somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বোল্ডার্স বীচ টু চ্যাপম্যান’স পিক ভায়া কেপ অব গুড হোপ

০৩ রা নভেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৩:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ষোড়শ বা সপ্তদশ শতাব্দী, ক্যাপ্টেন হনেড্রিক ভেন দার ডেকেনের নেতৃত্ত্বে উত্তাল সমুদ্রে ভাসছে একটি ওলন্দাজ জাহাজ। যাত্রাপথে হঠাৎই ঝড়ের কবলে পরে জাহাজটি মাঝ সমুদ্রে পশ্চিম আফ্রিকার উপকূলে হারিয়ে যায়। বলছি ভূতুড়ে জাহাজ ‘দ্য ফ্লাইং ডাচম্যান’ সম্পর্কে। ভুতূড়ে জাহাজ নিয়ে যত লোককাহিনী প্রচলিত আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ও ভয়ংকর হলো ফ্লাইং ডাচম্যানের গল্পটি। প্রচলিত কিংবদন্তী অনুসারে, জাহাজটি এখনো সমুদ্রের ওই অংশে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং প্রতি শতাব্দীতেই কেউ না কেউ এটি দেখার কথা বলেছেন। পাইরেটস অব দ্য ক্যারেবিয়ান চলচ্চিত্রেও ফ্লাইং ডাচম্যানকে দেখানো হয়েছে। আমার আজকের মিশন ফ্লাইং ডাচম্যান যেখানে ডুবে গিয়েছিল সেই বিখ্যাত কেপ অব গুড হোপ ভ্রমণ।


সকাল দশটায় কেপ টাউনের কেপ সান হোটেল থেকে আমাদের ৬ জনের দলটি ভ্রমণের জন্য প্রস্তুত। আমাদের দলে তিনজন নেপালি বন্ধুর সাথে আমরা তিনজন বাংলাদেশি। আমাদের প্রাথমিক পরিকল্পনা শুধুমাত্র কেপ অব গুড হোপ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল। উবার নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হলো, ৫ মিনিট পর আমাদের উবার ড্রাইভার এসে হাজির হলেন। ভাড়া ওয়ান ওয়ে ৭০০ রেন্ড। কেপ টাউন থেকে কেপ অব গুড হোপের দূরত্ব কমবেশি ৭০ কি.মি.। ড্রাইভার খুব হাশিখুশি মানুষ। গাড়িতে উঠার পর ড্রাইভার প্রস্তাব দিলেন, সে আমাদের সাথে সারাদিন থাকবে ও আমাদের নিয়ে ফিরে আসবে, রাস্তায় যাওয়ার সময় আরও বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান পরবে যেগুলো আমরা চাইলে দেখতে পারব, আমরা যদি রাজি থাকি সেক্ষেত্রে সব মিলিয়ে তাকে ১৫০০ রেন্ড দিতে হবে। আমরা রাজি হয়ে গেলাম। পরে বুঝতে পেরেছি, আমরা রাজি হয়ে কাজের কাজই করেছি।


কেপ টাউনের সুন্দর ছিমছাম পিচঢালা রাস্তায় চলতে লাগলাম। ২০ মিনিট পরই আমরা শহর ছেড়ে প্রধান রাস্তায় প্রবেশ করলাম। আমাদের একপাশে কেপ টাউন শহর এবং অন্য পাশে দক্ষিণ আফ্রিকার আরেকটি পর্যটন আকর্ষণ ও প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্য ‘টেবিল মাউন্টেন’ নামক পর্বত। অসাধারণ নৈপূণ্যে যেন কোন শিল্পী তুলি দিয়ে সময় নিয়ে পর্বত ও এর আশেপাশের দৃশ্য এঁকেছেন। পর্বতটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১০৮৫ মিটার উঁচু।

পুরো পর্বতে উঠা নিয়ে অন্য একটি ব্লগ লিখবো আশা রাখছি। কেপ অব গুড হোপ আমার আরও একটি কারণে পছন্দের তালিকায় ছিলো তা হলো ছোটবেলায় খুব সম্ভবত সমাজ বইয়ে পড়েছিলাম, ‘উত্তমাশা অন্তরীপ’ কোথায় অবস্থিত এ ধরণের প্রশ্ন। তবে বলতে অসুবিধা নাই তখনও যেমন বুঝি নাই জিনিসটা খায় না মাথায় দেয়, তেমনি দক্ষিণ আফ্রিকা যাওয়ার সময় এই কিছুদিন আগে পর্যন্তও কোন ধারণা ছিলো না। পরে জেনেছি, এই কেপ অব গুড হোপের বাংলাই হলো ‘উত্তমাশা অন্তরীপ’। কেপ টাউন থেকে এই অন্তরীপে দুই পথে যাওয়া যায়, দুটি পথের দৃশ্যই অসাধারণ সুন্দর। আমরা আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, একটি পথ দিয়ে যাব এবং অন্যটি দিয়ে ফিরে আসব।

