ডায়ালিসিসের জন্য নার্সিংহোমে ভর্তি হয়েছিলেন দেবাশিস দত্ত নামে এক বৃদ্ধ। সেই সময় হঠাৎই তাঁর মোবাইল ফোনটি অকেজো হয়ে যায়। দিন কয়েক পরে মোবাইল সারাতে গিয়ে দেবাশিসবাবু জানতে পারেন, ফোন চুরি গিয়েছে, এমন অভিযোগের ভিত্তিতেই নম্বরটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তাঁকে ডুপ্লিকেট সিম কার্ডও দেওয়া হয়েছে বলে ওই সংস্থা জানায়। এর পরই তিনি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট পরীক্ষা করতে গিয়ে জানতে পারেন, নার্সিংহোমে থাকার সময়েই তিনি অনলাইন ব্যাঙ্কিংয়ের মাধ্যমে সঞ্জয় হাজরা নামে এক ব্যক্তির অ্যাকাউন্টে ৩ লক্ষ ৯৪ হাজার টাকা পাঠিয়েছেন!
দেবাশিসবাবুর ভাই রক্তিম দত্ত জানান, গত ১৩ ফেব্রুয়ারি অনলাইন ব্যাঙ্কিংকে টাকা লেনদেনের বিষয়টি জানার পরেই তাঁরা কলকাতা পুলিশের শরণাপন্ন হন। রক্তিমবাবুর কথায়, “আমরা কলকাতা পুলিশের তৎকালীন গোয়েন্দাপ্রধান দময়ন্তী সেনের সঙ্গে গিয়ে দেখা করি। তিনি বিষয়টি শুনে আমাদের গোয়েন্দা বিভাগের ব্যাঙ্ক জালিয়াতি দমন শাখার অফিসে পাঠিয়ে দেন।”
শুক্রবার কলকাতা পুলিশের ডিসিডিডি (স্পেশ্যাল) মুরলীধর শর্মা বলেন, “ওই ঘটনার সূত্র ধরেই বৃহস্পতিবার রাতে নবি মুম্বই থেকে ওকারা চিনেডু ফার্দিনান্দ ওরফে মাইক এবং চিনওকে কিংসলে ওরফে কিং নামে দুই নাইজিরীয়কে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ দিন মুম্বইয়ের আদালতে তাদের হাজির করানো হলে ১৪ অগস্ট পর্যন্ত ট্রানজিট রিমান্ডের নির্দেশ মিলেছে।” পুলিশ জানিয়েছে, মাইক এবং কিং বহু দিন আগে ফুটবলার পরিচয় দিয়ে এ দেশে এসেছিল। ২০০৭ সালে তাদের ভিসার মেয়াদ ফুরিয়েছে। গত পাঁচ বছর তারা বেআইনি ভাবেই এ দেশে বাস করছিল। ধৃতদের কাছ থেকে প্রচুর মোবাইল ফোন, ডেটা কার্ড এবং কয়েকটি ল্যাপটপ উদ্ধার করা হয়েছে বলে পুলিশ সূত্রের খবর।
মুরলীধর আরও জানান, দেবাশিসবাবুর অভিযোগের ভিত্তিতে এর আগেই সন্তোষ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিকাশ সাউ, বিপিন কুমার, দিলীপ তাঁতি এবং অরুণ মিশ্র নামে পাঁচ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তাদের জেরা করেই ওই দুই নাইজেরীয়ের নাম জানা যায়। ধৃত দুই নাইজেরীয়-ই এই চক্রের মূল পাণ্ডা বলে পুলিশের দাবি।
পুলিশের এই সাফল্যের পরও কিছুটা আক্ষেপ রয়ে গিয়েছে দেবাশিসবাবুর পরিজনদের। কারণ, তদন্ত চলাকালীনই ১৪ এপ্রিল মারা যান দেবাশিসবাবু। রক্তিমবাবুর কথায়, “যে অপরাধীরা দাদার টাকা হাতিয়েছিল, তাদের গ্রেফতার দাদা দেখে যেতে পারলেন না!”
