মানব সভ্যতার তৃতীয় ঢেউ
(The Third Wave)
মূলঃ এ্যালভিন টফলার (Alvin Toffler)
ভাষান্তর ও সম্পাদনায়ঃ স্কোয়াড্রন লিডার আহ্সান উল্লাহ (অবঃ)
ভূমিকা
সময়টা এমন- সন্ত্রাসীরা পণবন্দিদের নিয়ে মরণ-খেলায় মত্ত। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশংকা ছড়িয়ে আছে সবখানে। দুতাবাসগুলোর সন্ত্রাসের আগুনে পোড়ে। আক্রমনকারী ঝটিকা বাহিনীর সেনারা বুটের ফিতা বাঁধে। আমরা চোখ ছানাবড়া করে পত্রিকার হেডলাইন দেখি। সোনার দাম আর ভয়ের ব্যারোমিটারের পারদ অতীতের সকল রেকর্ড ছাপিয়ে উর্ধগামী। ব্যাংকগুলো ভয়ে ও দূর্বলতায় কম্পমান। মুদ্রাষ্ফিতি যেন বাধা-বন্ধনহীন ক্রোধে উম্মত্ত। বিশ্বের সরকারগুলো যেন পক্ষাঘাতগ্রস্থ বা মানসিক প্রতিবন্ধী রোগে আক্রান্ত। এই পরিস্থিতির মুখোমুখিতে প্রকৃতি যেন শোকসন্তপ্ত। কেসেন্দ্রাদের অন্তিম সর্বনাশা সঙ্গীতের মূর্ছণায় বাতাস যেন ভারী। আউল বাউল-পীর-ফকির আর জ্ঞানীরা এ অবস্থাকে বলেন “উম্মত্ত পৃথ্বি”, বিশেষজ্ঞরা তর্জনী নির্দেশ করেন আসন্ন বিপর্যয়ের দিকে।
মানব সভ্যতার তৃতীয় ঢেউ বইখানি অত্যন্ত দৃঢ় ও সুস্পষ্টভাবে এই পরিস্থিতির বিপক্ষে ভীন্নমত পোষণ করে। এতে বলার চেষ্টা করা হয়েছে যে, বিশ্বটা উম্মত্ততার দিকে নয় ; বরং আপাতদৃষ্ট এসব শোরগোল আর কান্ডজ্ঞানহীন ঘটনাবলীর আড়ালেই রয়েছে চমকপ্রদ ও সম্ভাবনাময় আশাব্যঞ্জক আদর্শ নিয়ম শৃংখলা। বইখানি তারই আশার বানী এবং আদর্শ রীতি নীতির বাহক। বইখানি তাঁদেরই ভাল লাগবে যাঁরা ভাবেন মানুষের ইতিহাস ও মানবিকতার গল্প শেষের পথে নয়, কেবলমাত্র শুরু হয়েছে।
কাজ, ক্রীড়া, বিয়ে, সন্তান জন্মদান ও লালন পালন এবং সর্বশেষে অবসর গ্রহণ ইত্যাদি গতানুগতিকতার এক শক্তিশালী ঢেউ এসে আজকের বিশ্বের অধিকাংশটাই প্লাবিত করে ফেলেছে এবং এক অদ্ভুত অভিনব পরিবেশ তৈরী করেছে।
এই বিভ্রান্তিতে পড়ে, বণিকরা অনিশ্চিত অর্থনীতির প্রবল স্রোতে হাবুডুবু খাচ্ছে ;
রাজনীতিকরা তাঁদের জনপ্রিয়তা ও গ্রহনযোগ্যতার দ্রুত উত্থান-পতন প্রত্যক্ষ করছে ; বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো বেপরোয়াভাবে মুদ্রাষ্ফিতির বিপক্ষে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। এই ঢেউয়ের তোড়ে একদিকে মানবিক মুল্যবোধের জাহাজ ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে মানুষ পরিবার, মসজিদ, মন্দির, গীর্জা, উপাসনালয় ও রাষ্ট্র নামক লাইফবোটে সজোরে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মরক্ষার ব্যর্থ চেষ্টা করছে।
