেঁদে উঠে, একেবারে মৌলিক অনুভূতিগুলো ছাড়া যার আর কোনো অনুভূতি নেই, কান্নাই যার ক্ষুধা, তৃষ্ণা এবং ভীতি প্রকাশের একমাত্র ভাষা। এই শিশুটির মন থাকে সম্পূর্ণ ফাঁকা। সম্ভবত একারণেই শিশুদের তুলনা করা হয় ফেরেশতা কিংবা এঞ্জেলের সাথে। শিশুটি একটু একটু করে বেড়ে উঠতে থাকে, পরিবার ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশ থেকে সে অনেক কিছুই শেখে। তার ফাঁকা মন পূর্ণ হতে থাকে বিভিন্ন অভিজ্ঞতা ও তথ্যে। আমাদের মন আসলে কখনোই পুরোপুরি আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। আমাদের মন ও আমরা যেরকমভাবে ভাবি সেটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রিত হয় আমাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর মাধ্যমে, এবং অবশ্যই আমাদের ধর্মীয় অনুশাসন দ্বারা… রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় জ্ঞান আমাদের জন্য প্রয়োজনীয়। কিন্তু নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেয়ে এগুলো যখন আমাদের মনের উপর নেগেটিভ ভাবে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে, তখনই সেটা ব্রেনওয়াশিং-এ রূপ নেয়।
আমরা প্রায় সবাই এখন পণ্যদাসত্বের শিকার, সকলেই পণ্যদাস। আমরা পণ্য কিনছি নাকি পণ্য আমাদের কিনছে, আসলেই বর্তমানে কোনটা হচ্ছে?! অবাক হওয়ার কিছু নেই। যখনই আমরা প্রচলিত ফ্যাশন ট্রেন্ড মানতে গিয়ে তথাকথিত ফ্যাশন ক্রেজে গা ভাসাচ্ছি তখনই আমরা পণ্যদাসত্বের শিকার হচ্ছি। পণ্য আর আমাদের মালিকানায় থাকে না তখন, বরং আমরাই পণ্যের মালিকানাধীন হয়ে যাই। ভাবতে খুব খারাপ লাগছে নিশ্চয়ই। সৃষ্টির সেরা জীব হবে পণ্যদাস, ভাবা যায়?!!
বিজ্ঞানীরা দীর্ঘ গবেষণার পর এই সিদ্ধান্তে আসলেন যে- ‘মন মস্তিষ্ককে পরিচালনা করে’… একজন প্রোগ্রামার যেভাবে একটি কম্পিউটার পরিচালনা করে ঠিক সেভাবে। মস্তিষ্ক হচ্ছে হার্ডওয়্যার আর মন হচ্ছে সফটওয়্যার। এই মন যখন সংকীর্ণ চিন্তার নিগড়ে বন্দী হয়ে যায়, তখন মস্তিষ্কও তার ক্ষমতা ব্যবহারে অক্ষম হয়ে পড়ে, ক্ষুদ্র চিন্তার নিগড়ে বন্দী হয়ে যায় একজন সম্ভাবনাময় মানুষ। ব্রেনওয়াশিং এমন একটি প্রক্রিয়া যা মানুষের স্বাধীনভাবে চিন্তা করার মানসিক শক্তি নিঃশেষ করে দিয়ে তাকে মানসিকভাবে পঙ্গু করে ফেলে। মানুষের চিন্তা তখন আটকে যায়, অনেকটা কুয়োর ব্যাঙের মতো, কুয়োটাই যার কাছে সম্পূর্ণ জগৎ, এর বাইরে সে আর কিছুই ভাবতে পারে না। ব্রেনওয়াশড মানুষ বেশিরভাগ সময়ই বুঝতেই পারে না যে সে ব্রেনওয়াশিং এর শিকার। এটাই ব্রেনওয়াশিং এর সবচেয়ে ভয়াবহ দিক!
