লস্ট ইন প্যারাডাইস-০১ - মাহমুদ শাফায়েত জামিল
লস্ট ইন প্যারাডাইস-০২ - মাহমুদ শাফায়েত জামিল
লস্ট ইন প্যারাডাইস-০৩ - মাহমুদ শাফায়েত জামিল
লস্ট ইন প্যারাডাইস-০৫- মাহমুদ শাফায়েত জামিল
*পরিবেশ বান্ধব ভ্রমণ করুন !
*পলিথিন জাতীয় জিনিস ফেলবেন না কোথাও ।
*পানি নোংরা করবেন না ।
*রাতে পাহাড়ে অপ্রযোজনীয় শব্দ করবেন না ।
*রাতে দ্রুত ঘুমানোর চেষ্টা করবেন ।
আমাদের রুটটি ছিল --- ভ্রমণের সময়কাল {১৪ই ফেব্রুয়ারী-২১ই ফেব্রুয়ারী ২০১১}
১৫ই ফেব্রুয়ারী- দিন-১- ঢাকা - বান্দরবান - রুমা - বগালেক (জীপ ও পায়ে হেঁটে দুই ভাবেই বগালেক যাওয়া যায়)
১৬ই ফেব্রুয়ারী-দিন-২- বগালেক-দার্জিলিংপাড়া - কেওক্রাডং-পাসিংপাড়া-জাদিপাইপাড়ার পাস দিয়ে -ক্যাপিটাল পিক - বাকলাই
১৭ই ফেব্রুয়ারী- দিন-৩- বাকলাই - সিমত্লাপিপাড়া - থানদুইপাড়া - নয়াচরণপাড়া
১৮ই ফেব্রুয়ারী- দিন-৪- নয়াচরণপাড়া - হাঞ্জরাইপাড়া - নেপিউপাড়া - ত্লাংমং/সাকা হাফং - সাজাইপাড়া
১৯ই ফেব্রুয়ারী- দিন-৫- সাজাইপাড়া - সাতভাইখুম (ঝর্না) - আমিয়াখুম - নাইক্ষামুখ - সাজাইপাড়া
২০ই ফেব্রুয়ারী- দিন-৬- সাজাইপাড়া - জিন্নাহপাড়া - নাফাখুম - রেমাক্রি
২১ই ফেব্রুয়ারী- দিন-৭- রেমাক্রি - বারপাথর (বড়পাথর) - টিন্ডু - থানচি - বান্দরবান - ঢাকা ।
আজ ১৮ই ফেব্রুয়ারী, সকালে শিক্ষক সাহেবের কাছ থেকে জানা গেল সাকা হাফং এর সবচেয়ে কাছের পাড়া নেপিউ। এবার যাচাই করার পালা আবু বকর ফেরার যে রুট ঠিক করেছিল সেটা ঠিক কিনা। আবু বকরের ধারনা মতে নেপিউ পাড়ার কাছাকাছি কিছুটা নিচের দিকে আরেকটা পাড়া আছে যেটা থেকে রেমাক্রি খাল ধরে নাফাকুম হয়ে রেমাক্রি বাজারে যাওয়া যায়। শিক্ষক সাহেব জানালেন যে এই ধারনা সঠিক। ওই পাড়ার নাম সাজাই পাড়া। সাকা হাফং, নেপিউ পাড়া আর সাজাই পাড়া একটা ত্রিভুজের সৃষ্টি করেছে। এবার গাইডের খোঁজ করলাম যে আমাদের নয়াচরন থেকে সাকা হাফং হয়ে সাজাই পাড়া পর্যন্ত পৌঁছে দেবে। একজন যেতে রাজি হলো কিন্তু পারিশ্রমিক যা চাইল তা আমাদের সাধ্যের বাইরে। তাই শিক্ষক সাহেবের কাছ থেকে নেপিউ পাড়া পর্যন্ত রাস্তার বিবরন ভালো ভাবে জেনে নিয়ে নিজেরাই চলা শুরু করলাম।
১.
আমাদের গাইড । নেফিউ পাড়া থেকে নিয়েছিলাম । সার্ভিস ভাল ছিল না । মিজান ছবি তুলছে মায়ানমার এর পাহাড়ের ।
পাড়া থেকে বেরিয়ে কিছু দূর আসার পর নিচে নেমে রেমাক্রি খালে এসে মিশেছে পথ। খালের পাশে বসে বিস্কুট, পানি দিয়ে সকালের নাস্তা সারলাম। খালের পাশেই দুলাচরন পাড়া। পাড়া পার হয়ে খালের পাড় ধরে এগিয়ে গেলাম। কিছু দূর যাবার পর বাম পাশ দিয়ে পথ উঠে গেছে পাহাড়ের উপরে। পথের মাটি এতই আলগা যে পা দিলেই পিছলে যাচ্ছে।
২.
মায়ানমার এর পাহাড় ।
উপরে উঠছি আমরা; আরও উপরে। এবার কিছুটা নেমে একটা ঝিরি পার হলাম। ঝিরি পার হয়ে ঢুকে পড়লাম বনের মধ্যে। পায়ে চলা পথ ধরে এগিয়ে চললাম। পাতার ফাঁক দিয়ে অসংখ্য রোদের টুকরো এসে ঝিলমিল করছে বনভূমিতে পড়ে। উঁচু, মোটা গাছ; বনটা যেন অত্যন্ত নিবিড়। অনেক চালতার গাছ চোখে পড়ল। চালতা পেকে, মাটিতে পড়ে পচে আছে। আরও এক বার ঝিরি পার হলাম। পুরোটা পথেই ডান পাশে সঙ্গী হিসাবে পেলাম রেমাক্রি খালকে; তবে অনেক নিচে দিয়ে বয়ে চলেছে। হাটঁছি শান্ত, নিরিবিলি বনপথ ধরে। মাঝে বিশ্রাম নিলাম বার দু’য়েক। একটা ঝর্ণা পার হলাম। পথটা এখানে বাঁক নিয়েই প্রায় উলম্ব ভাবে উঠে গেছে। আর ট্র্যাকের কথা কি বলব, ঝুর ঝুরে আলগা মাটি। ধুলায় নিশ্বাস নেয়া কঠিন। ব্যাগের ওজন কাঁধের উপর চেপে বসেছে। সাথে আছে বিশ্বস্ত বন্ধুর মত শরীর পুড়িয়ে দেয়া রোদ। একটানা শ’খানেক ফুট উঠার পর সমতল জায়গায় পৌঁছালাম। নেপিউ পাড়ার (ত্রিপুরা পাড়া) দেখা পেলাম। দূরে, নিচে দেখা যাচ্ছে নয়াচরন পাড়া। নেপিউ পাড়া পেরিয়ে চোখ চলে গেল পাড়ার পিছনের পাহাড়ের দিকে। ওটায় সাকা হাফং।
৩.
এই রকম পথ দিয়ে যেতে হয় ।
কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে পাড়াতে গিয়ে ঢুকলাম। কারবারীর সাথে দেখা করে একজন গাইড জোগাড় করে দিতে বললাম যে আমাদের সাকা হাফং ঘুরিয়ে এনে সাজাই পাড়া পর্যন্ত নিয়ে যাবে। কারবারী তার ভাইকে গাইড হিসাবে ঠিক করে দিল। সিয়ামকে রেখে গেলাম দুপুরের খাবার রান্না করার জন্য। মালপত্র সব রেখে গেলাম পাড়াতে। সাথে নিলাম পানি আর কিছু শুকনা খাবার।
৪.