এরূপ পরিবর্তন দেখে, আমরা ভাবতেই পারি, এই অস্থিতিশীলতাই ভেঙ্গে পড়ার লক্ষণ। তবে যদি একটুখানি থেমে দূরে ফিরে দেখি, পরিবর্তনের বিষয়গুলো স্পষ্ট বুঝতে পারব, অন্যথায় হয়তো অজানাই রয়ে যাবে।
প্রথমেই বলতে হয়, আজকের অনেক পরিবর্তনই একক, বিচ্ছিন্ন ও স্বাধীনভাবে হয়নি। যেমন, ভেঙ্গে পড়া যৌথ পরিবার থেকে দুর্বল ছোট পরিবার, বিশ্বজুড়ে জ্বালানি সংকট, ধর্মীয় প্রার্থনার প্রথা ও ক্যাবল টিভির প্রসার ; কর্মীদের মোট কাজের ঘন্টা ঠিক রেখে নিজের পছন্দমতো সময়ে কাজ শুরু ও শেষ করার স্বাধীনতা এবং নতুন প্রান্তিক সুবিধাদির প্যাকেজের সূচনা ; কুইবেক থেকে কর্সিকা পর্যন্ত বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের উত্থান ইত্যাদি দেখে মনে হয় এগুলো একেকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কিন্তু নির্ভুল বিচারে উল্টোটাই আসলে সত্য। আপাত দৃষ্টিতে বিচ্ছিন্ন ও সম্পর্কবিহীন মনে হওয়া ঘটনা বা প্রবণতাগুলো মূলত অবিচ্ছিন্ন ও পরষ্পর সম্পর্কযুক্ত। বাস্তবিকভাবে, খন্ডিত ঘটনাগুলো বিশাল বড় একটি ঘটনার অংশমাত্র। আর তা হচ্ছে ইন্ডাস্ট্রিয়ালিজম বা শিল্পতান্ত্রিক সভ্যতার পতন এবং নতুন সভ্যতার উত্থান।
যতদিন আমরা এগুলোকে বিচ্ছিন্ন পরিবর্তন হিসেবে মনে করব, ততদিন বৃহত্তর গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের নাগাল পেতে ব্যর্থ হব এবং সঙ্গতিপূর্ণ ফলপ্রসু সাড়া পাওয়ার উপযোগী পরিকল্পনা করতে পারব না। ব্যক্তি হিসেবে আমাদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তসমূহ হবে উদ্দেশ্যহীন বা আত্ম-বঞ্চনা মূলক। গবর্নমেন্ট হিসেবে আমরা সংকটে পড়ে হোঁচট খেয়ে কেবল জরুরী কর্মসূচী গ্রহন করবো যা ভবিষ্যতে পরিকল্পনাহীন, আশাহীন ও দৃকশক্তিহীন অবস্থায় বিপদগ্রস্থ হব।
আজকের বিশ্বের শক্তিসমূহের মধ্যকার বিরোধ বুঝার উপযোগী সুশৃঙ্খল ও ধারাবাহিক কাঠামোর অভাবে আমরা যেন ঝড়ে আক্রান্ত সামুদ্রিক জাহাজের নাবিক ; কম্পাস বা চার্ট ছাড়া জাহাজ চালাচ্ছি বিপজ্জনক শৈলশ্রেনীর মাঝ বরাবর। একটি যুদ্ধাক্রান্ত বিশেষজ্ঞবাদের সংস্কৃতিতে, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র তথ্যভান্ডারে এবং সুচারু ও সুক্ষাতিসুক্ষ্ম বিশ্লেষণে আকন্ঠ নিমজ্জিত অবস্থায় থেকে আমাদের জন্য ঘটনার সংশ্লেষণ শুধুমাত্র প্রয়োজন নয়- অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণও বটে।
তাই তৃতীয় ঢেউ একটি বড়মাত্রার সংশ্লেষ।
এতে প্রাচীন সভ্যতার কথা বর্ণিত হয়েছে যার মধ্য দিয়ে আমরা বেড়ে উঠেছি। নতুন সভ্যতার বোধগম্য পরিচ্ছন্ন চিত্র সযতেœটনে্ব উপস্থাপন করা হয়েছে যা আমাদের মধ্য দিয়েই বিকশিত হচ্ছে। এই নতুন সভ্যতা এত প্রগাঢ়ভাবে বিপ্লবী যে ইহা আমাদের সকল পুরনো ধ্যান-ধারণা ও অনুমানকে চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। পুরনো উপায়ে চিন্তা-ভাবনা, পুরনো ফর্মুলা, গোঁড়া মতবাদ, ভাবাদর্শ, তা যতই সযত্নে লালিত হোক বা অতীতে যতই উপকারী হোক না কেন, আজ আর কার্যকরী ও মানানসই নয়। বিশ্ব এখন নতুন নতুন মূল্যবোধ ; প্রযুক্তি, ভূ-রাজনৈতিক সম্পর্ক, নতুন জীবন ধারা এবং যোগাযোগের ধরন প্রভৃতি দ্বন্দ্ব সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে আবির্ভূত ও বিকশিত হচ্ছে। ফলে তার চাই সম্পূর্ণ নতুন ভাব ধারা, সাদৃশ্যমান যুক্তি, শ্রেণী বিন্যাস এবং প্রগতিশীল ধারণা। আমরা আগামী বিশ্বের এই ভ্রুণকে অতীতের ধামাধরা বদ্ধ প্রকোষ্ঠে ঠেসে ঠেসে ঢুকতে পারি না। পারি না গোঁড়া বিশ্বাস, প্রথা, মনোভাব ও মেজাজ-মর্জিকে আঁকড়ে ধরে রাখতে।
এই বিস্ময়কর নতুন সভ্যতাকে উন্মোচিত করা হয়েছে এই বইয়ে। এতে আমরা বর্তমান তথাকথিত ভদ্র ও মার্জিত দুঃখবাদকে চ্যালেঞ্জ করার কারন ও যুক্তি খুঁজে পাব। বিক্রয়যোগ্য ও আত্ম-প্রশ্রয়ী হতাশা প্রভাবিত করে রেখেছে আমাদের সংস্কৃতিকে যুগ যুগ ধরে “তৃতীয় ঢেউ” এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, হতাশা শুধু নৈতিকতা বিরোধী নয় অপ্রয়োজনীয়ও বটে।
আমি কাল্পনিক আশাবাদের বিভ্রান্তিতে ভুগি না। পৃথিবী বিধ্বংসী আনবিক বোমা এবং পরিবেশ দূষণ বিপর্যয় থেকে শুরু করে সাম্প্রদায়িক উগ্রবাদ ও আঞ্চলিক সহিংসতা পর্যন্ত যে সব বিপদ ও ঝুঁকির মুখোমুখি আমরা সবসময়, তার বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা একান্তভাবে প্রয়োজন। আমি তারই করার চেষ্টা করেছি। যুদ্ধ, অর্থনৈতিক দুর্যোগ, বৃহদাকার প্রযুক্তিগত বিপর্যয় ইত্যাদি যে কোন বিপদ আকস্মিক বিপত্তি ঘটিয়ে ভবিষ্যতের ইতিহাসকে পাল্টে দিতে পারে। তারপরও যেহেতু আমরা অনেক নতুন নতুন সম্পর্ক বার বার লক্ষ্য করি ; পরিবর্তিত এনার্জি প্যাটার্ণ, ক্ষুদ্র আকৃতির পারিবারিক জীবনের সম্পর্ক বা অগ্রসরমান ম্যানুফ্যাকচারিং প্রক্রিয়া ও আত্মনির্ভরতা