দোতালার খোলা বারান্দায় অনেক সময় ধরে বসে আছেন রশিদ সাহেব। তার মাথায় একটাই চিন্তা ঘুরপাক খাচেছ। সময়ের চিন্তা। দেখতে দেখতে কতোটা সময় পার করে ফেললেন। আবার ভাবেন কি পার করলেন? কি! ছোট দেহ বড় হলো। সুঠাম হলো। উচু লম্বায় কম ছিলেন না। পাচ ফুট আট ইঞ্চি। সাদা চামড়ার শরীর। লম্বা মুখ। চওয়া বডি। সব মিলিয়ে একজন সুপুরুষ। নারীর কাছে স্বপ্নের। পিতা মাতার কাছে স্নেহের। আদরের। মেট্রিক পর্যন্ত পড়েছিলেন রশিদ সাহেব। আজকাল লোকজন বলে, আগেরকালের মেট্রিকপাশ। একটা আলাদা দাম আছে। সে সময় মেট্রিকপাশ ছেলে সাত গ্রাম খুজলে দু’একটা পাওয়া যেত কিনা সন্দেহ। বাবার সংসারে টানাটানি থাকার পরও কষ্ট করে লেখাপড়া শিখেছেন। মেট্রিকপাশ করে চাকরি পেতে দেরি হয়নি। গ্রাম ছেড়ে ঢাকা যেতেই একটা ব্যাংকে চাকরি হয়ে যায়। সে দিনগুলো স্বপ্ন হয়ে চোখে ভাসে। মুনের কথা বেশ মনে আছে। মুনমুন। নামটা কে রেখেছিল? ওর বাবা না মা? অন্য কেউও রাখতে পারে। দাদী-নানী গোছের কেউ। সময়ের স্রোতে হারিয়ে যাওয়া মানুষ। রশিদ সাহেবের পাশে বসতো মেয়েটা। পাশের টেবিলে। আকাশি রংটা সম্ভাবত পছন্দ ছিল ওর। বেশির ভাগ দিনই ঐ কালার শাড়ি পরে আসতো। চুল গুলো কোমর পর্যন্ত লম্বা। মাঝারি গড়ন, দুধে আলতা মেশানো গায়ের রং। ভারী সুন্দর একটা মিষ্টি মুখ। এসেই সালাম দিত।
‘ কেমন আছেন?’
মধু মেশানো কন্ঠস্বর রশিদ সাহেবকে ভাবনার সাগরে ডুবিয়ে দিত। ভাবতেন, এতো সুন্দর কন্ঠ কিভাবে হয় মানুষের! ‘ জ্বি ভাল, আপনি?’
মুনমুন হাসতো। মুখে হাসি রেখেই জবাব দিত, ‘ ভাল আছি।’
‘ আপনার বাবা-মা?’
‘ ওনারাও ভাল আছেন।’
কাজের ফাকে ফাকে তাকাতাকি হতো। চোখে চোখ পড়লেই হাসতো মুনমুন। বেশ খাতির হয়েছিল মেয়েটার সাথে। একদিন যেচেই বলেন, ‘ মড্যাম আপনাদের বাড়িতে যাব একদিন।’
তখন অফিস শেষ। সিড়ি দিয়ে নিচে নামছে ওরা। রশিদ সাহেবের কথা শুনে মুনমুন দাড়ায়। রশিদ সাহেব লজ্জা পান। ভাবেন কথাটা সম্ভাবত ঠিক হয়নি।সামনে পা বাড়ায় মেয়েটা। হাটতে হাটতে বলে, ‘ বেশ তো চলে আসুন না একদিন।’
রশিদ সাহেব খুশি হয়ে ওঠেন। খুশে চেপে বলেণ, ‘ আপনার বাবা-মা কিছু মনে করবেন না তো?’
‘ না না এতে মনে করার কি আছে!’
‘ কবে আসলে আপনার ভাল লাগবে?’
