গনক ( ছোট গল্প)
বাড়ী থেকে বেরুনোর সময় বড় মেয়েটা দেৌড়ে আসে। একটু হাসে। ‘ বাপজান কই যান?’ মহব্বত মেয়েটার মুখের দিকে তাকায়। মায়াবী একটা মুখ। সংসারে অভাব অনটন থাকার পরও মেয়েটার মুখ থেকে হাসি যায়না কখনো। সব সময় হাসির একটা আভা লেগেই থাকে। ওর জন্মের কয়েকদিন পর কি মনে করে যেন হাসি নামটা রেখেছিল মহব্বত। তখন মহব্বতের ব্যবসা রমরমা। মাত্র দু’বছর হল বিয়ে করেছে। বউ আর মেয়েকে নিয়ে সুখের সংসার। মেয়ে হয়েছিল বলে মহব্বত আলীর মোটেও দু:খ ছিলনা। কি সুন্দর ফুটফুটে মেয়ে। অমন মেয়ে দেখে সব ব্যাথা ভুলে যাওয়া যায়। গিন্নিকে বলে , ‘ কি নাম রাখবা মাইয়ার?’
মহব্বতের বউ হাসে। বউটা দেখতে মন্দ না। বাপজান সাধ করে বউ এনেছিলেন। মহব্বতের বউ। ‘ হাসো ক্যান! কও কি নাম রাখবা মাইয়ার?’
সতের বছর বয়সের বউ হালিমার মুখখানি লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে। বউটা ভাল। লাজুক। ওর ভাব দেখে মহব্বত খুব হাসে। হাসতে হাসতে বলে, ‘ ঠিক আছে তুমি যহন কবা না আমিই নাম ঠিক করি। ওর নাম রাখলাম হাসি। হা: হা:।’ সেই থেকে মেয়েটা হাসি।
‘ বাপজান।’ পিতাকে পাথরের মতো দাড়িয়ে থাকতে দেখে মমতা জড়ানো কন্ঠে ডাকে হাসি।
‘ কি?’ মহব্বত আলী সাড়া দেয়।
‘ সাত সকালে কই জান আফনে?’
‘ শহরে যাব। ঘরে চাইল নাই। দুফরে খাবি কি!’
হাসি চুপ করে যায়। কিছু একটা বলবে যেন। বলতে যেয়েও বলতে পারছে না।
‘ বাপজান..........।’
‘ কিছু কবি?’
‘ বাপজান।’ আবার থামে হাসি।
মহব্বত আলী হাসে। পুরো মায়ের স্বভাব পেয়েছে মেয়েটা।
‘ কি কবি ক না।’
‘ আমার জননি এটটা ওড়না আনবেন? আগেরডা ছিড়া গেছে।’
মহব্বতের কষ্ট হয়। একটা মাত্র মেয়ে তার। বাবাকে গরম দিয়ে একথা বলেনা সে এই বাবা, নতুন মডেলের একটা গাড়ী কিনে দেবে।বলেনা আজ বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাব বিশ হাজার টাকা দাও। একটা ওড়নার জন্য মেয়েটার কি বিনয়মাখা আকুতি।
‘ আনবো মা।’ জবাব দেয় মহব্বত আলী।
বাবার কথা শুনে মেয়েটার মুখ খুশিতে ভরে ওঠে। একটা নতুন ওড়না পাওয়ার খুশি। বাবাকে যতক্ষন দেখা যায় ততক্ষন পথে দাড়িয়ে থাকে। এই পথেই ফিরবেন বাবা। যখন ফিরবেন তখন তার কাছে থাকবে একটা নতুন ওড়না। হাসি দেৌড়ে যাবে। বাবা মৃদু হেসে বলবেন, মা পছন্দ হইছে? হাসি কিছু বলবে না। শুধু সুখে মাথা নাড়াবে।