আন্দোলনের সম্পর্ক প্রভৃতি খুঁজতে গিয়ে হঠাৎ আবিস্কার করি যে, একই ধরনের বহু পারিপার্শ্বিক অবস্থা যেমন আজকের সভ্যতার ধ্বংসের কারন, তেমনি আকর্ষনীয় নতুন নতুন সভ্যতার সম্ভাবনারও সৃষ্টি করছে। ‘তৃতীয় ঢেউ’ এই নতুন সম্ভাবনাকেই দেখে। ক্ষয় এবং ধ্বংসের মধ্যেই জন্ম ও জীবনের লক্ষণ ফুটে ওঠে। এটা স্পষ্ট এবং আমি মনে করি তর্কাতীত যে, ভাগ্যের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে বুদ্ধির জোরে নতুন আভির্ভূত সভ্যতাকে আরও সুষম, ব্যবহারসিদ্ধ নিরবচ্ছিন্ন, আরও শোভন এবং আরও গণতান্ত্রিক করা যায়, যা আমরা ইতিপূর্বে কখনো দেখিনি। যদি এই বইয়ের যুক্তি সঠিক হয় তবে আশু অন্তর্বর্তিকালীন দিনগুলো সংকটাপন্ন হলেও দীর্ঘমেয়াদী আশাবাদ অবশ্যই করা যায়।
ব্যাপক বিস্তারিত সংশ্লেষণকে সংক্ষিপ্ত করতে গিয়ে বইয়ের বিষয়গুলো এমন হয়েছে যে, কোন কোন ইতিহাস বেত্তা সভ্যতাকে তিনটিভাগে বিভক্ত করতে পারেন ; প্রথম ঢেউ কৃষি বিপ্লব, দ্বিতীয় ঢেউ শিল্পবিপ্লব এবং তৃতীয় ঢেউ বর্তমান বিপ্লবী পর্যায়ের শুরু।
সহজভাবে বলতে গেলে, কৃষি ভিত্তিক সভ্যতা সম্পূর্ণ ভীন্ন সংস্কৃতির এবং শিল্পভিত্তিক সভ্যতা নিজেই বিকাশের কয়েকটি স্তর পরপর পার হয়ে এসেছে। কেউ চাইলে এই স্তরগুলোকে ১২, ৩৮ বা ১৫৭ ভাগে বিভক্ত করতে পারেন। তবে তা করা হলে প্রধান বিভাগগুলো উপবিভাগের ভীড়ে হারিয়ে যাবে। অথবা একই বিষয়ে লিখতে গিয়েএকটি বইয়ের বদলে গ্রন্থাগার রচনার প্রয়োজন হয়ে পড়বে। তাই আমাদের প্রয়োজনানুযায়ী মোটামুটি সহজতর বিভাজন করা বেশী উপযোগী হবে বলে মনে করি।
বিশাল পরিধির এই বিষয়টিতে আরও কিছু বিষয় সহজ ও সাবলীল করা প্রয়োজন। তাই আমি সভ্যতাকে এভাবেই উল্লেখ করতে চাই যে, প্রথম ঢেউ বা দ্বিতীয় ঢেউ এটা করেছে বা সেটা হয়েছে। সুধী পাঠক নিশ্চয়ই জানেন যে, সভ্যতা আসলে কিছুই করে না, যা কিছু করার মানুষই করে। মানুষের অবদানকেই সভ্যতা নামে চালিয়ে আমরা সময় ও দম বাঁচাই। একইভাবে বোদ্ধা পাঠক মাত্রই জানেন যে, কোন ইতিহাসবেত্তা বা ভবিষ্যবাদী, পরিকল্পক, জ্যোতিষী, ধর্ম-প্রচারক কেউই আসলে জানেন না ভবিষ্যতে কি ঘটবে। যদি আমি বলি কিছু অবশ্যই ঘটবে, আমি মনে করি, পাঠক যথার্থভাবে পুরোপুরি বিশ্বাস না করে, অনিশ্চিতই মনে করবেন। তা না হলে বইটি পড়ার অনুপযোগী বিষয়ে বোঝাই হয়ে যাবে এবং বেদরকারী আপত্তিকর বিষয়ের জংগলে পরিনত হবে। তাছাড়া সামাজিক বিষয়ে ভবিষ্যতবানী কখনো