কৃষ্ণচূড়া [Delonix regia]
কৃষ্ণচূড়া বাংলাদেশের অতি পরিচিত একটি ফুল। চৈত্র-বৈশাখ মাসের প্রচণ্ড গরমে যখন সবাই অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে, তখনই কৃষ্ণচূড়ার ডাল থোকা থোকা লাল লাল ফুলে ভরে ওঠে। শুধু গ্রীষ্মেই নয়, বর্ষায়ও কৃষ্ণচূড়ার ডালে ডালে থোকা থোকা উজ্জ্বল গাঢ় লাল- কমলা রঙের ফুল অপূর্ব মোহনীয় রূপে ফোটে। ফুলের জগতে কৃষ্ণচূড়ার মতো এমন উজ্জ্বল রঙের ফুল বেশ দুর্লভই বটে। বর্ষার শেষেও এই গাঢ় লাল- কমলা ফুলের রেশ শেষ হয় না। তবে শীতের হিমেল হাওয়ায় গাছটির পাতাগুলো ঝরে যায়। বসন্তে- গ্রীষ্মে গাছগুলো আবার ভরে ওঠে গাঢ় লালে- কমলায়।
তবে এই কৃষ্ণচূড়ার কিন্তু দুইটি প্রকার আছে; একটির কথা তো এতোক্ষণ বললামই, লাল- কমলা রঙের। আরেকটির রং হলুদ। এই হলুদ ফুল কিন্তু কৃষ্ণচূড়া নয়। এগুলো হলো রাধাচূড়া। বৈজ্ঞানিক নাম Caesalpinia pulcherrima। তবে আমাদের খুব পরিচিত এই ফুলটি কিন্তু আদতে আমাদের দেশেরই নয়; এই ফুলের আদি নিবাস দ্বীপদেশ মাদাগাস্কার।
চাঁপা [Michelia champaca Linn.]
চাঁপা বা চম্পা ফুলটির নাম এসেছে সংস্কৃত ‘চম্পক’ থেকে। চাঁপা ফুলের গাছ চিরসবুজ। মানে গাছে সারা বছরই পাতা থাকে। পাতাগুলো লম্বাটে। আর ফুলের রঙ সাধারণত সাদা, কিংবা হালকা হলুদ, সোনালিও বলতে পারো। আর এই ফুলের যা সুন্দর গন্ধ! বসন্ত থেকে বর্ষাকাল পর্যন্ত চাঁপা ফুল ফোটার সময়। বসন্তকালেই সবচেয়ে বেশি ফোটে। তবে এক শীতকাল ছাড়া প্রায় সব সময়েই চাঁপা ফুল ফুটতে দেখা যায়।
চাঁপা ফুল আবার নানা জাতের হয়। আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় স্বর্ণচাঁপা আর হিমচাঁপা। আমরা চাঁপা ফুল বলতে যে ফুলকে চিনি, সেটা মূলত স্বর্ণচাঁপা। এই ফুলটির জন্মভূমি বলতে পার হিমালয়ের পাদদেশ। রং সোনালি হলুদ। আর হিমচাঁপার রং সাদা। আদিবাস উত্তর আমেরিকা। তবে বাংলাদেশের সমতলভূমিতে ফুলটি ভালোই জন্মায়। আরো ভাল হয় উত্তরবঙ্গে, মানে রাজশাহী আর রংপুর বিভাগে। হিমচাঁপা গাছ ৩০ থেকে ৪০ ফুট উচু হয়। পাতা গাঢ় সবুজ, মোটা আর চওড়া। পাতার নিচে বাদামি রঙের প্রলেপ থাকে। আর আগেই তো বলেছি, সব চাঁপা ফুলেই খুবই মিষ্টি একটা গন্ধ থাকে। তবে সাবধান, চাঁপা ফুলের গন্ধ ভাল করে চিনে রেখো। অনেকেই গন্ধের কারণে অন্য অনেক ফুলকেই চাঁপা ফুল মনে করে ভুল করে।
কনকচাঁপা [Ochna squarrosa]