শহরে যেতে হলে প্রথম একঘন্টা হাটতে হয়। হাটা শেষ হলে পাচ টাকার ভাড়া ভ্যানে। ভ্যানের পথ শেষ হলে মিনিট বিশেক লাগে শহরে পেৌছাতে। মহব্বত আলী যখন শহরে পেৌছে তখন সূর্য বেশ মাথার উপর উঠে এসেছে। আকাশে থোক থোক কালো কালো মেঘ। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মেঘগুলো সূর্যকে ঢাকতে পারছে না। বেশ গরম পড়েছে। ঘামে ভেজা শরীর নিয়ে মহব্বত আলী শহর ভরে চক্কর দেয়। রাস্তার দু’পাশে বড় বড় বিল্ডিং। আকাশ ছোয়া। আপনমনে হাটে সে। হাসির জন্য একটা ওড়না কিনতে হবে। ঘরে চালও নেই। র্দুমূল্যের বাজার। সবকিছুর আগুন ছোয়া দাম। সরকারী চুকুরেরা পর্যন্ত সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে। মহব্বত আলী তো পাথর বেচে। হাত দেখে। মানুষের বাড়তি টাকা না থাকলে মানুষ এসব করেনা। পাথর কেনেনা। হাত দেখায় না। একটা বড় পাচ তলা বিল্ডিংয়ের সামনে এসে দাড়ায় মহব্বত। বীমা অফিস। বীমা অফিসে অনেক মানুষের আনাগোনা। মহব্বত খুশী হয়। বুকভরা খুশী নিয়ে তরতর করে সিড়ি বেয়ে উপরে ওঠে। পাচতলা থেকে শুরু করবে সে। পাচতলায় উঠে কেমন ভয় ভয় করে। কাচ দিয়ে ঘেরা ঘেরা কক্ষ। কি সুন্দর সুন্দর চেয়ার টেবিল, আলমারি, কম্পিউটার। বুকে সাহস নিয়ে একটা কক্ষে প্রবেশ করে সে। একজন লোক লম্বা গদির চেয়ারে বসে আছে। মহব্বত আলী আমতা আমতা করে বলে, ‘ স্যার আমি ফকির মানুষ।’
ভদ্রলোক চশমার ফাক দিয়ে মহব্বত আলীর দিকে পিটপিট করে তাকান। ‘ আপনাকে দেখে তো ফকির মনে হচ্ছে না। কাধে চামড়ার ব্যাগ। পোশাকটাও সুন্দর। ব্যাগে কি! বোমটোম না তো?’
‘ না স্যার।’ মহব্বত হাসে। ‘ বোম হবে কেন! ব্যাগে স্যার পাথর। ভাগ্য বদলানোর পাথর।’
‘ ও আচ্ছা। হাত দেখেন নাকি?’
‘ জ্বি দেখি।’
‘ তারমানে আপনি গনক।’
‘ জ্বি।’
‘ শুনুন আমার পাথর-টাথর লাগবে না। আমাদের কম্পিউটার সেকশানে যান। ওখানে দেখবেন টাকমতো একজন বসে আছে। নাম খোরশেদ।’ দমনেন ভদ্রলোক।
মহব্বত আলী সায় দেয়। ‘ জ্বি স্যার।’
‘ ওনার কাছে যান। একদিনও বেচারা ঠিক সময়ে অফিসে আসেন না। তার পাথর দরকার। ভালমতো পাথর দেবেন।’
‘ জ্বি দেব।’
মহব্বত আলী সালাম দিয়ে বেরিয়ে আসে। কম্পিউটার রুম কোনদিকে মহব্বত জানেনা। অবশ্য কাউকে জিজ্ঞাসা করলেই জানা যাবে। ম্যানেজারের কাচের রুম থেকে বেরিয়ে রুমের সামনে দাড়ানো দারোয়ান কে জিজ্ঞাসা করে, ‘ কম্পিউটার রুমটা কোনদিকে ভাই?’