বিজ্ঞান সম্মত হয় না, তা যতই কম্পিউটরাইজড ডাটা ব্যবহার করা হোক না কেন। তৃতীয় ঢেউ একটি উদ্দেশ্যমূলক আগামবার্তা নয় এবং এটা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত কোন যুক্তিও নয়। তাই বলে এই বইয়ের ভাবনা-চিন্তা ও মতামতগুলো খাম-খেয়ালিপনা বা নিয়মশৃংখলাহীনও নয়। বস্তুতঃ আমাদের কাজগুলোর ভিত্তি হচ্ছে প্রচুর সুসংহত সাক্ষ্য প্রমাণ ও সভ্যতার আধা-সাংশ্রয়িক/প্রনালীবদ্ধ ক্ষুদ্রাকার প্রতিরূপ এবং তার সাথে আমাদের সম্পর্ক।
এতে ‘প্রযুক্তি বলয়’ ‘সমাজ বলয়’ ‘তথ্য বলয়’ এবং ‘শক্তি বলয়’ প্রভৃতি বিভিন্নভাবে মুমূর্ষ শিল্প সভ্যতার কথা বর্ণিত হয়েছে। এরপর দেখানো হয়েছে কেমন করে প্রতিটি বলয়ের মধ্যে বিপ্লবী পরিবর্তন রূপান্তরিত হতে হতে আজকের দুনিয়ার উন্মেষ ঘটেছে এবং এই অংশগুলো কিভাবে পরষ্পরের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেছে। এছাড়াও মনস্তাত্বিক ও ব্যক্তিক সম্পর্কের কাঠামো ‘জৈবিক বলয়’ ও ‘মানসিক বলয়’- এর পারস্পরিক সম্পর্কের মাধ্যমে বাইরের জগতের পরিবর্তনগুলো একান্ত ব্যক্তিগত জীবনকে প্রভাবিত ও পরিবর্তিত করছে। তৃতীয় ঢেউ বিশ্বাস করে যে, সভ্যতাও সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া ও নীতিমালা মেনে চলে, এর নিজস্ব বিবেক বুদ্ধি ও ভাবাদর্শের মাধ্যমেই বাস্ততাকে ব্যাখ্যা করে এবং নিজস্ব অস্তিত্বের ন্যায্যতা প্রতিপাদন করে।
এই খন্ড খন্ড বিচ্ছিন্ন টুকরো, প্রক্রিয়া ও নীতিমালাসমূহ কিভাবে পরষ্পর সম্পৃক্ত এবং কেমন করে পরিবর্তনের শক্তিধর স্রোতের সূত্রপাত ঘটিয়ে এরা একে অন্যকে বদলে দেয় এটা যদি একবার আমরা বুঝতে পারি, তবে আমরা আরও পরিস্কার ও সহজতরভাবে বুঝতে পারব কিভাবে পরিবর্তনের বিশাল ঢেউ আমাদের আজকের জীবনকে ভেঙ্গে চুরে একাকার করে দিচ্ছে। এই পরিবর্তনের সর্বোচ্চ রূপ হচ্ছে ঢেউগুলোর মধ্যে পারষ্পরিক বিরোধ ও সংঘর্ষ। তবে দ্বান্দ্বিক ভাবমূর্তিই আসল রূপ নয়। নর্বার্ট ইলিয়াস তাঁর ‘দি সিভিলাইজিং প্রসেস’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘অগ্রসরমান একটি ঢেউ বা পরিবর্তন সুসংহত হতে শত শত বছর লাগে’। পশ্চিমাদের আমেরিকায় উপনিবেশ গড়া প্রসঙ্গে একজন লেখক ১৮৩৭ খৃষ্টাব্দে বর্ননা করেছেন, ঢেউগুলো পরমপরা ছিল এরকম- প্রথম ঢেউয়ে এসেছিল অগ্রবর্তী অভিযাত্রী দল, তারপর জোতদার কৃষক কূল, অবশেষে ব্যবসা বানিজ্যে আগ্রহী বনিক কূল যারা অভিবাসের ‘তৃতীয় ঢেউ’। ১৮৯৩ সনে ফেডেরিক জ্যাকসন টার্নার, তাঁর ক্লাসিক রচনা ‘দি সিগনিফিক্যান্স অব দি ফ্রন্টিয়ার ইন এ্যামেরিকান হিস্টরি’-তে একই রকম যুক্তি উত্থাপন করেছেন। তাই, এক কথায় বলা যায় ঢেউ নামক রূপকল্প নতুন নয় বর্তমান সভ্যতার পরিবর্তনে এর নতুন প্রয়োগ হয়েছে মাত্র। এই প্রয়োগ অত্যন্ত ফলপ্রসূ বলেই প্রমানিত হয়েছে। ঢেউ ধারণাটি কেবলমাত্র বিশাল মাত্রার নানা রকম তথ্যাবলী সংগঠিত করার হাতিয়ার নয় ; প্রবল বাহ্যিক পরিবর্তনের আড়ালে কি আছে তা-ও দেখতে সাহায্য করে। ঢেউ রূপকালংকারটি প্রয়োগ করে আমরা অনেক বিভ্রান্তির বেড়াজাল থেকে মুক্ত হতে পারি। উজ্জ্বল ঝরঝরে আলোয় পরিচিত মুখ দেখে চেনার মত নিশ্চিন্ত হতে পারি।
আমি যখন ভাবতে শুরু করি পরিবর্তনের ঢেউগুলোর মধ্যকার সংঘর্ষ ও অধিক্রমণ আমাদের চারপাশে দ্বন্দ্ব ও উত্তেজনা বা চাপ সৃষ্টির কারণ, তখন পরিবর্তন সম্পর্কে আমার ধারণা বা প্রত্যক্ষণই পাল্টে যায়। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য থেকে প্রযুক্তি, ব্যক্তি জীবন থেকে রাজনীতি, সকল ক্ষেত্রে নতুন প্রবর্তিত রীতিগুলোর মধ্যে কোনটি স্রেফ সৌন্দর্যবর্ধক প্রসাধন, কোনটি শুধুমাত্র অতীত শিল্প ধারার প্রসারণ আর কোনটি সত্যিকার নতুন বিপ্লবী পরিবর্তনের ধারা এই পার্থক্য অনুধাবন করা সম্ভব হয়।
সবচেয়ে শক্তিশালী রূপকালঙ্কার ও আংশিক সত্যকেই প্রকাশ করে পুরোটা নয়। তবে বড় সত্য হচ্ছে, ভুল প্রশ্নের সঠিক উত্তর খোঁজার চেয়ে সঠিক প্রশ্ন করাটাই অধিক গুরুত্বপূর্ণ। আমার প্রত্যাশা, তৃতীয় ঢেউ সঠিক প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেয়ার পাশাপাশি অনেক নতুন নতুন প্রশ্নের জন্ম দেবে।
ইহা স্বীকৃত সত্য যে, মানুষ যেমন পুর্ণ নয়, তেমনি জ্ঞানও সম্পূর্ণ হয় না, রূপকালংকারও অখন্ডতা পায় না। তবে এটা উগ্র যুক্তিহীন গোঁড়ামিকে ঠেকাতে কাজ করে। যে কোন প্রতিকূল অবস্থায়ও এটা স্বীকার করে যে, সবকিছুই আংশিক সত্য এবং যে কারও নিজের ভুল হতে পারে। বিশেষকরে, বিস্তারিত সংশ্লেষণে গেলে ভুলের সম্ভাবনা, বেড়ে যেতে পারে। সমালোচক জর্জ স্টেইনার লিখেছেন, ‘প্রশ্ন যত বেশী বড় হয় ভুল উত্তরের সম্ভাবনাও তত বাড়ে। তবে একেবারেই প্রশ্ন না করা বুঝবার ক্ষমতাকে সীমিত করে ফেলে।
