পাখিদের কিচির মিচির শব্দে মুখরিত লেকের চারপাশ।জনমানব খুব একটা নাই বললেই চলে।মাঝে মাঝে লেকের ধারে দুই-এক জোড়া প্রেমিক-প্রেমিকার দেখা মেলে। বাদামওলারা তাদের আশেপাশে ঘুরতে থাকে। কেউবা বাদাম কিনে কেউবা দুই মন এক করে গল্প করতে থাকে। এদের মাঝে একজন অন্য রকম।সবার থেকে আলদা হয়ে মনের মাধুরী মিশিয়ে ছবি এঁকে যাচ্ছে। ছবিতে ফুটে উঠেছে লেকের ধারে বসে থাকা এক জুগলের ঠিক উপরে বসে থাকা এক জোড়া পাখি। যেন সাক্ষ্য দিচ্ছে প্রেমের, যে প্রেমের কোন নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই, নেই কোন প্রজাতি ভেদ।
সে একমনে ছবি এঁকে যাচ্ছিল। হঠাত এক লোক এসে দাঁড়াল তার পাশে। সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট আর লাল টাই পড়া সেই লোকটি বলল,
-Good noon ma’am. এই চিঠিটা আপনার জন্যে।
নির্বাক পরী কোন কথা না বলে লোকটির দিকে তাকালো। লোকটি আবারো বলল, খুলে দেখুন প্লিজ। পড়লে বুঝতে পারবেন।
নির্বাক পরী চিঠিটা খুলে পড়তে লাগল।
[প্রিয় নির্বাক পরী,
মনে হচ্ছে খুব অবাক হচ্ছো। হওয়ারই কথা। তবে এর সাথে আর একটু যোগ করি। দয়া করে লোকটির সাথে তাকে অনুসরণ কর। ঘাবড়ানোর কোন কারণ নেই। তুমি নিরাপদেই থাকবে।
ইতি
আমি]
চিঠি পড়ার পর সে তার ব্যাগ থেকে একটি প্যাড বের করে লিখল,
-আপনারা কারা? কী চান? কোথা থেকে এসেছেন?
লোকটি তার পকেট থেকে একটি চিরকুট বের করে তার হাতে দিল,
-আমি তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী। হয়তো কাছের কোন একজন।
নির্বাক পরী আবার লিখল,
-কিন্তু আমি আপনাদের সাথে যাব কেন? সরি আমি যেতে পারব না।
লোকটি আবার তার পকেট থেকে একটি চিরকুট বের করে তার হাতে দিল,
- কিন্তু তোমার সাথে দেখা করাটা খুব জরুরী। তুমি যদি নিজেকে নিরাপদ মনে না কর তবে তোমার আঙ্কেল এই থানার ওসি জহুরুল হকের সাথে কথা বলতে পার।
লোকটি এবার মোবাইল বের করে ওসিকে ভিডিও কল করল।
[ভিডিও কল]
-হ্যালো, মামনি। তুমি কোন চিন্তা করো না। আমরা সব সময় তোমাকে নজরদারীতে রাখছি। তোমার কোন ক্ষতি হবে না। [লাইন কেঁটে গেছে]
লোকটি আবারো একটি চিরকুট বের করল,
-মিস নির্বাক পরী, আমরা কি এবার দেখা করতে পারি?
নির্বাক পরী কোন উত্তর না দিয়ে লোকটির সাথে হাঁটা শুরু করল। লোকটি আর্টের জিনিস গুলো ব্যাগে নিল। রাস্তার কাছেই একটা কার দাঁড়ানো ছিল। লোকটি কারের দরজা খুলে দিল। নির্বাক পরী কারে বসার পর ড্রাইভার কার ছেড়ে দিল।
কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে কিছুই জানে না সে। খানিকটা ভয় সেই সাথে অস্বস্থি লাগছে তার। কিছুক্ষণ পর ড্রাইভারকে একটা চিরকুট দিল সে।
-আমরা কোথায় যাচ্ছি?
ড্রাইভারও পকেট থেকে একটা চিরকুট বের করল,
-পদ্ম বিলাসীতে।
আবারো একটা চিরকুট লিখল,
-সেখানে আমরা কার সাথে দেখা করব?
উত্তরে ড্রাইভার আরেকটা চিরকুট বের করল,
-একটু অপেক্ষা কর। দেখা আমাদের হবেই। কারণ আমি অপেক্ষা করছি শুধু তোমার জন্যে।
অবশেষে কার এসে থামল। একটি মেয়ে এসে দরজা খুলল।
-Ma’am, please come with me. নির্বাক পরী কোন কথা না বাড়িয়ে তাকে অনুসরণ করতে লাগল।
মেয়েটির সাথে সে হেঁটে চলছে। যতই সময় গড়াচ্ছে ততই সে অবাক হচ্ছে। কী অদ্ভুত সবকিছু। একের পর একজন এসে তাকে নিয়ে যাচ্ছে আর সে এগিয়ে যাচ্ছে। অথচ সে তাদের চিনেই না। তাছাড়া ওদের কোন কথা জিজ্ঞেস করলে তারা কোন উত্তর দেয় না। সব যেন আগে থেকে লিখে রাখা চিরকুট। তার মনে হচ্ছে চিরকুট গুলো এমন একজন লিখেছে যে জন তাকে হাজার বছর ধরে চিনে। যে তার প্রতিটি নিঃশ্বাস বুঝতে পারে। মনে হচ্ছে এ যেন স্বপ্ন। সেই স্বপ্নের ঘোরে কেউ একজন তাকে ডাকছে। যাকে দেখার খুব ইচ্ছে হচ্ছে তার।
কথা গুলো ভাবতে ভাবতে সে থাকল একটা ড্রেসিং রুমের সামনে। রুমে দাঁড়ানো মেয়েটা তার হাতে একটি চিরকুট ধরিয়ে দিল।
“অবাক হবার কিছু নেই। এটা স্বপ্ন নয়, বাস্তব। তুমি আসবে বলে আমি সব তৈরি করে রেখেছি। অন্য কারো সাথে নও, তুমি আমার সাথেই কথা বলছ। যদি কিছু মনে না করো তোমার ড্রেসটা কি চেঞ্জ করবে? যদি ইচ্ছে হয় তবে এখানে সাজানো পোশাক থেকে যেকোন একটি পড়তে পার। এখানে সাজানো সব পোশাকই আমার উপহার, তোমার জন্যে। যদি গ্রহণ কর তবে ধন্য হব। কিছু মনে করো না। একটা কথা বলি, নীল শাড়িতে তোমাকে অনেক সুন্দর দেখায়।“
নির্বাক পরী মেয়েটির সাথে রুমে প্রবেশ করল। বেশ কয়েকটা পোশাক আছে সেখানে। একটা পড়ে যখন আয়নার সামনে দাঁড়ালো তখন যেন নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করল সে। সত্যিই নিজেকে খুব সুন্দর লাগছে তার। কি আশ্চর্য! অচেনা এক ছেলের কথায় নীল শাড়িটিই পড়ল সে। নিজেকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে মেয়েটি তার হাতে আবারও একটি চিরকুট দিল।
“চমৎকার! আমার কথা মত নীল শাড়িটিই পড়বে আসা করিনি। অদ্ভুত কিউট লাগছে তোমাকে। অসাধারণ সুন্দরী তুমি। যা আমার খালি চোখ কল্পনাই করতে পারে না।“
পোশাক পড়ার পর্ব শেষে মেয়েটি তাকে নিয়ে একটা বিশাল দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। এরপর মেয়েটি ওপেন বাটন চাপ দিয়ে চলে গেল। নির্বাক পরীকে অনেক নার্ভাস লাগছে। এখনো মনে হচ্ছে সে স্বপ্ন দেখছে। যে ঘোর এখনো কাঁটছে না। নিজের গায়ে নিজে চিমটি কাঁটছে। এসব করতে করতে দরজা খুলে গেল। দরজার ওপাশে সারি সারি টেবিল সাজানো আছে কোন জন-মানব নেই। ভায়োলিনে শব্দ ভেসে আসছে। কি ঘটতে চলছে কিছু বুঝা যাচ্ছে না। খানিকটা চিন্তা করে একটা টেবিলের সামনে বসল সে। কিছুক্ষণ পর একজন বয় এসে একটা চিরকুট দিল।
-“লাঞ্চ করাবো বলে এত কষ্ট দিলাম। নিশ্চয় প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে? খাবারের মেনু দেয়া আছে। যা ইচ্ছে অর্ডার করো।“
নির্বাক পরী খাবার অর্ডার করল। বয় চলে গেছে। ভায়োলিনের শব্দ মধুর থেকে মধুরতর হতে লাগল। একা বসে থাকতে কি আর ভাল লাগে? তাই অগত্য ব্যাগ থেকে প্যাড নিয়ে লিখতে শুরু করল। কয়েকটা চিরকুট লেখার পর একলোক এসে জিজ্ঞেস করলঃ
-বসতে পারি? (সে কোন উত্তর দিল না। তাই ছেলেটি আবারও বলল।)
-আমি জানি তুমি কারো জন্যে অপেক্ষা করছ। (নির্বাক পরী মাথা নাড়ায়)
-সেই ছেলেটি আমি। আমি নিহাল। (নির্বাক পরী তার প্রথম চিরকুটি ফেলে দেয়)
-তুমি নিশ্চয় বুঝতে পেরেছ আমি তোমাকে চিনি। আমার বিশ্বাস তুমিও আমাকে চিনতে পারবে যদি আমি আমার পরিচয়টা দেই। (কথার ফাঁকে খাবার চলে এসেছে। খাবার টেবিলে সাজানো হল। বয় চলে যাওয়ার পর নিহাল আবার বলতে লাগল।)
-চল শুরু করি। খেতে খেতে বাকীটুকু পরিচিত হওয়া যাবে।
এ সময় নির্বাক পরী আরেকটা চিরকুট লিখার জন্যে প্রস্তুত হয় ঠিক সে সময় নিহাল বলে,
-তোমার কিছু লেখা লাগবে না। আমি সব বলছি। যদিও আমি বেশি কথা বলি না। তবুও আজ বলব। ১ বছর ২১ দিন অপেক্ষার সময় যে কথা গুলো জমেছে আজ সব বলব। হ্যাঁ আমি। আমি সেই ছেলেটি যে আজ থেকে ঠিক ১ বছর ২১ দিন আগে তোমাকে বলেছিলাম, ভালবাসি। ফেসবুকের জগতে আমরা দুজনেই ছিলাম অপরিচিত। তোমার সাথে সারা রাত চ্যাট হত আমার। অথচ তোমাকে চিনতাম না। তবুও তোমায় বলেছিলাম ভালবাসি। আর তুমি বলেছিল, তোমার সম্পর্কে জানলে আমি তোমাকে ছেড়ে চলে আসব। তুমি ভয় পেয়েছিলে। তোমার সম্পর্কে জানার সুযোগ সেদিন তুমি দাও নি। ফেসবুক থেকে দূরে চলে গিয়েছিলে। আজ আমি সেই তোমাকে খুঁজে পেয়েছি। তোমার সম্পর্কে জেনেছি। আর আজ তোমার সম্পর্কে জেনেই বলছি, ভালবাসি।
এরপর নিরবতা। ভায়োলিনের সুর ধীরে ধীরে করুন হচ্ছে। রাস্তা থেকে মাঝে মাঝে গাড়ীর হর্ণের আওয়াজ আসছে। নির্বাক পরী একমনে খেয়ে যাচ্ছে। আর নিহাল অসহায় চোখে তার দিকে চেয়ে আছে। অনেক্ষণ নিরবতা শেষে নিহাল একটি চিরকুট লিখল।
-“একটু সুযোগ দাও ভালবাসার।“
খাওয়া শেষে টিস্যুতে হাত মুছতে মুছতে একটা তৃপ্তির ঢেকুর তুলল নির্বাক পরী। তারপর টেবিলে একটা চিরকুট রাখল সে। নিহালের দিকে একবার চেয়ে, ধীর পায়ে হাঁটতে লাগল দরজার দিকে। নিহাল তার দিকে এক নজরে চেয়ে আছে । দরজার আড়াল হওয়ার পর চিরকুট খুলল সে। যেখানে লেখা আছে,
-“ধন্যবাদ, আবার দেখা হবে।"
১ম অংশ পড়তে ক্লিক করুনঃ নির্বাক পরী
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১২:৩০