কথা বলতে বলতে রাস্তায় নেমে আসে ওরা। তখন ঢাকার রাস্তায় এতো মানুষের আনাগোনা ছিলনা। এতো গাড়ি আর গাড়ির কান ফাটানো পি পি ছিলনা। অবশ্য বিকালের দিকে কিছু কিছু যায়গা বেশ জমতো। মানুষের কোলাহল, হাসি আনন্দে মুখরিত হতো।
‘ জুলাইয়ের তিন তারিখে আসেন।’
সেদিন সম্ভাবত পচিশে মে ছিল। ঠিক মনে করতে পারেন না রশিদ সাহেব। তবে অনেক দিন সময় নিয়েছিল মেয়েটা। প্রায় এক মাস। কেন? প্রশ্নটা আজও অজানা তার কাছে। মুনমুনদের বাড়ি যাবার জন্য বেশ ভাল প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। মুনমুনের জন্য কি কেনা যায়? আকাশি রংয়ের শাড়িতে ওকে দারুন মানায়। নিউ মার্কেট থেকে দামি শাড়ি কিনেছিলেন। মুনমুন ওর দেওয়া শাড়ি পরে আসবে। তার কাছে এসে বসবে। বলবে, রশিদ দেখতো আমাকে কেমন লাগছে? রশিদ সাহেব শুধু তাকিয়ে থাকবেন। অনেকক্ষন, অনেক সময়। তারপর বুক পকেট থেকে বের করবেন একটা লাল গোলাপ। মুনমুনের সামনে বাড়িয়ে দেবেন। বলবেন, এটা তোমার। মুনমুন গোলাপ ছোবে।
কয়েকদিন মুনমুনের সাথে কথা বলা বেড়ে যায়। আর্দশ, চিন্তা-চেতনা, মতপার্থক্য নিয়ে কতো কথা। সময়ে অসময়ে রশিদ সাহেব মুনমুনের টেবিলের সামনে গিয়ে বসেন। চোখে চোখ রেখে কথা বলেন। ঘটনাটা অফিসের সবার দৃষ্টি আর্কষন করে। মুনমুনের সাথে কথা বলার সময় একদিন ম্যানেজার হামিদ সাহেব আসলেন। টাক মাথার মানুষ। বয়স পয়ত্রিশের উপরে। লোকটা এসেই বলেন, ‘ এতো গল্প কিসের রশিদ সাহেব?’
পাকা অপমান। তাও আবার মুনমুনের সামনে। রশিদ সাহেবের মেনে নিতে কষ্ট হয়। ম্যানেজার সাহেবকে থাপ্পড় মারতে ইচ্ছা করে। ইচ্ছা করলেই সব কিছু করা যায়না। থাপ্পড় না মারলেও ক্ষোভ চেপে রাখতে পারেন না। ‘ আপনি ভাল ভাবে কথা বলুন হামিদ সাহেব। আমার কাজ অন্য কেউ করে দেয়না।’
‘ এটা অফিস,প্রেম করার যায়গা না।’
‘ হোয়াট ননসেন্স।’ রশিদ সাহেব উত্তেজিত হন।
‘ কি বললেন!’ ম্যানেজার সাহেবের ঝাঝলো কন্ঠ।
‘ কানে কম শোনেন নাকি! কানের উপর এক থাপ্পড় মেরে কান ভাল করে দেব।’
ম্যানেজার হামিদ সাহেব পাথর হয়ে যান। একজন সামান্য কর্মচারী তাকে এতো বড় কথা বলবে ভাবতেও পারেননি। মুনমুন প্রথম দিকে নিরব থাকলেও ম্যানেজারকে অপমান করা তার সহ্য হয়না।
‘ রশিদ সাহেব আপনি ভদ্রতার সাথে কথা বলুন। লেখাপড়া জানা মানুষ আপনার মতো অভদ্র হয় আমার জানা ছিলনা। আপনার মনে রাখা উচিত ছিল তিনি আমাদের ম্যানেজার।’
আব্দুর রশিদ আকাশ থেকে পড়েন। তার হাত-পা, মাজা-বুক সব যেন এক সাথে ভেঙ্গে যায়। কটকট মড়মড় শব্দ ছাড়া ভাঙ্গা।
আবার কথা বলে মুনমুন, ‘ আপনি এত ঘন ঘন আমার টেবিলে আসেন কেন? আমি তো ভদ্রতার খাতিরে আপনাকে কিছু বলতে পারিনা।’
এ ঘটনার পর এক সপ্তাহ পর্যন্ত সময় রশিদ সাহেব ঢাকা ছিলেন। মুনমুনের দিকে আর একবারও তাকাননি। বুকের ভেতর আকা মুনমুনকে চেয়ে দেখেছেন বারবার। কি সুন্দর মায়াবী চেহারা! মনের চোখে তিনি মুনমুনকে দেখেন। স্বপ্নের মুনমুনের সাথে তার মিল কোথায়?
