তার আসার কথা নয়, তবু এসেছেন।মতি মামা! বয়স পয়তাল্লিশের কাছাকাছি। এখনো বিয়ে করেননি। বিয়ে সংক্রান্ত কোন কথা শুনলেই তার মেজাজ গরম হয়ে ওঠে। তার মেজাজ গরম দেখে বিয়ের কথা বলা মানুষ গুলো চুপসে যায়! আর কথা বলেনা। মতি মামা শিক্ষিত জ্ঞানী মানুষ। কেউ তাকে জ্ঞানী না ভাবলেও তিনি নিজেকে জ্ঞানী, বিচক্ষন, পন্ডিত ভাবতে মোটেও কার্পন্য করেন না। আইন নিয়ে পড়াশোনা শেষ করেও কোনদিন কোর্টের ধারে কাছে যাননি। রাস্তা দিয়ে ঘুরেন আর উদ্ভট সব কথাবার্তা
বলে বেড়ান। পৈতৃক সম্পত্তির দাপটে এখনো দিব্যি ঘুরে বেড়াতে পারছেন।মানুষকে তার মহামূল্যবান বানী শোনাচ্ছেন। তার একটা স্বপ্নও আছে। স্মরনীয় বানী নামক একখানা বানীগ্রন্থ জীবন শেষ হবার আগেই লিখে যাবেন। সেই গ্রন্থে কেবল তার বানীই থাকবে। গ্রন্থের কাজ তিনি শুরু করে দিয়েছেন। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখে যচ্ছেন দিনের পর দিন। একটা মোটা খাতার অর্ধেকটা বানী লিখে ভরে ফেলেছেন।
মারুফের সাথে মতি মামার দেখা নেই প্রায় দু’বছর। দেখা করার জন্য মামা বাড়িতে কয়েকবার গেছে। বৃদ্ধ নানি প্রতিবারই বলেছেন, ‘ ওর কি কোন ঠিক আছে? কখন আসে, কখন যায়! কোথায় যায়, কোথায় থাকে!’ তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, ‘ ওকে একটা বিয়ে দিতে পারলে বাচতাম। ওর জীবনটা পাল্টে যেত। ’
মারুফ নানিকে সান্ত্বনা দেয়, ‘ চিন্তা করোনা নানি। কয়েক মাসের মধ্যে মামাকে জোর করে হলেও বিয়ে দিয়ে দেব। একবার কোন রকম বিয়ে দিতে পারলে তারপর দেখ মামা শুধু বিয়ে বিয়ে আর বউ বউ করবে। আরো বিয়ে করতে চাইবে। একটা, দুটো, তিনটা..........’
নানি হাসেন। তারপরও ছয় মাস চলে গেছে। মতি মামার খোজ নেই।দেখা নেই। কলেজ থেকে মতিঝিলের বাসায় ফিরতেই মতি মামার অস্তিত্ব টের পায় মারুফ। চিৎকার করে মাকে কি যেন বোঝাচ্ছেন। মারুফ মামার পাশে গিয়ে দাড়ায়। ‘ কেমন আছো মামা?’
মারুফের কথা শুনে চোখ ফেরান মামা। মারুফের কথাটা যেন শুনতে পাননি ভাবটা এমন। জবাব না দিয়ে বলেন, ‘ বাংলা একাডেমীর অভিধান আছে ভাগ্নে?’
‘ হ্যা, আছে।’
‘ কই, নিয়ে আয়। ’
‘ কেন কি করবে? ’
‘ তোর মা আমাকে বিয়ে করতে বলছিল। বিয়ে শব্দের মূল অর্থটা তাকে বোঝানো দরকার। ’
মারুফ বুক সেলফ থেকে বাংলা অবিধানটা বের করে দেয়। মা রাগে গজ গজ করতে করতে অন্য রুমে চলে যান। মতি মামারও বুঝতে কষ্ট হয়না, তার বড় বোন রাগ করেছেন। তাতে তার কিছু আসে যায় না।
তিনি যে চেয়ারে বসেছেন আর উঠাউঠির নাম নেই। রাত বাড়তে বাড়তে ঘড়ির কাটায় বারোটা ছুই ছুই করছে। মা এসে মাঝখানে একবার খাওয়ার জন্য ডেকেছেন। হাই-হুই কিছুই বলেননি। শেষে খাবার এনে রেখে গেছেন। ভাত-তরকারি। পানির জগ-গ্লাস। মারুফ ভাবে, মতি মামা নিশ্চই এতক্ষন বিয়ে সংক্রন্ত বিষয় নিয়ে ভাবছেন না। ভাবলে এতকাল বিয়ে না করে থাকতে পারতেন না। কি একটা যেন খুজছেন! ভাবটা এমন, মহাজাগতিক বিষয় নিয়ে বড় ধরনের গবেষনা চালাচ্ছেন তিনি।