আমাদের দলে সবার নাম আর ফোন নাম্বার ।
দ্রুত এগিয়ে চললাম সবাই। মানুষের ছোঁয়া লাগা হালকা বনের ভেতর দিয়ে হাঁটছি। ডান পাশে খাদের অবস্থা দেখে মনে হলো বর্ষায় এখান দিয়ে প্রবল প্রতাপ নিয়ে ঝর্ণা বয়ে চলে। এক জায়গায় ভূমি ধ্বস হওয়ায় ট্র্যাক কিছুটা বিপদজনক। মিজান আর কোরেশী ওখানেই দেখা পেলো এক বানরের। মুখের বাইরের পাশ সাদা, এছাড়া সারা শরীর কালো রঙের। ঝোপের ভিতর দিয়ে তৈরী করা পথ দিয়ে এগিয়ে চলেছি। এরপর আবার বনের ভিতরে ঢুকলাম। কিছু দূর এগোনোর পর পথ নিচে নেমে আবার উপরে উঠল, দেখা মিললো ঘন বাঁশ ঝাড়ের। অভিযাত্রীদের চলাচলের ফলে ঘন বাঁশ ঝাড়ের ভেতর দিয়ে পথ সৃষ্টি হয়েছে। এগিয়ে চলার গতি কমে গেলেও রূদ্ধ হলো না। সাবধানে চলতে হয় এখানে; তা না হলে শরীর কেটে যেতে পারে। এভাবে চলতে চলতে চূড়ায় পৌঁছে গেলাম সবাই। তখন প্রায় দুপুর ১২.৪৫ বাজে। আমরা দাঁড়ালাম বাংলাদেশের উচ্চতম স্থানে; যার উচ্চতা ৩৪৮৬ ফুট। সত্যি হলো শরীফের স্বপ্ন। আর মৌরী অসাধারন এক মাইলফলক স্থাপন করলেন। বাংলাদেশের প্রথম ও একমাত্র নারী হিসাবে তিনি সাকা হাফং, কেওক্রাডং, তাজিংডং, শিপ্পি সামিট করলেন। সামিটকারীদের নাম আর সময় একটা কাগজে লিখে প্লাসটিকের বোতলে ভরলাম। মোহনের কাছে থাকা বাংলা ট্র্যাক, ট্রাভেলার্স অফ বাংলাদেশের কাগজটাও রেখে দিলাম বোতলের ভেতর। সবাই মিলে ছবি তুললাম। যেদিক দিয়ে আমরা উঠেছি তার অন্য পাশে মায়ানমার। ছবি তোলা হয়ে গেলে নিচে নামতে শুরু করলাম।
৫.
কঠিন পথ । পাহাড়ের মাটির ভেঙ্গে পড়ছে অনবরত ।
পাড়াতে পৌঁছে দেখলাম সিয়াম রান্না শেষ করে ঘুমাচ্ছে। ওকে ডেকে তুলে চটপট খাওয়া সারলাম। পেট পুরে খেয়ে মনে হলো একটু ভাত ঘুম দেই। কিন্তু তার কি আর উপায় আছে; যেতে হবে সাজাই পাড়া। সবকিছু গুছিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত আমরা। এ সময় গাইড বলে যে সে আর যাবে না। অনুরোধ করেও লাভ হচ্ছে না। কারবারীকে বললাম সমস্যা সমাধানের জন্য। সে জানালো আগে যে টাকা ঠিক হয়েছিলো তার চাইতে কিছু বেশী দিতে হবে। অনোন্যপায় হয়ে ওর কথাতেই রাজি হলাম। গাইড রাজি হলো সাজাই পাড়া পর্যন্ত যাওয়ার জন্য। খাওয়ার পর বেশ কিছুক্ষণ পথ চলতে কষ্ট হচ্ছিল। ধীরে ধীরে গতি বাড়ল। সূর্য তাপ বিতরনে কোন কৃপণতা দেখাল না; পথে ধুলা আর ধুলা। ঘন্টা খানেক চলার পর গাইড বলে যে সে আর যাবে না। কারবারী নাকি তাকে এটুক পর্যন্ত আসার জন্য বলেছে। আমরা যতই বলি যে কথা ছিল সাজাই পাড়া পর্যন্ত সে যাবে, সে কিছুতেই শুনবেনা। তার একই কথা টাকা দেও, আর যাবো না। অনুরোধ কোন কাজেই এলো না। ডান দিক দিয়ে নেমে যাওয়া একটা পথ দেখিয়ে বললো যে এদিক দিয়ে নেমে গেলেই সাজাই পাড়া পৌঁছে যাবো। কিন্তু সে আর যাবে না। কারবারী আর ওর ভাই কথা দিয়ে কথা রাখলো না। মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। পাওনা টাকা মিটিয়ে দিয়ে ওর দেখানো পথ দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম।
৬.