তারিখটা মনে আছে। ২৭ শে জুন। দুপুরের দিকে বদলির একটা চিঠি ধরিয়ে দেয় পিয়ন। তাকে বরিশাল বদলি করা হয়েছে। মাত্র তিন দিন সময়। এ সময়ের মধ্যে তাকে বরিশাল গিয়ে কাজে যোগদান করতে হবে।
চিঠিটার দিকে অনেক সময় তাকিয়ে ছিলেন। সাদা কাগজ আর কিছু কালির দাগ। কি ক্ষমতাই না তার! নিজের মনেই হেসেছিলেন সেদিন। মুনমুনকে আর আকাশি রংয়ের শাড়িটা দেওয়া হয়না। সেজেগুজে ওদের বাড়িতে যাওয়া হয়না। বরিশালে আসতে হয়। বরিশাল কি? একটা যায়গা? যায়গা কি! কিছু মাটির স্তুপ। দুনিয়াটাই তো তাই। এক বছর পর রশিদ সাহেব শোনেন মুনমুনের প্রমোশন হয়েছে। তার কয়েকমাস পরেই ম্যানেজার হামিদ সাহেবের সাথে মুনমুনের বিয়ে হয়।
রশিদ সাহেব একটা বিড়ি ধরান। অন্ধকারে বিড়ির ধোয়াগুলো সাদা বকের সারির মতো উড়ে উড়ে এক সময় বিলীন হয়ে যাচ্ছে। অন্ধকারে বিড়ির ধোয় সাদা দেখা যায় কেন, অমন সাদা?
আর মাত্র বিশ দিন চাকরি আছে তার। এক সাথের কতো মানুষ মরে গেল। সাদা একঝাক পোকা সেই সব পরিচিত মানুষ গুলোকে কিলবিল করে খেয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিল। রশিদ সাহেব মরেননি কেন? হাসানকে ডাক দিলে ভাল হয়। হাসান তার বড় ছেলে।
‘ হাসান। হাসান।’ অন্ধকারে বসে রশিদ সাহেব ডাকেন। কোন সাড়া নেই। সামনের বাড়ির দোতালায় কয়েকটা উঠতি বয়সের ছেলে মেয়ে হুড়োহুড়ি করছে। বিদ্যূৎ না থাকলে ওদের খুব আনন্দ। বাবা-মার সামনে একটা অজুহাত দাড় করানো যায়। গরমের। এই গরমে কি পড়া যায়! কথাটা পুরোপুরি মিথ্যা নয়। ইদানিং প্রচন্ড গরম পড়ছে।
কিছুক্ষন পর নাছিমা আসে। নাছিমা তার বউ। ত্রিশ বছরের বউ। অনেক ব্যাথার-সুখের সাথী, সাক্ষী।
‘ ডাকছো।’ রশিদ সাহেবের পাশে এসে দাড়ায় নাছিমা।
‘ না না তোমাকে ডাকিনি। আমার বড় ছেলেকে ডেকেছি। হাসানকে।’
‘ ওতো বাইরে গেছে।’
‘ ঠিক আছে।’ রশিদ সাহেব বিড়িতে টান মারেন। টানের সাথে বিড়ির আগুনটা তীব্র লাল হয়। ক্ষনিকের জন্য।
‘ তোমার কি কষ্ট হচ্ছে?’ নাছিমার মমতা জড়ানো কন্ঠ।
‘ কেন?’