এই ফুলের গাছটি ছোট বৃক্ষ জাতীয় গাছ। ফুলের মঞ্জরি ছোট ছোট, কিন্তু অনেকগুলো একসঙ্গে থাকে। পাতা যখন কচি থাকে, তখন রং থাকে তামাটে। কিন্তু পরিণত বয়সে পাতাগুলো গাঢ় সবুজ রঙের হয়ে যায়। তবে চাঁপা ফুল গাছের মতো সারা বছর গাছে পাতা থাকে না; শীতের শেষে পাতা ঝরে যায়। আর বসন্তে ফুলটির ঘন হলুদ সোনালি রঙের পাপড়ি আর তামা রঙের কচি পাতায় গাছের ডালপালা ছেয়ে যায়। আর ফুলটিতে মধুও থাকে। আর সেই মধুর লোভে জড়ো হয় রাজ্যের সব মৌমাছি আর ভ্রমর।
মৈমনসিংহ গীতিকার কথা শুনেছো কখনো? আজ থেকে কয়েকশ’ বছর আগে ময়মনসিংহের গ্রাম্য কয়েকজন কবি মিষ্টি মিষ্টি সব গল্প ছন্দে গেঁথে দিয়েছিলেন। আর গায়করা সেই সব গান সবাইকে গেয়ে গেয়ে শোনাতেন। সেই গানগুলোর একটিতে এই কাঁচা সোনা রঙের ফুলটির কথাও এসেছে। কবির কাছে গল্পের নায়িকার গায়ের রং মনে হয়েছে একদম কনকচাঁপা ফুলের মত। শোনোই না গানটির চরণদু’টো-
‘হাট্যা না যাইতে কন্যার পায়ে পড়ে চুল।
মুখেতে ফুট্টা উঠে কনক চাম্পার ফুল ’
কাঠ গোলাপ[Artabotrys hexapetalus]
ভাবছো, এ আবার কেমনতরো নাম? আসলে এই ফুলের গন্ধটাই কেমন কাঁঠালের মতো। আর তাই ফুলটির নামই হয়ে গেছে কাঁঠালী চাঁপা। বিশেষ করে রাতের বেলায় ফুলটি গন্ধ ছড়ায়। আর ফুলটির রঙেরও একটা মজা আছে। ফুলটি প্রথমে থাকে সবুজ। পরে ক্রমেই হলদে রঙের হতে থাকে। আর ফুল যখন হলদে হতে থাকে, তখনই সুগন্ধ বের হয়। কাঁঠালী চাঁপা বর্ষাকালে ফোটে ।
দোলনচাঁপা [Hedyehium coronarium]
দোলনচাঁপা আমাদের দেশের খুবই পরিচিত একটি ফুল। গাছের ডালের মাথায় থোকায় থোকায় সাদা রঙের বড় বড় দোলনচাঁপা ফোটে। তবে সব দোলনচাঁপাই সাদা হয় না; কোনো কোনো জাতের দোলনচাঁপা হলদে কি লাল রঙেরও হয়। মোটমাট দোলনচাঁপার প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ৪০টি।
মূলত, এই ফুল ফোটে বর্ষার বিকেলে ও সন্ধ্যায়। তারপর সারা রাত জুড়ে মিষ্টি সুবাস ছড়িয়ে সকাল হতে হতেই শুকিয়ে যায়। আর এই ফুলের সুবাসও পাওয়া যায় অনেক দূর থেকেই। শীতকালে দোলনচাঁপা গাছই শুকিয়ে যায়। গ্রীষ্মকালে আবার তরতাজা হয়ে ফুল ফোটানোর জন্য প্রস্তুত হয়ে ওঠে।
দোলনচাঁপা গাছ প্রায় তিন ফুট উঁচু হয়। দেখতে অনেকটা আদা গাছের মতো। ফুলটির আদি নিবাস দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, বিশেষ করে ভারত। ভাল জন্মে ছায়া ঢাকা জায়গায়, যেখানে সূর্যের আলো কম।
নয়নতারা [Vinca rosea]
এই ফুলটি দেখতে বেশ অদ্ভূত; পয়সার মতো গোলাকার। আর তাই, গ্রামে এর একটা মজার ডাকনামও আছে- পয়সা ফুল। শুধু ফুলই না, এই গাছের পাতাও ডিমের মতো গোলাকার।
আমাদের দেশে কয়েক প্রজাতির নয়নতারা দেখা যায়। কোনোটির রং সাদা, কোনোটির গোলাপি, কোনোটির আবার সাদার উপর গোলাপি, আবার কোনোটির রং হালকা নীল।