লোকটা উত্তর দিকের সোজা কাচঘেরা রুমটাকে ইশারা করে দেখায়। মহব্বত আলী দেরী করেনা। কচঘেরা রুমটার মধ্যে ঢুকে পড়ে। দু’জন মানুষ কি সব যন্ত্রপাতি নিয়ে বসে আছে। একজন যুবক, আরেকজন খোরশেদ। টাকপড়া চল্লিশোর্ধ বয়সের মানুষ।রুমের মধ্যে ঢুকতেই মহব্বত আলীর মনে পড়ে এসব রুমে অনুমতি না ঢুকতে হয়না। দু’জন মানুষ একসাথে মহব্বতের দিকে তাকায়। মহব্বত আলী বিনয়ের সুরে, মুখে লজ্জা নিয়ে বলে, ‘ স্যার, কিছু না বলে ঢুকে পড়েছি। বাবা কিছু মনে করেননি তো?’
‘ না না কিছু মনে করবো কেন! অনুমতি না নিয়ে ঢুকেছেন। আসুন এবার আমার কোলে এসে বসুন।’
খোরশেদের কথা শেষ হতেই যুবকটা হেসে ওঠে। তারপর আবার থেমে যায়। কি একটা ভেবে যেন ওর সুন্দর মুখটা ব্যাথায় ভারী হয়ে ওঠে। মহব্বত আলীর লজ্জা করেনা। কত মানুষের সাথে তার ওঠা-বসা। কতজন কতো রকমের কথা বলে। সব সয়ে গেছে। মানুষের কথা সহ্য করতে না পারলে এ ব্যাবসায় টেকা যায়না।
মহব্বত আলী খোরশেদের পাশের চেয়ারটা টেনে বসে। তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ স্যার আমি ফকির মানুষ। গনক। হাত দেখি। পাথর দেই। হাত দেখাবেন?’
‘ দেখাব তো। হাত-পা দুটোই দেখাব। আপনি পা দেখেন না?’
খোরশেদ কটাক্ষ করে কথা বলছে। মহব্বত আলীর মুখে মিষ্টি হাসির আভা। ‘ পায়ে স্যার ভাগ্য নেই।’
‘ তাই নাকি!’ খোরশেদ ডান হাতটা বাড়িয়ে দেয়। ‘ ঠিক আছে দেখুন।’
মহব্বত আলী গভীর মনোযোগের সাথে খোরশেদের হাত দেখা শুরু করে।‘ আপনার ভাগ্য রেখা ভাল।’
‘ জ্বি।’
‘ আপনার মনটা খুব উদার কিন্তু মাঝে মাঝে কাছের মানুষের কাছ থেকে কষ্ট পান।’
‘ ঠিক।’
‘ ভালো অর্থপার্জন করেন কিন্তু সেভাবে টাকা ধরে রাথতে পারছেন না।’ খোরশেদ মাথা ঝাকায়। ‘ জ্বি।’
কিছু কিছু কথা আছে তা সত্য হোক বা মিথ্যা হোক মানুষ তা বিশ্বাস করে। কোন মানুষকে যদি বলা হয় আপনি খুব উদার, সুন্দর মনের সে খুশি হবে। বিশ্বাস করবে। পৃথিবীর কেউ নিজেকে খারাপ ভাবেনা। হৃদয়হীন, পাষান মনে করেনা।
‘ আপনার সামনে কিছু কষ্ট আছে, বিপদ।’
গনকের কথা খোরশেদ মিটমিট করে হাসে। ক্ষনিকের হাসিটা আড়াল করে বলে, ‘ বাবা আমার কষ্ট আর বিপদ থেকে বাচার কি কোন উপায় নেই?’
‘ আছে, আছে।’ গনক মহব্বত তার আপন জগতে ফিরে যায়।‘ পাথার, বাবা। ওই পাথরই সব সমস্যা দূর করবে।’ কথা শেষ করেই মহব্বত বিজয়ীর হাসি হাসে। কেমন অদ্ভুত।
‘ হাদিয়া কতো বলেন?’ প্রশ্ন করে খোরশেদ।
‘ বাবা পাথরের কি আর দাম দেওয়া যায়! কি আছে আমাদের যা দিয়ে পাথরের দাম দেব?’