সেন্ট জেমস বীচ
প্রায় ৪০ মিনিট পর আমরা আমাদের প্রথম গন্তব্য সেন্ট জেমস বীচে এসে উপস্থিত হলাম। সেন্ট জেমস ‘ফল্‌স বে’র পাশে অবস্থিত ছোট একটি শহর। এখানকার বাড়িগুলো পর্বতের পাশে কোল ঘেঁষে বানানো হয়েছে আর অন্য পাশেই রেল স্টেশন ও বীচ। অধিকাংশ বাড়ি ইউরোপীয় ধাঁচে তৈরি যা ১৯১০ থেকে ৫০-এর মধ্যে তৈরি করা হয়েছে। তবে বাড়িঘর দেখা আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য না। গাড়ি পার্ক করে হাতের বামে আন্ডার পাসে ঢুকে গেলাম।


অপর পাশে বের হতেই একটা দমকা হাওয়া এসে আমাদের আমন্ত্রণ জানালো। যতদূর চোখ যায় সমুদ্র। বীচটা ঠিক বালিযুক্ত নয়; সবুজ ঘাস, ছোট-বড় পাথর, পাথরের মাঝে বালিতে প্রচুর শামুকের খোলস, বিভিন্ন রঙের ছোট ছোট শামুক ও নুড়ি দিয়ে ইচ্ছে মত মালাও গাঁথা যাবে। তবে বীচটি বিখ্যাত হলো এর রঙিন বাক্সের মত সারিবদ্ধ ছোট ছোট স্নান ঘরের জন্য। কেপ টাউনকে বহিঃর্বিশ্বে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য যে কয়টি ছবি ব্যবহার করা হয় সেগুলোর মধ্যে অবশ্যই এই লাল-হলুদ-সবুজ রঙের স্নান ঘরগুলো থাকবেই। আমরাও রঙিন এ বাক্সগুলোর সামনে ছবি তুলে নিলাম। এখানে খুব বেশি সময় নেই নি।

বোল্ডার্স বীচ
আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ফল্‌স বে’র উপকূল ধরে সোজা সামনে অন্য একটি শহর সায়মন্স টাউন। এই শহর দুটি কারণে পরিচিত, একটি হলো বোল্ডার্স বীচ: যেখানে আফ্রিকার বিখ্যাত পেঙ্গুইন কলোনি অবস্থিত, অন্যটি হলো এই শহরেই দক্ষিণ আফ্রিকা নৌবাহিনীর প্রধান ঘাঁটি অবস্থিত। নৌবাহিনীর ঘাঁটির ভেতর একটি প্রতিরক্ষা টাওয়ার রয়েছে যা ব্রিটিশরা ডাচদের আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য তৈরি করেছিল। তবে আমরা ওমুখো না হয়ে বোল্ডার্স বীচে পেঙ্গুইন দেখতে চলে এলাম। সেন্ট জেমস থেকে ২০ মিনিট পর আমরা বোল্ডার্স বীচ হাজির হলাম। গাড়ি পার্কিং এর স্থান থেকে সামনে তাকালেই বীচ, বীচে গেলেও আপনি কিছু পেঙ্গুইন দেখতে পাবেন। এখানে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে বীচের এক কোণায় বেড়া দেওয়া হয়েছে যাতে দর্শনার্থীরা পেঙ্গুইনের খুব কাছে যেতে না পারে। আমরা কিছুক্ষণ খোলা সমুদ্রে ঢেউ, পেঙ্গুইন এবং নিজেরাসহ ছবি তোলার চেষ্টা করে ক্ষ্যান্ত দিয়ে চলে আসলাম। পাশেই পেঙ্গুইন দেখার অন্য একটি স্পট রয়েছে যেটা বিশেষভাবে পর্যটকদের জন্যই তৈরি করা হয়েছে।