এই ফুলটি মোটামুটি সারা বছরই ফোটে। তবে শরৎ ও বসন্তকালে একটু বেশি-ই ফোটে। আর রোদ কি ছায়া- সব জায়গাতেই নয়নতারা বেশ মানিয়ে নিতে পারে।
নাগেশ্বর (নাগকেশর)[Messua ferrea]
নাগেশ্বর বা নাগকেশর ফুলের রঙ সাদা। আর গোলাকার মুকুলের রঙ সবজে-সাদা। ফুলের পাঁপড়ির রঙ আবার দুধ-সাদা। ফুলটা যে শুধু দেখতেই সুন্দর, তাই না, বেশ সুগন্ধিও বটে। বসন্তকালে যখন নাগেশ্বর ফুল ফুটতে শুরু করে, তখন তো ভ্রমরেরা নাগেশ্বরের গন্ধে বলা যায় পাগলই হয়ে ওঠে।
এই ফুল শুধু সুন্দরী আর সুগন্ধি-ই নয়, একইসঙ্গে বেশ কাজেরও বটে। এই ফুল থেকে যেমন সুগন্ধি আতর তৈরি হয়, তেমনি নানা রোগের চিকিৎসাতেও ব্যবহৃত হয়। যেমন ধরো, বমি- কাশি, তারপর আমাশয় হলে শুকনো নাগেশ্বর ফুল বেশ কাজে দেয়।
নাগেশ্বর ফুলের গাছ ঢাকায় তেমন একটা অবশ্য দেখা যায় না। তবে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে, বিশেষ করে সিলেটে বেশ চোখে পড়ে।
বলছিলাম না, এই ফুলটি দেখতে খুবই সুন্দর। আর তাই পুরোনো দিনের এক কবি তার নায়িকার রূপ বর্ণনা করতে গিয়ে এক জায়গায় বললেন, ‘নায়িকা এতো সুন্দর যে, সে যখন নাচে, মনে হয় একটা নাগেশ্বর ফুল হেলে-দুলে পড়ছে।’
‘নাচেন ভালা সুন্দরী লো
বাঁধেন ভালা চুল।
যেন হেলিয়া দুলিয়া পড়ে
নাগকেশরের ফুল ’
পলাশ [Butea frondosa Roxb.]
এই ফুলের আরো একটা নাম আছে- অরণ্যের অগ্নিশিখা। কেন? বলছি দাঁড়াও। এই গাছের পাতা কিন্তু সারা বছর থাকে না। শীত আসলেই সব পাতা ঝরে গিয়ে গাছটি একেবারে ন্যাড়া হয়ে যায়। কিন্তু বসন্তকাল আসতে না আসতেই গাছটি গাঢ় লাল রঙের ফুলে ভরে ওঠে। তারপর গাছে পাতা জন্মাতে শুরু করে। এই পাতা জন্মানোর আগে, যখন কেবল ফুল ফুটতে শুরু করে, তখন পলাশ গাছ একদম লাল হয়ে যায়। আর ফুলগাছ হলেও গায়ে-গতরে পলাশ গাছ বেশ বড়োই। তখন মনে হয়, বনে আগুন লেগেছে। তাই পলাশকে বলে অরণ্যের অগ্নিশিখা।
পলাশ ফুল দেখতে অনেকটা সীমফুলের মতো। ফুলের কুঁড়ি অনেকটা বাঘের নখের মতো, কিংবা বলতে পারো কাঁকড়ার পায়ের মতো দুই ভাগে বিভক্ত। পলাশও কিন্তু ঔষধি ফুল; মানে এই ফুলও নানা রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।
বেলী ফুল [Jasminum duplex]
বেলী ফুল তো তোমাদের একদমই চেনা। আরে, বাংলা নববর্ষে, পহেলা ফাল্গুনে, আরো নানা উৎসবে সবাই যে ছোট্ট ছোট্ট সাদা ফুলের মালা পরে, ওটাই তো বেলী ফুলের মালা। সত্যি বলতে কী, মালা গাঁথায় এই ফুলের জুড়ি মেলা ভার! আর এই ফুলের গন্ধও দারুণ!