‘ আপনার কথা শুনে আমার খুব পাথর নিতে ইচ্ছা করছে। কি যে করি গরীব মানুষ, পকেটে মাত্র বিশটা টাকা আছে। কথায় বলেনা গরিবের কপালে কি আর পোলাও জোটে?’
মহব্বত আলী কিছুক্ষন চুপ থাকে। কি যেন ভাবে। ‘ বাবা ঠিক আছে, আপনাদের এখানে এসেছি। পাথরের দাম নয়, আপনি আমাকে একবেলা খাবারের পয়সা দেন। একটা সুন্দর প্রস্তাব দিয়েছি।’
খোরশেদ খুশি হয়। উতফুল্ল হয়। ‘ সুন্দর কথা বলেছেন, আজ দুপুরে আমার সাথে খাবেন। হটপটে খাবার এনেছি। দু’জনে মিলে একসাথে খাব।’
‘ না না আমি খাব না। আপনি এক কাজ করুন বিশ টাকাই দিন, একটা পাথর এমনিতেই দিয়ে যাই।’
খোরশেদ হাসে। ‘ বিশ টাকা তো আমার রিকশা ভাড়া। বাড়ী যেতে লাগবে। পথে পান খাব, চা খাব। আপনার কাছে কিছু টাকা হবে বাবা?’
মহব্বত আলী বুঝতে পারে কি খারাপ এরা। সেও খারাপ। মানুষের সাথে প্রতারনা করে। মহব্বত আলী বাইরে বেরুনোর জন্য পা বাড়াতেই খোরশেদ ডাক দেয়, ‘ এই যে বাবা।’
‘ আমি যাই।’ ব্যাথা মহব্বতের কন্ঠে।
‘ পাথর দিয়ে যান। তিনটা পাথর। আমার পাথর আমার বউয়ের পাথর আর একটা ছেলে আছে তার পাথর।’
খোরশেদের ঝাঝালো কন্ঠ শুনে মহব্বতের কেমন ভয় ভয় করে। শিক্ষিত মানুষ কি এমন হয়! ভয়ে ভয়ে তিনটা পাথর দিয়ে বিদায় নেয়। মনে মনে একটা প্রতিজ্ঞা করে ফেলে, আর কোনদিন মানুষ ঠকাবে না। রিকশা চালাবে, চাষ করবে, না হলে..........। একটা কিছু করবে মহব্বত। কি করবে? হাসির একটা ওড়না দরকার। রাতে কি খাবে?
হাজারো চিন্তা নিয়ে রাজপথে নামে মহব্বত আলী।হাটতে থাকে। হাটতে থাকে। ওর হাটাকে হঠাত স্তব্ধ করে দেয় একটা সাদা মাইক্রোবাস। গনক পড়ে থাকে রাস্তায়। হৈচৈ করে অনেক মানুষ ছুটে আসে। মানুষের ঝাক। মহব্বত আলীর লাল রক্ত ছোট একটা স্রোত হয়ে রা্স্তা পাড়ি দিতে চায়। গনক শুয়ে আছে। তার আর ব্যাথা নেই! রক্তের সাথে বেরিয়ে গেছে বুকের ব্যাথা। হাসির ওড়না কেনার চিন্তা, চাল কেনা আর খাওয়ার চিন্তা।
দু’জন আগন্তুক হেটে হেটে আসে। একজন সোতসাহে বলে, কে কে?
সমবেত জনতা নিরুত্তর। একজন ভীড় ঠেলে ভেতরে যায়। খোরশেদের পাশের সেই যুবক। সে চিতকার করে ওঠে, ‘ গনক। নিজের ভাগ্যটা গুনতে পারলে না......!’
জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা
বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন
আত্মপোলব্ধি......
আত্মপোলব্ধি......
একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন
জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !
হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন
ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।
আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন
ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?
ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।
আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন