সকাল ১০টায় গায়ে আগুন ধরানো রোদ মাথায় নিয়ে দামবুল্লায় আমাদের হোটেল থেকে ৫ জন যাত্রা শুরু করলাম। গন্তব্য দামবুল্লা থেকে ৬৬ কি.মি. পূর্বে অবস্থিত সিংহলিদের প্রাণকেন্দ্র বলে পরিচিত মধ্য-উত্তর শ্রীলংকার প্রাচীন রাজধানী শহর পোলোনারুয়া। ১৯৮২ সালে ইউনেস্কো এ প্রাচীন শহরকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের স্বীকৃতি দিয়েছে। ১১ থেকে ১৩ শতাব্দী পর্যন্ত এটি শ্রীলংকার রাজধানী ছিল। আগের দিন রাতে ‘পোলোনারুয়া নকি অনুরাধাপুর যাওয়া উচিত’ সে নিয়ে অনেক তর্কের পর ‘পোলোনারুয়া’ জয়যুক্ত হলো এবং আমিও অবশেষে বিজয়ীর বেশে ঘুমাতে গেলাম। দামবুল্লা থেকে বাস, টুকটুক (আমরা যাকে সিএনজি বলি) অথবা গাড়ি ভাড়া করে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান পোলোনারুয়া যাওয়া যায়। টুকটুকের ভাড়া অত্যাধিক বেশি মনে হওয়ায় আমরা বাসেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
রাজ প্রসাদের মূল ভবন
দামবুল্লা মেইন বাস স্টপে সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ৩০ মিনিট পরপরই বাস পাওয়া যায়। দামবুল্লা শহরের প্রাণকেন্দ্রে মোড়ের মাঝখানে একটি টাওয়ার রয়েছে যার নাম ‘ক্লক টাওয়ার’। টাওয়ার থেকে একটু দক্ষিণে এগিয়ে যাওয়ার পরই বেশ কিছু বাস রাস্তার পাশেই চোখে পড়লো (টাওয়ার থেকে একটু উত্তরে ছাউনি দেওয়া একটি বাস স্টপ রয়েছে তবে সেখান থেকে কাছাকাছি শহরের বাসগুলো ছেড়ে যায়)। একজনকে পোলোনারুয়ার কথা বলতেই তিনি দেখিয়ে দিলেন কোন বাসে উঠতে হবে। অাপনি কলম্বোগামী ৪৮ নাম্বার বা ক্যান্ডিগামী ৪১ নাম্বার বাসে করে পোলোনারুয়া যেতে পারেন।
ছবি তুলেছে: দানিলা
৮০ শ্রীলংকান রুপি ভাড়ায় ১ ঘন্টা ২০ মিনিট পর আমরা পোলোনারুয়া পৌঁছলাম। আমরা যেখানে নেমেছি সেখান থেকে ১ মিনিট হাঁটা পথে টিকেট কাউন্টার ও টিকেট কাউন্টর থেকে মূল পোলোনারুয়া প্রাচীন শহরের গেটের দূরত্ব হাফ কি.মি.। তবে বিপত্তিটা বাঁধল বাস থেকে নামার পর। গত কয়েক সপ্তাহ গরম, রোদ ও বৃষ্টিতে শ্রীলংকা ঘুরে ঘুরে আমাদের দলের একজন এই বাস জার্নিটা সহ্য না করতে পেরে অসুস্থ হয়ে পরেছে। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পরও ভালো বোধ না করায় অবশেষে সে দামবুল্লা ফেরার সিদ্ধান্ত নিলো। অগ্যতা আমাদের একজনকেও তার সাথে যেতে হলো।
প্রচীন শহরটি বিশাল এলাকাজুরে অবস্থিত সুতরাং শহরের সবকটি সাইট আরামে দেখতে চাইলে টুকটুক বা গাড়ি ভাড়ায় পাওয়া যায়। তবে, নিজের মত করে দেখতে চাইলে বাই সাইকেল সবচেয়ে ভালো পন্থা। বাস যেখানে নামিয়ে দেয় সেখানে বেশ কয়েকটি সাইকেল রেন্টের দোকান রয়েছে। বাস থেকে নামার পরই তিনজন লোক এগিয়ে আসল সাইকেল লাগবে কিনা জানতে। সারাদিনের জন্য প্রতিটি ২০০ রুপি করে তিনটি সাইকেল ভাড়া করলাম (প্রথমে প্রতিটার জন্য ৫০০ রুপি চেয়েছিলো)। রাস্তা পার হয়ে টিকেট কাউন্টের গিয়ে ১২ হাজার রুপি দিয়ে তিনটি টিকেট কাটলাম। পোলোনারুয়া কমপ্লেক্সের ভেতরে যতগুলো স্থাপনা রয়েছে সবই এই এক টিকেটেই অন্তর্ভূক্ত। সার্কের নাগরিকদের জন্য টিকেটের দাম অর্ধেক কিন্তু সাথে মূল পাসপোর্ট (বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে ফটোকপি দেখিয়ে চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু কাজ হয়নি) না থাকায় পুরো টাকাই পরিশোধ করতে হলো।
চতুষ্কের স্থাপত্য
টিকেট কাউন্টারের পাশেই একটি ছোট জাদুঘর রয়েছে। আপনি চাইলে প্রাচীন শহরের বিভিন্ন তথ্য সেখান থেকে জেনে নিতে পারেন। আমরা জাদুঘরে না গিয়ে শহর কমপ্লেক্সের দিকে যাত্রা শুরু করলাম। কিছুদূর যাওয়ার পর মূল সড়ক থেকে প্রশস্থ একটি ইট বিছানো রাস্তায় প্রবেশ করলাম, দুপাশে অসংখ্য ছোট বড় গাছ। দুপুরের প্রখর রোদ ও গাছের ছায়া মিলিয়ে এক অদ্ভূত শান্ত পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। ১ মিনিটের মাথায় প্রথম টিকেট চেকিং। কমপ্লেক্সের ভেতরে বেশ কয়েকটি স্থানে টিকেট চেক করা হয়।
রাজ প্রসাদ কমপ্লেক্স
প্রাচীন পোলোনারুয়া অনেকগুলো সমষ্টিগত স্থাপনা নিয়ে একটি বিশাল শহর। শ্রীলংকার অন্য হেরিটেজ সাইটগুলোর চেয়ে বৌদ্ধ স্থাপত্য শিল্পের দারুন নিদর্শন শহরটি এখনো সবচেয়ে ভালো অবস্থায় আছে। প্রধান প্রবেশ পথ দিয়ে ডানে একটু এগিয়ে গেলেই চোখে পরবে রাজপ্রসাদ। মূল প্রসাদ কমপ্লেক্সটি বেশ কিছু প্রাচীন পরিখা পরিবেষ্টিত দেয়াল ঘিরে মধ্যখানে অবস্থিত। প্রাসাদটি ছিলো রাজা প্ররাক্রমবাহুর এবং ধারণা করা হয় এটি সাত তালা ভবন ছিলো। যদিও বর্তমানে আংশিক দেয়াল ছাড়া তেমন কিছু অবশিষ্ট নেই। তবে প্রাসাদে প্রবেশের পর দেয়ালে বিদ্যমান কারুকার্য, রাজকীয় গোসলখানা, পুকুর ও পুরো কমপ্লেক্সের ড্রেনেজ ব্যবস্থা নজর কড়ার মত।
রাজ প্রাসাদের ভেতরের অংশ
অধিকাংশ স্থপনা তৈরিতে লাইম মর্টার ব্যবহার করা হয়েছে। প্রাসাদের ঠিক সামনেই রয়েছে রাজসভার হল। রাজসভায় প্রবেশের ছোট সিঁড়িতে দুপাশে দুটি সিংহের স্থাপত্য, পিছনে সাড়িবদ্ধ পিলারযুক্ত হলটিতে আভিজাত্য ও রাজকীয়তার ছাপ স্পষ্ট। চারপাশের দেয়ালেই পাথরের তৈরি সিংহের কারুকার্য। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, সিংহের প্রতিটি কারুকার্যই একটি অপরটি থেকে আলাদা।
চতুষ্ক বা Quadrangle
রাজপ্রাসাদ কমপ্লেক্সের পাশেই রয়েছে একটি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। সেখানে কিছুটা থেমে ইট বিছানো ছায়াযুক্ত পথ ধরে আমাদের সাইকেল চলতে লাগল। শহরটিতে একটি প্রধান সড়ক রয়েছে যার দুপাশে মূলত স্থাপনাগুলো রয়েছে। আমরা থামলাম এসে চতুষ্ক বা Quadrangle-এর সামনে। পোলোনারুয়ার এই প্রাচীন শহরে যে কয়েকটি কমপ্লেক্স বেশি বিখ্যাত তার মধ্যে এটি একটি। পুরো কমপ্লেক্সের ভেতরে বৌদ্ধ মন্দিরসহ বেশ কিছু স্থাপনা রয়েছে। সবেচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল Polonnaruwa Vatadage, ধারণা করা হয় রাজা প্ররাক্রমবাহু গৌতম বুদ্ধের দাঁত সংরক্ষণের জন্য এই পবিত্র স্থানটি তৈরি করেছিলেন (যা বর্তমানে ক্যান্ডি শহরের ‘টেম্পল অব দ্য টুথে’ সংরক্ষিত আছে)। দূর থেকে স্থাপনাটি দেখতে অনেকটাই রোমের কলোসিয়ামের মত। প্রায় হাজার বছর পূর্বে তৈরি প্রাচীন ধ্বংসপ্রায় এ মন্দিরগুলো এখনো শ্রীলংকানদের কাছে পবিত্র, তাই প্রতিটি পবিত্র স্থাপনায় প্রবেশের পূর্বে জুতা খুলে ও সম্ভব হলে মাথা কাপড় দিয়ে ঢেকে প্রবেশ করতে হয়। চতুষ্ক কমপ্লেক্সের এই ভিডিওটি দেখতে পারেন।
শিব দেয়াল
এর মধ্যে প্রচণ্ড রোদে ক্লান্ত হয়ে কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে পুনরায় রওনা হলাম পরের স্থাপনার উদ্দেশ্য। এবার শহরের প্রধান রাস্তা থেকে ডানে ঘুরে বনের মধ্যে এবড়ো থেবড়ো, খোয়া ও ধূলাময় পথে কিছুদূর যাওয়ার পর তুলনামুলক ছোট একটি মন্দিরের সামনে উপস্থিত হলাম। ৯৮৫ থেকে ১০১৪ সালের মধ্যে নির্মিত শিব দেয়াল নামের এই মন্দিরটি এই শহরের সবচেয়ে প্রাচীন হিন্দু মন্দির। পুরো পাথরের তৈরি মন্দিরটি এখনো দেখতে ঠিক আগের মতই রয়েছে। এর ভেতরে একটি শিবলিঙ্গ আছে। আশেপাশের লোকদের থেকে জানতে পারলাম এখনো এখানে মাঝে মাঝে ধর্মীয় অচার-রীতি পালন করা হয়।
শিব দেয়াল
বিহার
মন্দির দেখা শেষে এবার আমাদের গন্তব্য পোলোনারুয়ার বিখ্যাত দুটি বিশাল বৌদ্ধ স্তূপ, রাণকোট বিহার ও কিরী বিহার। পথিমধ্যে পাবলো বিহার নামে আরও একটি বিহার চোখে পড়লো। তবে সেখানে খুব একটা সময় ব্যায় না করে সরাসরি চলে গেলাম রাণকোট বিহারে। বিশাল আকৃতির এই স্ট্রাকচারটি পুরোটাই ইটের তৈরি। বিশাল জায়গা জুড়ে অবস্থিত এই স্তুপের লাল নুড়ি বিছানো চওড়া প্রবেশপথটি একটি বাগানের মাঝখান দিয়ে এসে একেবারে মূল স্থাপনার সামনে এসে ঠেকেছে। এখান থেকে খালি পায়ে দু বার সিঁড়ি পার হয়ে মূল স্থাপনায় প্রবেশ করতে হয়। বিশালাকার স্তুপটি মাঝখানে অবস্থিত, এর চারপাশে স্পেস পাকা করা। গোলাকৃতির এ স্তুপটির চারপাশে পূজা আর্চনার জন্য ছোট ছোট খোপ খোপ করা ঘর রয়েছে। দেয়ালগুলোতে করা অসাধারণ নকশাগুলোর অধিকাংশ বিলীন হয়ে গেলেও কিছু কিছু টিকে আছে যা আপনাকে সে সময়ের স্থাপত্যের উৎকর্ষতার কথা মনে করিয়ে দেবে।
রণকোট বিহার
রণকোট বিহারের পর অমরা উপস্থিত হলাম কিরী বিহারে। অন্য বুদ্ধ স্তুপ থেকে এটি সম্পূর্ণই আলাদা। সাদা ধবধবে রং করা স্তুপটিতে রোদের আলো পরায় গাছপালার মাঝ দিয়ে দেখতে অসাধারণ লাগছে। ইতিহাস থেকে জানা গেলো, এটি নির্মাণ করেছিলেন রাণী সুভেন্দ্র। প্রত্নত্ত্ববিদরা এ সাইটটি যখন আবিষ্কার করেন তখনও ৭০০ বছরের পুরোনো এ স্থাপনাটির রং যেমন ছিলো, এখানো ঠিক তেমনি আছে। রাণকোট বিহারের মত এর চারপাশেও ভিক্ষুদের জন্য তৈরি ছোট ছোট ঘরের মত স্ট্রাকচার রয়েছে।
কিরী বিহার
লঙ্কাতিলকে
প্রাচীন শহরের আরও একটি আকর্ষন হলো লঙ্কাতিলকে। এশিয়ায় প্রাচীন যে কয়েকটি অসাধারণ বৌদ্ধ মূর্তি রয়েছে তার মধ্যে লঙ্কাতিলকে একটি। ইটের তৈরি এই বিশালাকার স্ট্রাকচারটি এমনভাবে স্থাপন করা হয়েছে যেন মনে হচ্ছে কেউ ৫৫ ফুট উঁচু দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মথার অংশটি যদিও এখন আর বোঝার উপায় নেই, ঘরের ছাদটিও নাই হয়ে গেছে। দেয়ালের বাইরের অংশে বিভিন্ন ধরণের নকশা করা আছে। সিঁড়ির স্পিনডলে নাগিন ফিগার আঁকা। শ্রীলংকার প্রাচীন ভবনগুলোতে নাগ বা নাগিনের কারুকার্য সাধারণত ভবনের প্রবেশপথে গার্ড হিসেবে বসানো থাকে তবে শুধুমাত্র এই সাইটটিতেই ব্যতিক্রম।
লঙ্কাতিলকে। ছবি: Bernard Gagnon
এই স্থাপনাগুলো ছাড়ও গাছ-পালা ও জঙ্গলে ঘেরা এ প্রাচীন শহর কমপ্লেক্সে আরও বেশ কিছু স্থাপনা আছে। এর মধ্যে গল বিহার উল্লেখযোগ্য। গল বিহারে বোধিসত্ত্বকে দুটি পদ্মাসনসহ বিশ্রামরত ও শয়ন অবস্থায় ৪টি রূপে উপস্থাপন করা হয়েছে। গল বিহার দেখার পর তার পাশেই পুকুর পাড়ে বিশ্রাম নিলাম। গত দশ বছরে আমি কবে সাইকেল চালিয়েছিলাম তা মনে করতে পারবো না। এতোদিন পর হঠাৎ করে এতো রোদের মধ্যে এমন ৩ ঘন্টা টানা সাইকেল চালানোর পর আমি আর উঠতেই পারছিলাম না। ঠিক সে সময় সঙ্গী দুজন জানালো, আরও নাকি বেশ কিছু সাইট দেখা তখনও বাকি।
রণকোট বিহারের দেয়ালের গায়ের নকশা
এরপর অনিচ্ছাসত্ত্বে আরও কয়েকটি ছোট ছোট সাইট দেখে, আমরা সিংহলীদের এক সময়ের শৌর্য-বীর্যের সাক্ষী বহনকারী প্রাচীন শহর থেকে বের হলাম। সাইকেল জমা দিয়ে রাস্তার পাশ থেকে দামবুল্লাগামী একটি বাসে উঠে পড়লাম। তবে এবার বাসের ভাড়া নিয়েছে ১০০ রুপি।
দাবিত্যাগ: এই ব্লগটি এরপূর্বে আমার ব্যক্তিগত ব্লগে প্রকাশ করেছিলাম। যে ছবিগুলো আমার তোলা নয় সেগুলোতে ক্রেডিট দেয়া হয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই অক্টোবর, ২০১৮ রাত ১:৩৮