ব্রেনওয়াশিং এর অনেকরকম উদাহরণ দেয়া যায়। যেমন ধরুণ, ফেয়ারনেস ক্রিমের বিজ্ঞাপনগুলো… এরা ঠিক কী মেসেজ দেয়ার চেষ্টা করে আমাদের?! কী করে স্কিন টোন সাদা করা যায়, কী করে চেহারায় যৌবন ধরে রাখা যায়, কী করে ফর্সা কিংবা সাদার চেয়ে সাদা (!) হওয়া যায় এইধরনের মেসেজ। কিন্তু একটা মেয়ে কিংবা একটা ছেলে মেধা এবং জ্ঞান শাণিত করার চেষ্টা না করে চেহারা এবং শরীর শাণিত করার চেষ্টা কেনো করবে?! এর কোনো যুক্তি আছে?! নেই! কিন্তু এই অযৌক্তিক জিনিসগুলোই বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে আমাদের ব্রেনে ইনপুট দেয়া হচ্ছে। এমনকি এই কথাগুলোর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই, এভাবে স্কিন টোন উজ্জ্বল করা কখনোই সম্ভব না, এগুলো রীতিমতো মিথ্যাচার। আমরা এর বিরুদ্ধে কথা বলি না, এমনকি শুনতেও পছন্দ করি না, এগুলো আমাদের কাছে নীতিবাগীশ কথা মনে হয়। এমন ভাবে আমরা ব্রেনওয়াশড! আমাদের এলাকায়-অলিতে-গলিতে পার্লারের সংখ্যার পরিসংখ্যান নিলেই আমরা একথার প্রমাণ পাবো। আহা, শারীরিক সৌন্দর্যের প্রতি কেনো এতোটা মোহ! সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাবের কারণে, যা কখনোই গড়ে উঠতে পারে নি কিছু মানুষের কুমন্ত্রণা দেবার ক্ষমতা ও দক্ষতার কারণে!
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ব্রেনওয়াশিং প্রক্রিয়ার আরেকটি অন্যতম উদাহরণ। আমরা আমাদের বাচ্চাদের কিছু শেখানোর উদ্দেশ্যে কিংবা আলোকিত মানুষ হয়ে গড়ে উঠার দিক নির্দেশনা পাবার উদ্দেশ্যে স্কুলে পাঠাই না। আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের তোতাপাখি বানাতে চাই, তারা কেবল পড়া মুখস্ত করবে, অর্ধেক বুঝে অথবা পুরোটাই না বুঝে… তবু ক্লাসে প্রথম হওয়া চাই। জ্ঞান অর্জন হোক- না হোক সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়ে মেধাস্থানে থাকা চাই। বুঝে-না বুঝে চোখ বুজে আমাদের শুধু চাই। সেরা বিদ্যাপীঠে পড়ানো চাই, পিএসসি, জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসি… সব পরীক্ষায় টপ করা চাই, সেরা প্রতিষ্ঠানের সার্টিফিকেট চাই, সেরা চাকরি চাই… সব কিছুতে আমরা আমাদের বাচ্চাদের থেকে সেরাটা প্রত্যাশা করি। আমাদের দাদা আমাদের বাবার কাছ থেকে সেরাটা প্রত্যাশা করতো, আমাদের বাবাও আমাদের কাছ থেকে সেরাটা প্রত্যাশা করে। আমরাও আমাদের সাধ্য অতিক্রম করতে গিয়ে হতাশ হই, হতেই থাকি, আমাদের পুরো জীবনটাই তখন হয়ে যায় হতাশার কাব্য! কেউ শিখিয়ে দেয় নি আমাদের এভাবে ভাবতে, আমরা নিজেরাই ধারণ করে নিয়েছি এটা আমাদের মেধা ও মননে, ধ্যান ও