বেলী ফুলের গাছ বেশ ছোট; ঝোপের মতো। এ ধরনের গাছকে বলে গুল্ম। কোনো কোনো জাতের বেলী তো লতা জাতীয় গাছই। উজ্জ¦ল সবুজ পাতার মাঝে সাদা রঙের থোকায় থোকায় ফুটে থাকা বেলী ফুল দেখতে যে কী সুন্দর, তা আর কী বলবো।
বেলী ফুল মূলত ফাল্গুন থেকে জৈষ্ঠ্য মাস পর্যন্ত ফোটে। তবে বর্ষাকালেও এই ফুল ফুটতে দেখা যায়। এই ফুল রাতে ফুটতে শুরু করে, সকালে পুরোপুরি পাঁপড়ি মেলে আর দুপুরের মধ্যেই ঝরে যায়।
আমাদের দেশে মূলত ৪ জাতের বেলী ফুল দেখা যায়- রাই বেলী, খয়ে বেলী, মতিয়া বেলী এবং ভরিয়া বেলী। এদের মধ্যে মালা তৈরিতে ব্যবহৃত হয় মূলত খয়ে বেলী। আর ভরিয়া বেলী নামের যে প্রজাতি, সেই প্রজাতির কিন্তু আরো একটা নাম আছে- রাজা বেলী।
মহুয়া [Madhuca indica I. F. Gmel]
মহুয়া ফুলটি ঠিক আমাদের দেশের নয়; অবশ্য বেশিরভাগ ফুলই আমাদের দেশে এসেছে বিদেশ থেকে, কিন্তু আমাদের দেশের আবহাওয়া এতোই ভালো যে সবাই আমাদের দেশের বেশ মানিয়ে নিয়েছে। আর তাই ওদেরকে আমাদের দেশের ফুল বলেই মনে হয়। মহুয়া কিন্তু শুকনো অঞ্চলের ফুল। আর আমাদের দেশের আবহাওয়া আর্দ্র, মানে বাতাসে জলীয় বাষ্প বেশি, বৃষ্টিও বেশি হয়। তাই আমাদের দেশে মহুয়া ফুল তেমনি করে আসর জমাতে পারেনি। তারপরও দেশের উত্তরাঞ্চলে, বিশেষ করে রাজশাহী ও দিনাজপুর জেলায় মহুয়া ফুল দেখা যায়।
সাধারণত এই ফুলটি ঘিয়ে রঙের হয়। এর গন্ধ যেমন মধুর, তেমনি অনেক দূর থেকেও পাওয়া যায়। আর এই ফুলের একটা ভীষণ মজা আছে- এর পাঁপড়িগুলোকে বলা যায় মাংসল পাঁপড়ি। আর তাই এই ফুল রান্না করে খাওয়া-ও যায়! ফুল রান্না করে খাওয়া- ভীষণ মজার না?
বসন্তের আরো ফুল সম্পর্কে জানতে ইচ্ছে করছে? তাই কী আর সম্ভব! আমাদের দেশে কী আর কম ফুল ফোটে? এক বসন্তেই আমাদের দেশে কত্তো ফুল ফোটে! আর সে সব ফুলও যে কত্তো সুন্দর! আরেকদিন না হয় আরো কয়েকটা ফুলের গল্প বলবো, কেমন? আজ না হয় এই ক’টাই থাক।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জুন, ২০১২ রাত ১০:৫৪