‘ চাকরি শেষ হয়ে যাচেছ তাই।’
রশিদ সাহেব চুপ করে থাকেন। নাছিমা হাত ধরে। ‘ এসো।’
‘ কোথায়?’
‘ পেছনের জ্বানালা খুলে জানালার পাশে দাড়াবো। আকাশ দেখবো। জানো আজ আকাশে অনেক তারা উঠেছে।’
রশিদ সাহেবের মনে একটা প্রশ্ন উকি দেয়- তারা কি? মাটির স্তুপ নাকি আলোর!
দেখতে দেখতে বিদায়ের দিন ঘনিয়ে আসে। ফেয়ারওয়েল। সেই পুরানো কালো কোটটা পরেন। এই কোট পরে তিনি জীবনে বেশি অফিস করেছেন। গরমের দিনেও মাঝে মাঝে কোট গায়ে দিয়ে যেতেন। কালো কোট। সাদা সার্টের উপর কালো কোটটাতে তাকে দারুন মানাতো। শেষ বয়সেও। সেই পোশাকে বাড়ি থেকে শেষ অফিস করতে বের হন আব্দুর রশিদ। আফিসটা সাজানো হয়েছে। গোল চত্বরে একটা মঞ্চ। মঞ্চের সামনে সারিবদ্ধ চেয়ার।
চেয়ারে চেয়ারে কেৌতূহলী একঝাক মানুষ। তারসহকর্মী। রশিদ সাহেব মঞ্চের দিকে যান। চোখে মুখে নিরব একটা ব্যাথা। কিসের ব্যাথা? বিদায়ের ব্যাথা! ব্যাথার কারন বলা গেলেও কোনদিন ব্যাথার বর্ননা যথাযথ ভাবে দেওয়া সম্ভব নয়। রশিদ সাহেব মঞ্চে ওঠেন। সমবেত জনতা হাত তালি দেয়। সামনে নতুন-পুরাতন সহকর্মী। কিছুক্ষন পরেই তার ডাক পড়ে। কিছু বলতে হবে। সবার জন্য কিছু বলতে হবে। মাইকের সামনে গিয়ে দাড়ান। কি বলবেন বুঝে উঠতে পারেন না। তার চেয়েও বেশি সমস্যা- কিভাবে ব্যাক্ত করবেন ৪০ বছর একসাথে থাকা সহকর্মীদের ছেড়ে যাওয়ার ব্যাথা ভরা উক্তিগুলি। খুক খুক কাসেন। একজন সহকর্মী খোরশেদ হাসে। জনতার মাঝখানে বসা। একটু জোরেই বলে, ‘ বিড়ি দেব রশিদ সাহেব?’
রশিদ সাহেব খোরশেদের দিকে তাকান। মুচকি হাসেন। মাথা নেড়ে বোঝান, না। এখন তার বিড়ি লাগবে না। মানুষটা কি বোঝেনা, তাকে নিয়ে সবাই ব্যাঙ্গ বিদ্রুপ করে। হয়তো বোঝেন, বুঝেও নিরব থাকেন। ব্যাঙ্গ করা মানুষ গুলো সব সময় মানুষকে ব্যাঙ্গ করে খুশি হয়। মানুষের সেই খুশিটাকেই যেন ভদ্রলোক মনেপ্রানে কামনা করেছেন তার সারাটা জীবন।
‘ রশিদ আর আসবে না।’ গুম গুম করে ওঠে মাইক। ‘ বিদায় বন্ধুরা।’ অল্প কথা। শেষ দুটো শব্দ ভারী। মঞ্চ থেকে নামেন রশিদ সাহেব তার সামনে একটা প্রশ্ন এসে দাড়ায়- ফেয়ারওয়েল কি! দু’হাতে চোখ মোছেন।