ঘুম থেকে জেগে রাত কত হয়েছে অনুমান করতে পারে না সাব্বির। ব্যাঙ ডাকছে অবিরাম। একটা থামলে আরেকটা ডাকা শুরু করছে। চারিদিকে ব্যাঙের ডাক ঘ্যা ঘ্যা ছাড়া নীরব। কিছু সময় পর অনেক দূর থেকে একটা পুরুষ আর একটা মহিলার অস্পষ্ট কথার্বাতা বাতাসে ভেসে আসে। বাড়ি থেকে বেরিয়েছে সকাল নটায়। গাড়িতে ছিল কয়েক ঘন্টা। অফিস করে বাসায় ফিরতে ফিরতে সাড়ে পাঁচটা বাজে। এসেই বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। বিকাল বেলা সাব্বিরের ঘুমাতে ইচ্ছা করেনা। অভ্যাসও নেই। তারপরও আজ অনিচ্ছা সত্বেও কেন যেন ঘুমেয়ে পড়ে। কখন আসরের ওয়াক্ত চলে যায়, কখন সূর্য পশ্চিম দিগন্তে ঢলে পড়ে, পাখিরা কিচির মিচির গান করে নীড়ে ফেরে, টের পায়না। বাড়িতে থাকলে মা ডেকে তুলতেন। মেসে কেউ ডাকে না। বাড়ি আর মেস শব্দ দুটোর পর্থক্য নিয়ে ভাবে সাব্বির। একটা স্থায়ী আরেকটা অস্থায়ী। পৃথিবীতে মানুষ যা স্থায়ী ভাবে তা স্থায়ী নয়, বরং সাময়িক, মুটামুটি স্থায়ী। সাব্বিরের জন্য বাড়ি আর মেসের পার্থক্য বাড়িতে মা থাকে, বাবা থাকে, ভাই-বোন থাকে; মেসে কেউ থাকেনা। কয়েকদিন আগে পর্যন্ত একজন রুমমেট ছিল। দিপু। ছেলেটা চলে গেছে। মেসের ডান বাম পাশে তিনটা রুম। তিনটা রুমে দু’জন করে ছয়জন লোক থাকে। মানুষ থাকে। সামনে একটা ঘর। আলাদা সে ঘরে থাকেন বাড়ির মালিক। মালিক পুরুষ তার আপন বাড়িতে থাকেন না। চাকরির জন্য বেশিরভাগ সময় শহরে থাকতে হয়। সাব্বিরের মতো। মালিকের ঘরে থাকে তার বৃদ্ধা মা, সহধর্মীনি আর দুটো সন্তান। জনি, সোনিয়া। জনি ছেলেটা এইচ.এস.সি দিচ্ছে। দুটো পরীক্ষা শেষ। পরীক্ষার মাস খানেক আগে একদিন রাতে ছেলেটার সাথে ঘন্টাব্যাপী আলাপ করতে হয়েছিল। সেদিন রাতে অফিস শেষ করে শিপসা নদীর পাশ দিয়ে অনেক সময় ধরে ঘুরলো। সাব্বিরের নদী খুব প্রিয়। শিপসা নদীতে প্রচন্ড স্রোত। জোয়ার- ভাটার তীব্র টান। মাইল কয়েক গিয়ে সাগরে মিশেছে। নদীর এপাশে ওপাশে আবাদি জমি। এক সময়কার নদী এখন ধানের মাঠ। সবুজ ফসলের ক্ষেত। সন্ধ্যার পর বাসায় ফিরে হৈচৈ, চিৎকার শোনে সাব্বির। জনির মা চিৎকার করছেন। মাঝে মাঝে মায়ের কথার প্রতিবাদ করছে জনি। সবকিছু শুনে সাব্বির যা বুঝতে পারে তাহলো, জনি ছেলেটার পরীক্ষা কাছিয়ে আসছে তথাপি পড়াশোনায় তার মন নেই। তার মন গেছে সীমা নামের এক মেয়ের দিকে। তাকে সে ভালোবাসে। রাত দিন ভালোবাসে। বই সামনে করে ভালোবাসে। ইদানীং গাজা বিড়ি খায় আর ভালোবাসে। সাব্বির অবাক হয়না। অবাক হওয়ার কিছু নেই। আমরা আমাদের জাতিকে, উঠতি প্রজন্মকে রেডিও, টিভি, গল্প, সাহিত্য.... ইত্যাদির মাধ্যমে ভালোবাসার মহত্ব শিক্ষা দিচ্ছি। আমরা দিবস করে পর্যন্ত ছোট বড় সবাইকে ভালোবাসার শিক্ষা দিচ্ছি। সাব্বিরের দরজায় কড়া নাড়ে কেউ। ‘ কে?’ শুয়ে শুয়ে প্রশ্ন করে সাব্বির।