কী ভাবে টাকা হাতিয়ে নিয়েছিল এই প্রতারকেরা? পুলিশ জানিয়েছে, ওই দুই নাইজিরীয় স্টেট ব্যাঙ্কের (এই ব্যাঙ্কের বৈষ্ণবঘাটা-পাটুলি এলাকার শাখায় দেবাশিসবাবুর অ্যাকাউন্ট ছিল) নাম করে একটি ভুয়ো ই-মেল পাঠায়। কিন্তু সেটি আসল মনে করে ‘ক্লিক’ করেছিলেন ওই বৃদ্ধ। এই ধরনের ই-মেল মারফত ‘কি লগার’ বলে একটি প্রোগ্রাম কম্পিউটারে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।
কী এই ‘কি লগার’? সাইবার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি একটি কম্পিউটার প্রোগ্রাম। গ্রাহক যখন ইন্টারনেটে টাকা আদানপ্রদানের জন্য অ্যাকাউন্ট নম্বর এবং পাসওয়ার্ড দিচ্ছেন, তখন এই প্রোগ্রামের মাধ্যমে সেই তথ্য সঙ্গে সঙ্গে হ্যাকারের কাছে চলে যাচ্ছে। তা দিয়েই টাকা হাতানোর কাজ করে ওই অপরাধীরা। মূলত ভুয়ো ই-মেল মারফতই এই ধরনের প্রোগ্রাম ছড়ানো হয় বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন।
পুলিশ সূত্রের খবর, দেবাশিসবাবুর অভিযোগ শোনার পরই ইন্সপেক্টর সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ব্যাঙ্ক জালিয়াতি দমন শাখার একটি দল ঘটনার তদন্তে নামে। প্রথমে সন্তোষ বন্দ্যোপাধ্যায়কে গ্রেফতার করা হয়। তাকে জেরা করে বাকিদের খোঁজ মেলে। এর পর গত ৪ অগস্ট লালবাজার থেকে ব্যাঙ্ক জালিয়াতি দমন শাখার চার জন তরুণ অফিসার মুম্বই রওনা দেন। কয়েক দিন ধরে ওৎ পেতে বসে থাকার পর বৃহস্পতিবার রাতে নবি মুম্বইয়ের একটি বহুতল থেকে ওই দুই বিদেশিকে পাকড়াও করা হয়।
ধৃতদের জেরা করে তদন্তকারীরা জেনেছেন, দেবাশিসবাবুর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের নানা গোপন তথ্য জেনে ফেলার পর মাইক এবং কিং তাদের কলকাতার এজেন্ট, সন্তোষের সঙ্গে যোগাযোগ করে। সন্তোষ তখন এসবিআইয়ের হাজরা শাখায় নাম ভাঁড়িয়ে সঞ্জয় হাজরা নামে একটি অ্যাকাউন্ট করে রেখেছিল। সেটাতেই দেবাশিসবাবুর টাকা সরিয়ে ফেলা হয়।
এর আগেই অবশ্য ‘সিম’টি বন্ধ করার ব্যবস্থা করেছিল ধৃতেরা। তদন্তে পুলিশ জেনেছে, ইন্টারনেটে টাকা লেনদেনের সময় ব্যাঙ্ক একটি কোড নম্বর (ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড) পাঠায়। সেটি ফের ইন্টারনেট মারফত ব্যাঙ্ককে না জানালে টাকা লেনদেন হয় না। এটি হাতে পাওয়ার জন্য সিম কার্ডটা প্রয়োজন। তাই মাইক ও কিং-এর সহযোগী বিপিন, অরুণরা দেবাশিসবাবুর নামে একটি মোবাইল চুরির ভুয়ো অভিযোগ দায়ের করে। ফলে নম্বরটি বন্ধ হয়ে যায়।
তার পরে দেবাশিসবাবুর নামেই ভুয়ো নথি বানিয়ে ডুপ্লিকেট সিম কার্ড তুলে নেয় তারা। সিম কার্ড হাতে পাওয়ার পরে কোড নম্বরটি জানতে আর কোনও অসুবিধাই হয়নি তাদের। তদন্তকারীদের দাবি, এর পর সহজেই টাকা সরিয়ে ফেলে মাইক-কিংরা। এমনকী, পরে টাকা লেনদেন সংক্রান্ত এসএমএস-ও পাননি দেবাশিসবাবু।
কী ভাবে এই টাকার লেনদেন হয়?
লালবাজারের কর্তারা জানিয়েছেন, এই চক্রের সঙ্গে যুক্ত বিদেশিরা শহরেরই যুবকদের মোটা টাকার লোভ দেখিয়ে এজেন্ট করে নেয়। তার পর তাদের দিয়েই জাল অ্যাকাউন্ট খোলায়। কোনও ব্যক্তির অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা হাতানোর পরে ওই যুবকদের দিয়েই সেই টাকা তোলানো হয়। এর পরে একাধিক হাত ঘুরে সেই টাকা জমা পড়ে হ্যাকারদের অ্যাকাউন্টে। তদন্তকারীদের চোখে ধুলো দিতেই একাধিক এজেন্টের মাধ্যমে টাকা লেনদেন করা হয় বলে পুলিশের একাংশের মত।
কিন্তু জাল নথি দিয়ে দেশের প্রথম সারির কয়েকটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে এ ভাবে ভুয়ো অ্যাকাউন্ট খোলা হচ্ছে কী ভাবে?
সে প্রশ্ন ইতিমধ্যেই উঠতে শুরু করেছে।
[First Page]