এক সময় সর্বগ্রাসী পরিবর্তনের স্রোতে যখন মানুষের ব্যক্তিগত জীবন বিঘœ বিপদ সংকুল হয়ে উঠবে, বিদ্যমান সকল প্রথা ও নিয়ম ভেংগে পড়বে, পাশাপাশি সমাজ দিগন্তে অভিনব নতুন জীবন ধারার আবির্ভাব ঘটবে- তখন ভবিষ্যত নিয়ে সবচেয়ে বড় যে প্রশ্নটি উঁকি দিবে তাতে শুধু বুদ্ধিদীপ্তভাবে জানবার কৌতুহল নয়, আমাদের অস্তিত্বের বিষয়টিও জড়িয়ে থাকবে । এরইমধ্যে সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে আমাদের অনেকের দ্বারাই নতুন সভ্যতার অগ্রগতি হয় সাধিত হচ্ছে, না হয় বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। বুঝে নিতে হবে, আমি কোন পক্ষের অগ্রগতির না বাধার! এব্যাপারে আশাকরি তৃতীয় ঢেউ বইখানি সাহায্য করবে ।
====সূচীপত্র====
মানবজাতির ভবিষ্যত রূপকার এ্যালভিন টফলারঃ
প্রথম ভাগঃ ঢেউয়ে ঢেউয়ে সংঘর্ষ
১. মহাসংগ্রাম
বিপ্লবী যুক্তি
ইঙ্গিতবাহী প্রান্তসীমা
ভবিষ্যতের ঢেউ
সোনার বেনে ও গুপ্তঘাতক
দ্বিতীয় ভাগঃ দ্বিতীয় ঢেউ
২. সভ্যতার নির্মান কৌশল
সহিংস সমাধান
জীবন্ত ব্যাটারি
প্রযুক্তির গর্ভাশয়
সিঁদুর রংয়ের চেইন স্টোর
ছোট পরিবার
আভ্যন্তরীণ পাঠক্রম
অমর সত্ত্বা
সঙ্গীত কারখানা
৩. অদৃশ্য গোঁজ বা ঠেকা
বাজারের অর্থ
লিঙ্গ বিভাজন
৪. নিয়ম ভাঙ্গা
প্রমিত করণ
বিশেষজ্ঞায়ন
সমতালবর্তীকরণ বা এককালবর্তীকরণ
একত্রীকরণ
সর্বোচ্চ পরিমানকরণ
কেন্দ্রীয়করণ
৫. ক্ষমতার কারিগর
সমন্বয়ক
সমন্বয়ের যন্ত্র
শক্তির পিরামিড
উঁচু অভিজাত
৬. গোপন নীল নক্সা
যন্ত্রবাতিক
প্রতিনিধি – ঝোলা
বৈশ্বিক আইন কারখানা
আশ্বাস দানের আনুষ্ঠানিকতা
৭. জাতীগত উন্মাদনা
রাজনৈতিক পালা বদল
সোনালী খুঁটা
৮. সাম্রাজ্যবাদী অভিযাত্রা
প্রকৃতির ওপর জোর-জবরদস্তি
মারজারিনের আবাদ
একতরফা সর্বগ্রাসী মার্কিনী সমন্বয়
সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ
৯. শিল্প-বাস্তবতা
প্রাগ্রসর নীতি
সময়ের সাংকেতিক তথ্যপুঞ্জ
স্থানের পূনপরিকল্পনা
বাস্ততার বাহাদুরি
১০. সমাপ্তিঃ আলোর বন্যা
তৃতীয় ভাগঃ তৃতীয় ঢেউ
১১. নতুন সংশ্লেষণ
১২. শীর্ষ নিয়ন্ত্রন
সৌরশক্তি ছাড়িয়ে
আগামী দিনের হাতিয়ার
মহাশূণ্যে কল-কারখানা
অতল গভীরে
জিন শিল্প
প্রযুক্তি বিদ্রোহীরা
১৩. গণমাধ্যমকে বহুমুখী বা বিকেন্দ্রীকরন
ভাবমূর্তির গুদাম
বহুমুখীপ্রবন গণমাধ্যম
টুকরো সংস্কৃতি
১৪. বুদ্ধিদীপ্ত পরিবেশ
বুদ্ধিমত্তার উন্নতি ঘটানো
সামাজিক স্মরণশক্তি
১৫. ব্যাপক উৎপাদন পেরিয়ে
ছোট পরিসরে কম সময়ে উৎপাদন
দ্রুতলয়ে উৎপাদন
সচিবের মৃত্যু
১৬. ইলেকট্রনিক কটেজ
ঘর বাড়িতে কাজ করণ
টেলিকমিউটারবৃন্দ
ঘরবাড়িকেন্দ্রিক সমাজ