জ্ঞানে। আমরা প্রবলভাবে ব্যবহৃত। কাদের দ্বারা? যারা চায় না জ্ঞান ও মুক্ত চিন্তার দ্বার সবার জন্য উন্মুক্ত হোক তাদের দ্বারা। যারা আমাদের মৌলিক অধিকারগুলো নিয়ে খেলছে, কৌশলে আমাদের চিন্তাকে সীমাবদ্ধ করে দিয়ে তার ওপর একচোট বাণিজ্য করে নিচ্ছে… সেই মানুষরূপী শয়তানগুলো আমাদের দৈনন্দিন জীবনটাকে জালের মতো ঘিরে রেখেছে ব্রেনওয়াশিং এর অসংখ্য উপাদান দিয়ে। পুরো প্রক্রিয়াটা শিউরে উঠার মতোই ভীতিকর।
আমরা কি চাই ব্রেনওয়াশিং প্রসেসের অংশ হয়ে থাকতে? না, চাই না। আমরা নিজেদের মস্তিষ্ক ব্যবহার করে সামনে এগিয়ে যেতে চাই। তাই আমাদেরকে ব্রেনওয়াশিং এর বিরুদ্ধে এক হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা সব প্রয়োজনে ঢেলে সাজাতে হবে নতুন ভাবে। আমরা যদি সকল অযৌক্তিক বিজ্ঞাপন দেখা এবং সেসকল পণ্য কিনে ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকি, তাহলে সেটা হবে একধরনের প্রতিবাদ। আমরা যদি সৌন্দর্যকে তথাকথিত ছকে না বেধে আলোকিত মানুষ হওয়ার চর্চা শুরু করি, সেটা হবে সঠিক চিন্তা। আমরা প্রতিষ্ঠান দেখে ব্যক্তিকে গুরুত্ব না দিয়ে, তার কর্মকে প্রাধান্য দিতে পারি। আমরা আমাদের শিশুদের ক্লাসে প্রথম হওয়ার বদলে জ্ঞান অর্জন করার দীক্ষা নিতে অনুপ্রাণিত করতে পারি। আমরা সকল প্রকার অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে বিরত থেকে পরস্পরকে সহযোগিতা করতে পারি। আমরা সকলে একজোট হয়ে গড্ডালিকা প্রবাহে গা না ভাসিয়ে, স্রোতের বিপরীতে চিন্তার চর্চা করতে পারি…… যেকোনো কাজ কারো অন্ধ অনুকরণে না করে, কাজটির পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি ভেবে তারপর নিজের মতো করে সেই কাজটি করতে পারি।
মনে রাখতে হবে- ব্রেনওয়াশিং এমন একটি প্রসেস যা অনেক মানুষকে একইরকম ভাবে ভাবতে বাধ্য করে, বিপরীতে বলার মতো কেউ থাকে না। প্রতিটি মানুষেরই মস্তিষ্ক আছে অর্থাৎ নিজস্ব চিন্তা শক্তি আছে, তাই কাউকে অন্ধভাবে অনুকরণ করার কোনো মানে নেই, তবে অবশ্যই যে কারো পজিটিভ চিন্তা ও দর্শন আমরা অনুসরণ করতে পারি। আসুন, আমরা আমাদের মনের শক্তিকে কাজে লাগাই, নিজেদের ব্যবহৃত হতে না দেই, ব্রেনওয়াশিং এর মতো অপমানজনক প্রসেসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলি। আমাদের প্রয়োজনে পণ্য, পণ্যের প্রয়োজনে আমরা নই। আমরা পণ্যদাসত্ব থেকে মুক্ত হই। আমাদের সকলের চিন্তা পরিশুদ্ধ হোক। (সংগৃহীত)
সুত্র:http://www.bigganschool.org/বà§à¦°à§à¦¨à¦à¦¯à¦¼à¦¾à¦¶à¦¿à¦-মানসিà¦-ধরà§-2/
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মে, ২০১৬ দুপুর ১:৪৫