বিশেষভাবে তৈরি ওই পেঙ্গুইন স্পটটিতে প্রবেশের জন্য প্রতিজন ৭৫ রেন্ড করে দিতে হলো। টিকেট কেটে ভেতরে প্রবেশ করলাম। প্রবেশ পথ থেকে যেখানে পেঙ্গুইন রয়েছে সে পর্যন্ত যেতে কাঠের পাটাতন ও রেলিং দিয়ে একটি সাঁকোর মত তৈরি করা হয়েছে। মূলত এই স্ট্রাকচারের উপর দাঁড়িয়েই পেঙ্গুইন দেখতে হয়। নিচে ছোট ঝোপগুলোর মাঝে বালিতে ছোট ছোট ড্রামের মত কিছু একটা পুঁতে রাখা হয়েছে, অর্ধেকটা বালিতে পুঁতা, মুখটা বের করা। এগুলোই মূলত পেঙ্গুইনদের আবাসস্থল। কাঠের পাটাতন দিয়ে সামনে এগিয়ে যেতেই দেখলাম সৈকতে বালির মধ্যে একঝাক পেঙ্গুইন আপন মনে নাচানাচি করছে।

বোল্ডার্স বীচের সতর্কতা সাইন
সমুদ্রের গর্জন ততটা না শোনা গেলেও পেঙ্গুইনের কিচিরমিচির ও এক দল চীনা পর্যটকের কোলাহল মিলিয়ে পরিবেশটা অন্যরকমই লাগছিল। এখানে বলে রাখা ভালো, এই প্যাঙ্গুইনগুলো এভাবে মুক্ত পরিবেশে শুধুমাত্র দক্ষিণ আফ্রিকার এ পাশটায় এবং নামিবিয়ায় পাওয়া যায়। বেশ কিছুক্ষণ এখানে কাটিয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে পরবর্তী গন্তব্য উত্তমাশা অন্তরীপের পথে যাত্রা শুরু হলো।

কেপ পয়েন্ট এবং কেপ অব গুড হোপ বা উত্তমাশা অন্তরীপ
ফল্‌স বের কিনারা ধরে আমাদের গাড়ি যতই যেতে লাগলো বাড়ি ঘর আস্তে আস্তে কমতে শুরু করলো। এক সময় দুই পাশে আবার পাহাড় ও সমুদ্র। পাহাড়ি রাস্তায় একবার উপরে উঠছি আবার খানকিটা বাঁক ঘুরে নিচে নামছি, বাঁক ঘোরার সময় মাঝে মনে হচ্ছিল এই বুঝি সমুদ্রে পরে যাচ্ছি। রাস্তায় যেতে যেতে দু-একজন হাইকার চোখে পড়লো। বোল্ডার্চ বীচ থেকে ৪ কি.মি এই রাস্তাটা মিলার্স পয়েন্ট নামে পরিচিত এবং এ কোস্টলাইন পুরোটা সংরক্ষিত অঞ্চল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আমরা যেখানে যাচ্ছি সেটা টেবিল মাউন্টেন জাতীয় উদ্যানের অংশ। ওখানে বিশেষ করে দুটি দর্শনীয় স্থান আছে, একটি কেপ পয়েন্ট ও লাইট হাউজ এবং অন্যটি কেপ অব গুড হোপ।

ছবি: মহীন রীয়াদ
এক সময় সমুদ্র চোখের সামনে থেকে বিদায় নিলো। এখন দু পাশেই শুধু সমতল ভূমি এবং সবুজ পাহাড়ের অংশ। এখান থেকে দুটি রাস্তা দু দিকে চলে গেছে, একটি কেপ টাউন ফেরার এবং অন্যটি সোজা জাতীয় উদ্যানের দিকে। কিছুটা সামনে ড্রাইভ করে গেলেই চেক পয়েন্ট এবং ওখানেই টিকেট কেটে নিতে হয় (ঠিক আমাদের দেশে বিভিন্ন ব্রিজ বা ফ্লাইওভারে যেমনভাবে টোল সংগ্রহ করা হয়)।