গহিন জঙ্গল থেকে উচুঁ পাহাড়ের পথে
ঘন বাঁশ ঝাড়ের ভেতর দিয়ে চলেছি সবাই। নামছি, নামছি আর নামছি। মিজান বললেন যে এটা মনে হয় পাতালে নামার রাস্তা। কথাটা সত্যি বলে মনে হলো বাকিদের। কারণ নামার যেন শেষ নেই। অবশেষে নেমে এলাম ঝিরিতে। ঝিরি পার হয়ে অন্য পারে গেলাম। কিন্তু পাড়ার দেখা নেই। অল্প পানি ঝিরিতে, নেই বললেই চলে। ঝিরি ধরে এগিয়ে গেলাম। বিকাল হয়ে গেছে; আলো কমে আসছে। দু’পাশের উঁচু পাহাড়ের মাঝে বয়ে চলা শান্ত ঝিরিতে অন্ধকার আগেই নেমে আসে। পাথরগুলোকে দেখে মনে হচ্ছিল প্রাগৈতিহাসিক যুগের। বর্ষাতে শান্ত এই ঝিরি বিক্ষুব্ধ, বিদ্রোহী রূপ ধারন করে। এগিয়ে চলেছি; হঠাৎ একটা আওয়াজ কানে এলো। মনা বললেন কাছেই পাড়া আছে। কারণ শব্দটা হচ্ছে ডিজেল ইঞ্জিন দিয়ে চালানো ধান ভাঙানোর যন্ত্র থেকে। পড়ন্ত বিকাল; আর কিছু দূর এগোনোর পর মুরগীর ডাক কানে এলো। তারপর চোখে পড়ল পাড়াটা। পাড়ার একজনের সাথে কথা বলে জানলাম এটাই সাজাই পাড়া (খিয়াং পাড়া)। পাড়ার আদি নাম মাঠভারা পাড়া হলেও এখন সবাই সাজাই পাড়া নামেই চেনে।
৭.
জুমের রাস্তা
পাড়াটা খুব সুন্দর। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, মাত্র নয়টা পরিবার বাস করে। সবাই ভালো বাংলা জানে। মাঝখানে ফুটবল খেলার একটা মাঠ; ঘরগুলো মাঠের চারপাশে। চারদিক পাহাড় দিয়ে ঘেরা। ঝিরিটা পূর্ব দিক থেকে দক্ষিণ দিক হয়ে পাড়ার গা ঘেষে বয়ে চলেছে। পশ্চিমে আছে জ্যোতি পাড়া (ত্রিপুরা পাড়া) আর দক্ষিণ-পূর্ব দিকে মংখাই পাড়া (খিয়াং পাড়া)।
৮.
সাকাহাফং চূড়াঁর ভ্রমণ বাংলাদেশ দল
কারবারী ছিলনা আর তার ঘরটাও ছোট। রাতে থাকার ব্যবস্থা হলো অংফউ খিয়াং এর বাড়িতে। পেশায় শিক্ষক। সবাই ঝিরিতে গিয়ে গোসল করলাম। রাতে খাবার জন্য মুরগীর ব্যবস্থা করা হলো। মনা লেগে গেলেন রান্নার কাজে। রাতের মেনু ভাত, ডাল, মুরগীর মাংস। সেদিন ছিল পূর্ণিমা। ভাত খাবার আগে তাই খেলার মাঠে বসে চাঁদের আলো খেয়ে নিলাম। শুধু মনে হচ্ছিল এমন চাঁদের আলো মরি যদি সেও ভালো সে মরন স্বর্গের সমান।
৯.
পাথরে বেসেছে বাসা ।
খাবার পর অংফউ খিয়াং এর সাথে কথা বললাম নাফাকুম হয়ে কিভাবে রেমাক্রি যাব সে ব্যাপারে। সত্যি বলতে কি অংফউ সাহেব তথ্যের ভান্ডার। আমাদের জানালেন সাজাই পাড়া থেকে রেমাক্রি খাল ধরে নাফাকুম হয়ে রেমাক্রি বাজার দুপুরের মধ্যেই যাওয়া যায়। তবে পাড়া থেকে সকালে গেলে বিকালে ফিরে আসা যাবে এরকম দূরত্বে আরো একটা কুম আছে দেখার মত যা নাফাকুমের চেয়ে সুন্দর। আমাদের হাতে অতিরিক্ত একটা দিন আছে; সুতরাং রাজি হয়ে গেলাম সেই কুম দেখার জন্য। খিয়াংরা ওই কুমের নাম দিয়েছে ঙাখ্যোওয়া কুম। আর ত্রিপুরারা বলে ওমিয়াকুম। গাইডের কথা বলতেই অংফউ জানালেন যে আমরা তার অতিথি তাই তিনি নিজেই আমাদের সাথে যাবেন।
১০.
গহিন সবুজ বন
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ৮:৪৬