আদি বাংলার ইতিহাস।
(প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে ১২০৫ খ্রিষ্টাব্দ) পর্ব ৪৮
রাষ্ট্রের উদ্ভবঃ
ক্ল্যান বা গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজব্যবস্থা শিথিল হওয়ার পর পরিবার গঠন, কৃষি সমাজে জমি নিয়ে সংঘাত, উর্বর জমির দখল নিয়ে বিবাদ, জমির মালিকানা নিয়ে বিবাদ এবং এগুলোর মীমাংসার জন্য কিছু সামাজিক নিয়ম-কানুনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এছাড়া বাণিজ্যিক কারণেও আইন-কানুনের প্রয়োজন হয়। উদ্বৃত্ত জিনিস ও পণ্য ক্রয়-বিক্রয়, বিনিময় ব্যবস্থা ইত্যাদি ক্ষেত্রেও কিছু আইনের প্রয়োজন হয়। যুদ্ধের কারণে প্রাচীনকালে বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। যাযাবর পশুপালক সমাজ বিভিন্ন কৃষি গ্রামের সমৃদ্ধ অবস্থা দেখে আকৃষ্ট হয়ে গ্রাম আক্রমণ করতে শুরু করে এবং সুযোগ পেলেই গ্রামের সম্পদ লুট করতে চেষ্টা করে। নবোপলীয় যুগে ঘন ঘন যুদ্ধ বহিঃশত্র“র কাছ থেকে আত্মরক্ষার জন্য দলপতি নিযুক্ত করেছে। দলপতিদের হাতে অস্ত্র ও গ্রাম রক্ষার ভার থাকায় ক্রমেই তারা শক্তিশালী হয়ে উঠে। সমাজে তারা কর্তৃত্ব ও প্রাধান্য বিস্তার করে এবং তার বংশধররাও যাতে দলপতি হয় সে ব্যবস্থা করে যায়। এভাবেই বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের উদ্ভব।১১১
সমাজবিজ্ঞানী মাহমুদা ইসলামের অভিমত হচ্ছে, “ধর্ম ধন বৈষম্যকে ঐশ্বরিক বিধান বলে প্রচার করল এবং রাজাকে ঈশ্বরের অবতার, ঈশ্বরের বংশধর, এমনকি স্বয়ং ঈশ্বর বলে ঘোষণা করে রাজশক্তির বিরুদ্ধে সম্ভাব্য প্রতিবাদ স্তব্ধ করে দিল।” এভাবে সমাজে রাজশক্তি, অভিজাত শ্রেণী ও ধর্মগুরু এই তিন শ্রেণীর আঁতাত ও কর্তৃত্ব সভ্যতার উদ্ভব ঘটায়। এভাবেই গড়ে উঠে গোষ্ঠীবদ্ধ সামাজিক প্রশাসন এবং পরবর্তীকালে রাজতন্ত্র।
শ্রেণীভেদ প্রথার সূত্রপাতঃ
কৃষি ও পশুপালনের ফলে প্রচুর খাদ্য উদ্বৃত্ত থাকত, তেমনি সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্যও মানুষের প্রয়োজন হতো। গর্ডন চাইল্ড এ সম্পর্কে বলেন, “পরাজিত শত্র“কে আগের মত খাদ্যের জন্য মেরে ফেলার চেয়ে কাজে লাগানো অনেক লাভজনক দেখে বিজিতদের বাঁচিয়ে রাখে। বিনিময়ে বিভিনড়ব কাজ তাদের করে দিতে বাধ্য করা হয়।” তাদের উৎপাদিত ফসল ও অন্যান্য জিনিস বিজেতাগণ ভোগ করা শুরু করে। পরাজিতরা শারীরিক নির্যাতন বা মৃত্যুদণ্ডের ভয়ে তার শ্রমের ভাগ দিতে বাধ্য হয়। যারা হয় জয়ী, তারা প্রভু, আর বিজিতরা দাস বা ভৃত্য, এভাবে শ্রেণীবৈষম্যের সূত্রপাত ঘটে; এছাড়া স্বাধীন কৃষকের উদ্বৃত্ত উৎপাদনে ভাগ বসাতে উৎপাদন থেকে বিচ্ছিনড়ব রাজশক্তি, বিত্তবান অভিজাত শ্রেণী ও ধর্মগুরুরা এগিয়ে আসে। ক্রমে কৃষকরা ফসল ফলানোর বিনিময়ে গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য প্রয়োজনীয় ন্যূনতম রসদ পায়,
আর উৎপাদিত ফসলের সিংহভাগ ভূমিকর, ধর্মকর, নিরাপত্তাকরের নামে উলিখিত সম্প্রদায় ভোগ করে। এ ত্রিশক্তির শোষণের ফলে এদেশে সৃষ্টি হয়েছে দাস, অচ্ছুত ও শূদ্র শ্রেণীর।১১২
স্বয়ংসম্পূর্ণ অথর্নীতিঃ