এতোক্ষণ আমাদের ড্রাইভার সম্পর্কে তেমন কিছুই বলা হয় নাই। তার নাম ইব্রাহিম, আগেই বলেছি সে হাশিখুশি, ইয়াং এবং ব্যাপক ফ্রেন্ডলি। কথায় কথায় জানতে পারলাম তার মা ভারতীয় বংশদ্ভূত আর বাবা দক্ষিণ আফ্রিকার। যদিও সে হিন্দি বলতে পারে না তবে তার অনুরোধে আমাদের নেপালি বন্ধুরা তাকে কিছু হিন্দি গানও পথিমধ্যে বাজিয়ে শুনালো। যাইহোক, এখানে টিকেট কাটার নিয়ম হলো, যদি কেউ গাড়ি ভাড়া করে নিয়ে আসে সেক্ষেত্রে ড্রাইভারের টিকেটও তাদের বহন করতে হয়। কিন্তু উবার বা অন্য কিছু হলে সেক্ষেত্রে উবারই ড্রাইভারের টিকেটের দাম বহন করে।

আমরা যেহেতু উবার আগেই ক্যান্সেল করেছিলাম তাই ইব্রাহিম নিজ থেকেই একটা বুদ্ধি বের করলো। জনমানবশূন্য উপত্যকায় একপাশে গাড়ি থামিয়ে সে আমাকে উবার রিকুয়েস্ট পাঠাতে বললো। পরে চেক পয়েন্টে সে তার টাকা নিজেই পরিশোধ করে দিলো এবং সেখান থেকে খানিকটা সামনে এসে আবার উবার রাইড শেষ করে দিলো। এখানে প্রবেশের মূল্য প্রত্যেকের জন্য ১৪৫ রেন্ড। ছোট বাচ্চাদের জন্য দক্ষিণ আফ্রিকার প্রায় সব দর্শনীয় স্থানেই মূল দামের অর্ধেক রাখা হয়।

কেপ পয়েন্ট। ছবি: মহীন রীয়াদ
ছোট ছোট গাছপালা ও জঙ্গলে ভরা সুন্দর একটা সমতল রাস্তা দিয়ে আমরা যাচ্ছি। এখানে যেতে যেতে রাস্তার দু পাশে ইলান্ড, জেব্রা, বেবুনসহ অনেক প্রজাতির প্রাণী চোখে পরবে। বিশেষ করে বেবুন ও অস্ট্রিচ রাস্তার পাশেই পাবেন। চাইলে গাড়ি থামিয়ে ছবিও তুলে নিতে পারবেন। তবে বিভিন্ন স্থানে বেবুনদের খাবার না দেওয়ার সাইনও চোখে পরবে। বেবুনদের অত্যাচার এতোই বেশি যে, এখানে এসে খাবার ও আপনার ব্যাগ ঠিকঠাকমত না রাখলে পরে পস্তাতে হতে পারে। এছাড়া এই এলাকায় ১১০০ প্রজাতির বিভিন্ন উদ্ভিদ পাবেন যেটি পৃথিবীর আর কোথাও পাওয়া যায় না।

কেপ পয়েন্টের রাস্তায় সতর্কতা সাইন
আমরা প্রথমে কেপ পয়েন্টের লাইট হাউজের সামনে এসে উপস্থিত হলাম। ওখান থেকে উপরে উঠে আপনি চারপাশের দৃশ্য দেখে নিতে পারেন, তবে সহজে উঠার জন্য ক্যাবল কার রয়েছে। এই পয়েন্ট থেকে হেঁটে হেঁটেও কেপ অব গুড হোপে যাওয়া যায়। সব মিলিয়ে ৩/৪ ঘন্টা হাঁটতে হতে পারে। আমাদের কাছে খুব বেশি সময় না থাকায় এখানে আমরা বেশিক্ষণ অপেক্ষা করিনি। যেদিক থেকে এসেছিলাম আবার সেদিক ২ কি.মি. এর মত গিয়ে বামে টার্ন নিয়ে সমুদ্রের পাশ দিয়ে চলতে লাগলাম। একটু সামনেই দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমের শেষ মাথা কেপ অব গুড হোপ।

ছবি: মহীন রীয়াদ
গাড়ি থেকেই দক্ষিণ আটলান্টিকের গর্জন শুনতে পাচ্ছি। গাড়ি থেকে নামার পর আমরা এতোটাই বিমোহিত হয়েছিলাম যে, কেউ কারো জন্য অপেক্ষা করিনি। পাহাড় সমান ঢেউ এসে বিশাল বড় বড় বেলেপাথরের বোল্ডারের উপর আছড়ে পরছে। এখানে এসে মনে হচ্ছিল, আমি কোন পৌরাণিক বা অ্যাডভেঞ্চার সিনেমার সেটের মধ্যে আছি। সবকিছু হাজার বছর আগে যেমনটি ছিল ঠিক তেমনি আছে। লবণাক্ত পানির ঢেউ বছরের পর বছর বোল্ডারগুলোতে আছড়ে পরায় সেগুলো কালচে হয়ে গেছে। আর বেলেপাথরগুলো কিনারাতে এমনভাবে স্তরে স্তরে সাজানো যেটা দেখে ভূগোলের সেই কঠিন শিলাস্তরের অঙ্কিত চিত্রের কথা মনে পরছিল।