মারুফের ভেতর অস্থিরতা ভর করলেও সে তা প্রকাশ করে না। মামা মানুষ। তার সবচেয়ে বেশি রাগ লাগে বাড়ির মালিকদের উপর। বাবা-মার উপর। বাড়িতে কোন মেহমান এলেই মারুফের ঘাড়ে চাপে। তার রুমে যায়গা করে নেয়। অবশ্য কিছু করার নেই। তিন রুমের ছোট্ট একটি ফ্লাট। বাবা মা থাকেন একরুমে। দুই বোন জুলেখা-ফতেমার এক রুম। বাকি রুমটা মারুফের। মারুফের ঠিক বলা চলেনা বরং মারুফ আর আগত মেহমানদের। রড লাইটটা জ্ভলছে চোখের উপর। আলো থাকলে মারুফের ঘুম হয়না। অনেক সময় বিছানায় গড়াগড়ি করে অবশেষে উঠে বসে। বড় বিনয়ের সাথে মতি মামাকে বলে, ‘ মামা ঘুমাবে না? ’
‘ ঘুম কি বলতে পারিস?’ পাল্টা প্রশ্ন করেন মতি মামা।
‘না ’
‘ ঘুম হচ্ছে বিশ্রাম। এক ধরনের মরে যাওয়া। কর্মঠ মানুষের বেশি ঘুম নেই।’
‘ জী।’
মারুফ আবার শুয়ে পড়ে। গড়াগড়ি করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল মনে নেই। সাকাল হতেই মামার আদেশে রাস্তায় বের হতে হয়। ‘ প্রতিদিন সকালে হাটা ভাল। ’
‘ জ্বি মামা, হাটতে পয়সা লাগেনা। উপকার আছে।’
মতি মামা ফ্যাক ফ্যাক করে হাসেন। হাসার কারন জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা হয়না। কারন জানতে চাইলে অনেক কথা বলবে। তার চাইতে চুপ থাকা ভাল। চুপ চাপ হাটে। মারুফের কাছে ঢাকা শহরটাকে কেবল সকালটাতেই ভাল লাগে। গাড়ির পি পি, মানুষজনের কোলাহল মুক্ত সকালটা পাখির কিচির মিচির মায়াবী গানে মুখরিত। ওরা হাটছে, হঠাত পেছন থেকে কথা বলে ওঠেন কেউ। ‘ ভাইজান একটু সাহয্য করবেন?’
একজন মহিলা। তার কোলে একটা ছোট শিশু। নোংরা চেহারা। শিশুটা ফ্যাল ফ্যাল করে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে।
‘ তোমার স্বামী কি করেন?’ প্রশ্ন করেন মতি মামা।
‘ ফালায়া গেছে। তিন বছর কোন খোজ নাই।’
কথা গুলো বলতে মহিলর কষ্ট হয়না। ব্যাথার কথা। স্বামী নেই। তাকে দেখার কেউ নেই। সেই ব্যাথার কথা গুলো কি সহজ ভাবে উচ্চারন করে মহিলা! মারুফ অবাক হয়। সাথে সাথেই আবার ভাবে, ব্যাথার কথা গুলো বলতে বলতে তা এক সময় আর ব্যাথার থাকেনা।
‘থাক কোথায়?’
‘ কমলাপুর। রেল ষ্টেশনের ছাউনির নিচে ঘুমাই।’
‘ তোমার বাপ-ভাই নেই?’
‘ না।’
মতি মামা কিছুক্ষন কি যেন চিন্তা করেন। গম্ভীর ভাবে দাড়িয়ে থাকেন। তারপর জিজ্ঞাসা করেন, ‘ কি নাম তোমার?’
‘ মারইয়াম।’
‘ ও আচ্ছা, খুব ভাল নাম। ঠিক আছে যাও।’
মেয়েটা মাথা নিচু করে সামনের দিকে পা বাড়ায়। তার ছেলেটা কোলে। বুকের সাথে মেশানো।
রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারেনি, এমনিতেই মারুফের মেজাজ গরম। সেই গরম মেজাজেই বলে ফেলে, ‘ এতো কথা বলে কিছু না দিয়ে তাড়িয়ে দিলে মামা! পেটের তাড়া না থাকলে এই সাত সকালে কেউ ভিক্ষা করতে বেরোয় না।’
মতি মামা মারুফের দিকে তাকিয়ে হাসেন। হাসি তাকে রহস্যময় করে তোলে। এরকমভাবে হেসে তিনি রহস্যময় মানুষ সাজতে চান।
‘ তাড়িয়ে দেইনি। ’ কথা বলেন মতি মামা।
‘ তাহলে! ’
‘ দেখলাম বদরাগী কিনা। বদরাগী হলে এতো কথা বলতো না, আর বললেও শেষে ভিক্ষা না দিলে বলতো, ভিক্ষা দেবেন না তা এতো গল্প শোনার কি দরকার ছিল। সে সাহসও যদি না পেত অন্তত বিদায় বেলা লাল চোখে তাকাত।’
‘ ঠিক।’ মামার কথায় সায় দেয় মারুফ।
‘ তুই বাড়ী যা, সন্ধ্যায় সবাইকে নিয়ে বাড়ী আসবি।’ তাড়াতাড়ি কথা শেষ করেন মতি মামা।
‘ কেন? ’
‘ কথা বাড়াস না, যা, আজ আমার বিয়ে।’ কথা শেষ করতে করতে মতি মামা বেশ খানিকটা সামনে এগিয়ে যান। অসহায়, অপরিস্কার না খাওয়া মেয়েটা যেদিকে গেছে সেদিকে। মারুফ বড় বড় চোখে মতি মামার পথের দিকে চেয়ে থাকে। আজকে তার বিয়ে।