গর্ডন চাইল্ড নবোপলীয় অর্থনীতিকে পুরোপুরি স্বয়ংসম্পূর্ণ বলে উলেখ করেছেন। নবোপলীয় যুগে বাংলার একেকটি গ্রাম ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ পৃক ইউনিটের মতো। নিজেদের প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর জন্য অন্যের উপর নির্ভর করার কোনো উপায় ছিল না। নিজেদের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি নিজেরাই উৎপাদন করত। এ কারণে সামর্থ্য অনুযায়ী নারীপুরুষ নির্বিশেষে গ্রামের সক্ষম মানুষের মধ্যে কাজ ভাগ করে দেয়া হতো। সন্তান লালন-পালন ও শস্য উৎপাদন ছাড়াও কাপড় বোনা, মাটির পাত্র তৈরি, গৃহস্থালি দ্রব্যসামগ্রী তৈরির কাজে নারীরা নিয়োজিত ছিল। পুরুষরা গৃহনির্মাণ, শিকার, পশুপালন ও অস্ত্র তৈরির মতো কঠিন শ্রমের কাজ করত। প্রথম প্রথম যখন গ্রামের লোকসংখ্যা বেড়ে যেত, তারা নতুন গ্রাম স্থাপন করে সে সমস্যার সমাধান করত। এ সমাধান ছিল অর্থনীতির গণ্ডির মধ্যেই। লৌহযুগেও এদেশবাসীরা গ্রাম্য জীবনযাত্রাতেই অভ্যস্ত ছিল। গ্রামীণ অর্থনীতিতে অবশ্য ব্যাপক পরিবর্তন আসে ব্রোঞ্জ, তাম্র ও লৌহযুগে। বিশেষ করে লোহার ব্যবহার অর্থনীতিকে অত্যন্ত বেগবান করে তোলে।
বিনিময় প্রথা চালুঃ
গ্রামগুলো স্বনির্ভর হলেও কিছু কিছু প্রয়োজনীয় উপকরণ এবং কোনো কোনো জিনিসের জন্য বাইরের উপর নির্ভরশীল ছিল। তাদের মধ্যে উদ্বৃত্ত দ্রব্যের বিনিময় হতো। এভাবে গড়ে উঠে ব্যবসা-বাণিজ্য, আদান-প্রদান ও বিনিময় প্রথা যারা হাতিয়ার ও নানান সখের জিনিস গ্রামবাসীদের কাছে বিক্রি করত তারা বিনিময়ে খাদ্যশস্য, মাংস, পশু ইত্যাদি নিয়ে যেত। বিষয়টা ছিল এমন- কৃষকের হাতে ছিল উদ্বৃত্ত ফসল, পশুপালকরা দিতে পারত মাংস, দুধ, তাঁতি দিতে পারত কাপড়, কুমার দিতে পারত হাড়ি, কাঠুরে দিতে পারত কাঠ, ফল, আর জেলে দিতে পারত মাছ। এভাবে নিজেদের গ্রামে এবং গ্রামের বাইরে বিনিময় প্রথা গড়ে উঠে। এ বিনিময় প্র ার ফলে বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের মধ্যে কারিগরি জ্ঞান, ভাবনাচিন্তার আদান-প্রদান, চাষাবাদের জন্য সুবিধাজনক জায়গা দেখে আবাসন গড়ে তুলত।বিনিময় প্রথা জীবনধারণের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। বিভিন্ন পরিবারের মধ্যে যেমন-প্রয়োজনীয় জিনিসের বিনিময় হতো তেমনি মুনাফা অর্জনের জন্য নিকটবর্তী বা দূরবর্তী মানুষের মধ্যেও বিনিময় হতো। এই বিনিমিয়ের মাধ্যমেই কতগুলি হাট বা গঞ্জ, বাজার বা মেলা গড়ে উঠেছিল।১১৩
ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও উত্তরাধিকার প্রথা চালু নবোপলীয় কৃষিকাজ ও পশুপালন সমগ্র সমাজচিত্র পাল্টে দিয়েছিল। জমি, পশু, শস্য, ঘরবাড়িসহ প্রয়োজনীয় সম্পদের আবির্ভাব হয় এবং এগুলো বণ্টন নিয়েও সমস্যা দেখা দেয়। প্র মদিকে জমি গোষ্ঠীর সাধারণ সম্পত্তি বলে বিবেচিত হলেও সম্পত্তি বেড়ে গেলে সম্পদ বণ্টন ক্ষেত্রে বক্তিমালিকানা স্বীকৃতি পায়। প্রকৃতপক্ষে কৃষির প্রয়োজন, উদ্বৃত্ত ফসলের বিনিময় ও ব্যবসায়িক লেনদেনের ফলে ব্যক্তিমালিকানার উদ্ভব হয়। এর ফলে একটি অঞ্চল গোষ্ঠীর সম্পত্তি হিসেবে তার মধ্যে কিছুটা সরকার পরিচালনার জন্য ও কিছুটা ধর্মীয় অনুষ্ঠানের জন্য সংরক্ষিত রেখে বেশিরভাগ জমি বিভিনড়ব পরিবারের মধ্যে বণ্টন করে দেয়া হয়। এর ফলেই সম্পত্তি ও নিজের উৎপনড়ব জিনিসের ওপর দাবি প্রতিষ্ঠা শুরু হয়। গড়ে উঠে সম্পত্তিতে ব্যক্তিগত মালিকানা। পরিবার ও বিবাহ প্র া চালু হওয়ায় এ সম্পত্তিতে বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকার প্রথা চালু হয়। ভূমির ওপর যে মালিকানা সৃষ্টি হয়, সে মালিকানা মালিকের মৃত্যুতে শেষ হয়নি। মালিকানা বংশপরস্পরায় পুত্র পৌত্রাদি ক্রমে ভোগ দখলের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।১১৪