ঢেউ আছড়ে পরার শব্দ, আটলান্টিকের বাতাস সব মিলিয়ে রোদ থাকলেও কিছুটা শীত শীত লাগছিল। এখান থেকে আস্তে আস্তে নিচে নামতে শুরু করলাম। উদ্দেশ্য, বড় পাথরগুলোর উপর দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে হবে। তবে বেশ খানিকটা সামনে একেবারে খাদের কিনারায় একটি স্থানে একটু পরপরই বড় ঢেউ এসে প্রায় ৫০/৬০ ফুট উপরে একটি গুহার মত জায়গায় আছড়ে পরছে। ওখানে সাধারণত টুরিস্ট যায় না। জায়গাটা একেবারে কিনারায় ও ওখানে পৌঁছানোটাও বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু আমাদের যেতেই হবে। আমাদের ড্রাইভারও সাহস দিলো এবং সেও কোনদিন ওখানে যায়নি। সুতরাং কিনারা ধরে পিচ্ছিল পথে আমরা শেষ পর্যন্ত একজন আরেকজনকে টেনে নিয়ে পৌঁছাতে সক্ষম হলাম। মাঝে মাঝেই বড় ঢেউ উপরে উঠছে, আমাদের ভিজিয়ে দিচ্ছে। আর পানি অসম্ভব ঠান্ডা। এই স্থানটাতে ঢেউ ও শীতের তীব্রতা আস্তে অাস্তে বেড়ে যাওয়ার পর আমরাও চলে আসলাম।

খাদের কিনারায় গিয়ে ছবি তোলতে গিয়ে ঢেউয়ের তাড়া।
উপরে কালচে আকাশ নিচে সমুদ্র আর পাশে আদিকালের বেলেপাথুরে বোল্ডারগুলো মিলিয়ে মনে হচ্ছিল রুপকথার দেশে আছি। হলফ করে বলতে পারি, সারাদিন না খেয়েও জায়গাটাতে শুধুমাত্র বসে বসে বাতাস খেলেও আপনার দিন পার হয়ে যাবে। এখন পর্যন্ত আমি যত স্থান ঘুরেছি তার মধ্যে এটার মত আদি-প্রকৃতি ও এমন সুন্দর-নৈসর্গিক স্থান কোথাও দেখিনি। সন্ধ্যা হতে আর বেশি সময় নেই, তাই অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমাদের ফেরার পথ ধরতে হলো। গাড়িতে উঠার আগে বিখ্যাত ‘সাইনের’ সামনে ঝটপট ছবি উঠে নিলাম।

চ্যাপম্যান’স পিক
ফেরার পথে আমরা অন্য পথটি দিয়ে ফিরবো আগে ঠিক করেছিলাম। আমরা ফিরছি হাউট বে’র কিনারা ধরে। সামনেই রয়েছে চ্যাপম্যান’স পিক নামক পাহাড়। দক্ষিণ আফ্রিকার রাস্তা সম্পর্কে কিছু না বললেই নয়। দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবাসরত এক ভাইর কাছ থেকে শুনেছি (ভেরিফাই করিনি)। কেউ রাস্তায় দূর্ঘটনার কবলে পরলে, ভুক্তভূগী সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে রাস্তা খারাপ ছিলো এই অযুহাতে। যদি মামলা জিতে যায় সেক্ষেত্রে নাকি সরকারকে বেশ ভালো অংকের টাকা পরিশোধ করতে হয়। সরকার তাই কোন রিস্ক না নিয়ে সবসময়ই রাস্তার প্রতি বিশেষ নজর রাখে। ছোট কোন কিছু হলেও নাকি অতি দ্রুত ঠিক করে দেয়।