‘ আমি।’
জনির আম্মুর কণ্ঠ শুনে দরজা খোলে সাব্বির। ‘ চাচীজান কী ব্যাপার!’ সাব্বির জানে কেন এসেছেন আর কি বলতে এসেছেন ভদ্রমহিলা। তারপরও না জানার ভান করে।
‘ বাবা, জনিকে একটু বোঝাও। অনেক রাতে ঘরে ফেরে। শুনেছি এই বয়সেই গাজা খায় আজকাল। ও আগে এরকম ছিলনা। পরীক্ষার বেশি বাকী নেই অথচ............’ কথা গুলো কান্নার মতো শোনায়। কথা শেষ করতে পারেন না। কান্না এসে গলা চেপে ধরে। সাব্বির কি বোঝাবে! যেখানে একজন মমতাময়ী মা তার সবটুকু স্নেহ- ভালোবাসা উজাড় করে মিথ্যা , মরিচীকার জগৎ থেকে একবিন্দু সরিয়ে আনতে পারেন না তার স্নেহের সন্তানকে সেখানে সাব্বির কি বোঝাবে ! ও বেশ বুঝেছে প্রিয়ার জন্য কিভাবে সিগারেট খেতে হয়, কিভাবে জীবনটাকে নষ্ট করতে হয়, কিভাবে দেবদাস হতে হয়। সাব্বির উঠে বসে। ‘ চাচীজান, আপনাদের ব্যক্তিগত ব্যাপারে আমি কতোটুকুইবা বলতে পারি।’
‘ পার, তুমি শিক্ষিত ছেলে। বাবা, তুমি আমার জনিকে বোঝাও। ’ সোনিয়া ছোট মেয়েটা মায়ের পাশে এসে দাড়ায়। সুন্দর একটা মুখ। কিছুটা বির্বন। ভাইয়ের কথা ভেবে কিছুটা শোর্কাত। ভাই বোনের বয়সের পর্থক্য দুই বছরের মতো। সোনিয়া ক্লাস এইটে পড়ে। সাব্বিরের সোনিয়ার মতো একটা বোন আছে। একজন মা আর অসহায় বোনের দিকে তাকিয়ে খুব কষ্ট হয়। সাব্বির ওঠে। জনির সামনে গিয়ে দাড়ায়। সাব্বিরকে দেখে জনি কিছুটা লজ্জা পায় বলে মনে হয়। ‘ জনি পড়তে তোমার সমস্যা কোথায়?’
‘ সমস্যা নেই ভাইয়া।’ সহজ ভাবে উত্তর দেয় জনি।
‘ সমস্যা যখন নেই তখন মন দিয়ে পড়াশোনা করা উচিত। সামনে তোমার পরীক্ষা।’
‘ জ্বি।’ সবকিছু বুঝতে পেরেছে এমন ভঙ্গিতে জবাব দেয়।
‘ আমি জানি তুমি ভাল ছাত্র। ভালদের ভালটাকে ধরে রাখা উচিত। তুমি হয়তো জানো না কতোজন তোমার মতো ভাল হতে চায় কিন্তু পারেনা। সবাইকে মালিক ভাল ছাত্র হবার ক্ষমতা দেননা। সবাইকে সমপরিমান জ্ঞানশক্তি ও দেন না। ’
জনি মাথা নিচু করে থাকে। সাব্বির বলে, ‘ জীবনে মানুষ তোমার যোগ্যতাকে সবচাইতে বেশি মূল্যায়ন করবে। সে জিনিস অর্জন করতে হয়। তোমার যদি না থাকে প্রিয়া দূরে থাক আপন স্ত্রী ও তোমার পাছায় লাথি মারবে। যদি যোগ্যতা অর্জন কর, নিজেকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে পার, প্রিয়ার দল তোমার পিছে ঘুরবে। জনি, আজ যে সময় পার করছো আর কোনদিন তা ফিরে পাবেনা। এ হলো নিজেকে গড়ার সময়। ’ কথা শেষ করে রুমে এসে কিছু সময় ছেলেটার কথা ভাবে। সময়য়ের ব্যবধানে, কাজের চাপে আবার ভুলে যায়। জীবনে কতো বিচিত্র ধরনের ঘটনাই তো ঘটছে। যা চলে যায়, যা ঘটে যায় তা মনে রাখার অবকাশ কই !
অন্ধকারে মশারির মধ্যে অনেক সময় বসে থাকে। রাত ক’টা বাঁজে বুঝতে পারেনা। আলো জ্বেলে ঘড়ি দেখে। ন’টা চুয়ালিশ। এই নিভৃত পল্লীতে ন’টা চুয়ালিশ অনেক রাত হলেও দশ জনের এ বাড়িটা মুখর থাকে আরও অনেক রাত পর্যন্ত। রুমে রুমে দু’জন দু’জন মানুষের গল্প শোনা যায়। সাব্বির একা। শুয়ে শুয়ে গল্প শোনে। হাসি শোনে। গ্রাম্য বাজারে প্রত্যেকের দোকান আছে। এদের বাড়ি ঘর আরও অনেক গভীর গ্রামে। ব্যাবসা করতে শহুরে গ্রামে এসেছে। আজ কারও কোন সাড়া শব্দ নেই কেন? প্রশ্নটা বারবার মনে উকি দেয়। দরজা খুলে বাইরে বের হয় সাব্বির। আকাশে অনেক তারা। মৃদু বাতাসে গাছের পাতা গুলো নাচে; দোলে। ‘ কে ওখানে?’ প্রশ্ন শুনে চমকে ওঠে ছাব্বির। ঘুরে দাড়ায়। রাসেলকে অন্ধকারে মূর্তির মতো লাগে।
‘ আমি, সাব্বির।’ রাসেল পাশের রুমের একজন। কাছে আসে।
‘ জনি হাসপাতাসে শুনলাম।’
‘ কি বলেন!’
‘ আপনি বাসায় ছিলেন না?’
‘ হ্যা, ঘুমিয়ে ছিলাম।’
‘ ও, আচ্ছা।’
‘ আপনি কি শুনেছেন?’
‘ ছেলেটা নাকি বিকাল পাঁচটার দিকে অজ্ঞান হয়ে পড়েছে আর জ্ঞান ফেরেনি।’
‘ কি বলেন, কাল ওর পরীক্ষা !’
‘ বিপদ তো পরীক্ষা বোঝেনা।’
‘ জ্বি।’ এদিকে হাসপাতাল বলতে থানা হাসপাতালকেই বোঝায়। হাসপাতাল প্রায় দুই কিলোমিটারের পথ। সাব্বির এক মুর্হুত দাড়ায় না। হাসপাতালের দিকে ছোটে। রাত, অন্ধকার রাস্তা, অলি- গলি, নিঃস্তব্ধ জনপদ পেরিয়ে হাসপাতালে পৌছায় সাব্বির। হাসপাতালের গেটেই দেখা হয় মেসের কয়েকজনের সাথে। ‘ জনি কেমন আছে?’ সাব্বিরের প্রশ্নটা ওরা শুনতে পায়না। নাকি শুনতে পায় জবাব দিতে পারেনা! সাব্বির আরেকটু এগোয়। জনির আম্মার তীব্র চিৎকার শোনা যায়। কাঁদছেন ভদ্রমহিলা। প্রলাপ বকছেন। জোরে জোরে বলছেন, ‘ কাল আমার বাবার পরীক্ষা। ও যে বড় পরীক্ষায় উর্ত্তীন হয়ে গেলরে.....।’ সাব্বির ফিরে আসার জন্য ঘুরে দাড়ায়। কিভাবে তাজা প্রাণটা ঝরে গেল, কোন অসুখ ওকে মেরে ফেলল ভাবতে ইচ্ছা করেনা। ভেবে কি লাভ! সবাইকেই একদিন এ পরীক্ষায় উর্ত্তীন হতে হবে! চলে যেতে হবে। চলে যাওয়া কঠিন। তারচেয়েও কঠিন উর্ত্তীন হওয়া।