১৭. ভবিষ্যতের পরিবার ছোট পরিবারের পক্ষে প্রচারাভিযান
ছোট পরিবারের বাইরে জীবনধারা
সন্তানমুক্ত সংস্কৃতি
উষ্ণ সম্পর্ক
ভালবাসা +
শিশু শ্রম-অভিযান
ইলেকট্রনিক যৌথ পরিবার
পিতামাতার অসদাচরন
আগামী দিনকে সহজ করা
১৮. কর্পোরেটের পরিচয় সংকট
মুদ্রার নাচানাচি
দ্রুত পরিবর্তনমুখী অর্থনীতি
বহুমুখী সমাজ
কর্পোরেসন পূন সংজ্ঞায়ন
চাপের পাঁচকোণ
বহুমুখী কর্পোরেসন
বহু বটমলাইন
১৯. নতুন নিয়মের সংকেত উদ্ঘাটন
নটা-পাঁচটার সমাপ্তি
বিনিদ্র দানবী গর্গন
বন্ধুর জন্য সময়
কম্পিউটার ও মারিজুয়ানা
প্রমিতকরনোত্তর মন-মানসিকতা
নয়া সমাজনীতি
বড়র-ভেতরে-ছোটই সুন্দর
ভবিষ্যতের সংগঠন
২০. উৎপাহারকারী বা প্রজুমারের উত্থান
অদৃশ্য অর্থনীতি
অতিভোজনকারী ও বিধবা
নিজের কাজ নিজে করা
বাইরের ও ভেতরের লোক
উৎপাহারকারী বা প্রোজুমারের জীবন ধারা
তৃতীয় ঢেউ অর্থনীতি
বিপণন প্রক্রিয়ার সমাপ্তি
২১. মানসিক ঘূর্ণাবর্ত
প্রকৃতির নতুন প্রতিচ্ছবি
বিবর্তনের বিন্যাস
প্রগতি বৃক্ষ
সময়ের ভবিষ্যত
মহাশূন্য ভ্রমনকারী
সমগ্রতাবাদ ও অর্ধবাদ
মহাজাগতিক খেলাঘর
উঁইপোকা থেকে শিক্ষা গ্রহন
২২. জাতীয় চেতনার মধ্যে ফাটল
বিশ্বজুড়ে বিচ্ছিন্নতাবাদের চালচিত্র
উপর থেকে নীচে
বৈশ্বিক সংস্থা
নবাগত ‘বহুজাতিক নেটওয়ার্ক’
গ্রহ সম্পর্কে সচেতনতা
রূপকথা ও উদ্ভাবনশক্তি
২৩. গান্ধীর সঙ্গে উপগ্রহ
দ্বিতীয় ঢেউ নীতি কৌশল
সফল মডেলে ভাঙ্গন
প্রথম ঢেউ নীতিকৌশল
তৃতীয় ঢেউ প্রশ্ন
সূর্য, বাগদা চিংড়ি এবং সরু চাকতি
আদি উৎপাহারকারী
সূচনা রেখা
২৪. সমাপ্তিঃ মহাসঙ্গম
আগামী দিনের বুনিয়াদ
প্র্যাকটোপিয়া ধারনা
ভুল প্রশ্ন
চতুর্থ ভাগঃ শেষ কথা
২৫. নতুন মনো-বলয়
নিঃসঙ্গতার ওপর আক্রমন
টেলিসমাজ
হেরোইন কাঠামো
পীর প্রথার রহস্য
জীবন সংগঠক এবং আধা-পীরপ্রথা
২৬. ভবিষ্যতের ব্যক্তিত্ব
অন্যরকম বেড়ে ওঠা
নতুন কর্মী
উৎপাহার নীতিপদ্ধতি
আমার আপেক্ষিক অবস্থান
২৭. রাজনৈতিক স্মৃতিসৌধ
কৃষ্ণ গহ্বর
প্রাইভেট বাহিনী
ত্রানকর্তা বিষয়ক চিত্তাচ্ছন্নতা বা মনোবিকৃতি
বিশ্ব জাল
পরস্পরবিজড়িত সমস্যা
সিদ্ধান্তের গতিময়তা
ঐকমত্যের পতন
সিদ্ধান্তের ধ্বসে পড়া
২৮. একুশ শতকের গণতন্ত্র
সংখ্যালঘুর ক্ষমতা
আধা-প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র
সিদ্ধান্ত বিভাগ
অভিজাতদের খুশীর খবর
সম্ভাবনাময় মহাসংগ্রাম
ভাগ্য সৃজন করতে হবে
আগামী পর্বেঃ প্রথম ভাগঃ ঢেউয়ে ঢেউয়ে সংঘর্ষ (A Collision of Wave) ১. মহাসংগ্রাম (Super Struggle)