তবে আমরা ১ ঘন্টা পর এখন যে রাস্তায় প্রবেশ করতে যাচ্ছি সেটির খ্যাতি বিশ্বব্যাপী। চ্যাপম্যান’স পিকের কিনারা কেটে এই রাস্তা বানানো হয়েছে। রাস্তা থেকে নিচে তাকালে হাউট বে সোজা ১০০ মিটার নিচে। রাস্তাটি এতোই আঁকাবাঁকা যে, আপনি লেন পরিবর্তন করলে দূর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা ১০০%। ৫০ রেন্ড টোল দিয়ে আমরা প্রবশে করলাম। তারপর আমাদের অনুভূতি অনেকটাই ‘মুখ হা’ হওয়ার মত। গাড়ি যতই যাচ্ছে ততই মনে হচ্ছে আমরা কোন রেসিং গেমের ইন্টারফেসের মধ্যে আছি। সেই সাথে পাহাড়ের চূড়া থেকে সন্ধ্যার রক্তিম সূর্য উঁকি দিয়ে দৃশ্যটা রূপকথার রাজ্য বানিয়ে ফেলেছে। রাস্তার মাঝে মাঝে পর্যটকরা যাতে থেমে ছবি তুলতে পারে বা কিছুটা বিশ্রাম নিতে পারে সে জন্য পার্কিং-এর জায়গা রাখা আছে। আমরাও ছবি তোলার জন্য নেমে পরলাম।

চ্যাপম্যান’স পিক ড্রাইভের এই ভিডিওটা দেখলেই, আর আমার বর্ণনা পড়ার প্রয়োজনই নেই :) (চিন্তিত হবেন না নিশ্চিন্তে ক্লিক করতে পারেন। এটি ফেসবুকের লিংক, ইউটিউবের ভিডিওর সমস্যার কারণে ইউটিউব লিংক দিতে পারলাম না।)


আবার যখন চলতে শুরু করেছি তখন সারাদিনের ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছিলো কিন্তু যতই সামনে গিয়েছি ততই মুগ্ধ হয়ে দেখেছি প্রকৃতিকে, দেখেছি কিভাবে সমুদ্রের তীরে, পাহাড়ের ঢালে বাড়িঘরগুলো তৈরি করা হয়েছে। দিনব্যাপী ভ্রমণ শেষে আমরা ৮টার দিকে আমাদের হোটেলে ফিরে আসি।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা নভেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৩:৪৭
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শীঘ্রই হাসিনার ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৩৮


পেক্ষার প্রহর শেষ। আর দুই থেকে তিন মাস বাকি। বিশ্ব মানবতার কন্যা, বিশ্ব নেত্রী, মমতাময়ী জননী, শেখ মুজিবের সুয়োগ্য কন্যা, আপোসহীন নেত্রী হযরত শেখ হাসিনা শীগ্রই ক্ষমতার নরম তুলতুলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কাছে থেকে আমির হোসেন আমুকে দেখা একদিন....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৪৬

আমির হোসেন আমুকে দেখা একদিন....

২০০১ সালের কথা। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একটা আন্তর্জাতিক দরপত্রে অংশ গ্রহণ করে আমার কোম্পানি টেকনিক্যাল অফারে উত্তীর্ণ হয়ে কমার্শিয়াল অফারেও লোয়েস্ট হয়েছে। সেকেন্ড লোয়েস্টের সাথে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সংস্কারের জন্য টাকার অভাব হবে না, ড. ইউনূসকে ইইউ

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:২৪



বুধবার (৬ নভেম্বর) দুপুরে ঢাকার তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ঢাকায় নিযুক্ত ইইউর রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার এবং সফররত এক্সটার্নাল অ্যাকশন সার্ভিসের এশিয়া ও প্যাসিফিক বিভাগের পরিচালক পাওলা... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নারী বুকের খাতায় লিখে রাখে তার জয়ী হওয়ার গল্প (জীবন গদ্য)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৩২



বুকে উচ্ছাস নিয়ে বাঁচতে গিয়ে দেখি! চারদিকে কাঁটায় ঘেরা পথ, হাঁটতে গেলেই বাঁধা, চলতে গেলেই হোঁচট, নারীদের ইচ্ছেগুলো ডিমের ভিতর কুসুম যেমন! কেউ ভেঙ্গে দিয়ে স্বপ্ন, মন ঢেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিশ্রী ও কুশ্রী পদাবলির ব্লগারদের টার্গেট আমি

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:০৫



আমাকে জেনারেল করা হয়েছে ১টি কমেন্টের জন্য; আমার ষ্টেটাস অনুযায়ী, আমি কমেন্ট করতে পারার কথা; সেটাও বন্ধ করে রাখা হয়েছে; এখন বসে বসে ব্লগের গার্বেজ পড়ছি।

সম্প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×