নৌযান ও পালের ব্যবহারঃ
নবোপলীয় যুগে স্থলপথে মাল টানার কাজে মানুষ যেমন পশুশক্তিকে ব্যবহার করেছিল তেমনি জলপথেও মাল ও মানুষের পরিবহনের জন্য প্রাকৃতিক শক্তিকে সে কাজে লাগায়। বাতাসের গতি-প্রকৃতি ভালভাবে বুঝে নিয়ে সে অনুসারে নৌকাতে পাল লাগিয়ে নদী বা সমুদ্রপথে যাতায়াতের ব্যাপারটি মানুষ খুব দ্রুত শিখে নেয়। নৌকায় পাল লাগানোর কৌশল নব্যপ্রস্তরযুগের আবিষ্কার। বিনিময় প্র া চালু হলে নৌপথ আরো বহুল ব্যবহৃত হয়। আদিকাল থেকে বাংলাদেশ আশেপাশের অঞ্চলের সঙ্গে নদী ও সমুদ্র পথে মাল আনা নেয়া করত। এভাবেই একদিন গড়ে উঠে গণ্ডারিক, চাটিগাঁও,তাম্রলিপ্ত প্রভৃতি সমুদ্রবন্দর। খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০ সালেও সুদূর ক্রীটদ্বীপের সঙ্গে বাংলার নৌপথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল, এ কথা পাণ্ডু রাজার ঢিবি উৎখননের ফলে জানা যায়।১১৫ ভাষা ও সাহিত্যের প্রচলন প্রস্তরযুগে ভাষার বিকাশ ঘটে। বিনিময় প্রথা চালু হলে ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীর কাছ থেকে সম্ভবত নবোপলীয় গ্রামবাসী দূর অঞ্চলের খবর পেত। এছাড়া কৃষিজমির সন্ধানে পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়ায় ভাবের আদান-প্রদান ঘটে। এভাবে ভাষার উদ্ভব হয়। যদিও লিখন পদ্ধতি তখনও আবিষ্কৃত হয়নি। ফলে একজনের বা একপুরুষের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অন্য মানুষ বা পরের পুরুষের মানুষের কাছে চলে আসত মুখের ভাষার মাধ্যমে। সহজে মনে করে রাখার উপযোগী ঝংকার ও ছন্দবহুল গাথা, বচন ও গীতের মাধ্যমে লব্ধ অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান বংশপরম্পরায় পরিচালিত হতো। এগুলোর বিষয়বস্তু ছিল জমির উৎকর্ষ, বীজের প্রকৃতি, বয়নের সময়, আগাছা নির্ধারণের উপায়, বৃষ্টি আবির্ভাবের লক্ষণ, চাষ পদ্ধতি, বৃষ্টির সময়, মাটির পাত্র তৈরির পদ্ধতি ইত্যাদি।১১৬ খনার বচন বা এ জাতীয় বাক্য এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এভাবে তখন মুখে মুখে শিক্ষামূলক মৌখিক সাহিত্যের প্রচলন হয়। মনের ভাব প্রকাশের জন্য কথা বা ভাষা এবং জীবিকার প্রয়োজনে সাহিত্যের উদ্ভব হয়। এদেশের অনেক আদিবাসীর এখনও লিখিত বর্ণমালা নেই।
১১১ C.L. Brace: The Stages of Human Evolution
১১২ রামশরন শর্মা- প্রাচীন ভারতে শূদ্র।
১১৩ G. Pollet: India and the Ancient World History, Trade and Culture.
১১৪ C.O. Sauer: Agricultural Origins and Dispersals.
১১৫ M. Abdul Mu’min Chowdhury: Buddhism in Soiuth Asia.
১১৬. R. Gombrick: Theravada Buddhism.
আগামী পর্বেঃ ভয়ের উপাদান, নবোপলীয় মানুষের প্রাক-যৌক্তিক মন, কুসংস্কার ও যাদুবিদ্যা, ধর্মযাজক শ্রেণীর সৃষ্টি।
আদি বাংলার ইতিহাস (প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে ১২০৫ খ্রিষ্টাব্দ) পর্ব ৪৭