পরপর তিনটি চাকুরী ছেড়ে দেয়ার পর যখন বুঝতে পারলাম আমার মত অলস আর স্বাস্হ্যমন্ত্রীর দ্বারা কিছুতেই নয়টা পাঁচটা অফিসে শ্রম দেয়া সম্ভব না তখন সিদ্ধান্ত নিলাম জব করলে স্কুলেই করব। এতে একদিকে যেমন নিজের জন্য কিছু সময় পাওয়া যাবে অন্যদিকে বাচ্চাদের সাথে সময় কাটানোটা বেশ উপভোগ করা যাবে। আর জবটা যদি কোন ইংলিশ মিডিয়ামে হয় তাহলে রবীন্দ্রনাথের প্রেমিকা হওয়া সত্ত্বেও শেকসপিয়রের সাথে ঘর করার অভিঞ্গতাটুকু অন্তত কিছুটা হলেও কাজে লাগানো যাবে।
অবশেষে কয়েকটি স্কুলে ইন্টারভিও দিয়ে বিশেষ একটি বাহিনী নিয়ন্ত্রিত একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে জব হল। প্রথম দিন গেলাম স্কুলে। আমার ছোটখাট আকৃতির জন্যই কিনা জানিনা আমাকে প্রথম দিনেই ঢুকিয়ে দেয়া হল প্লে গ্রুপ ক্লাসে। ক্লাসে ঢুকেই আমি প্রমাদ গুনলাম। হায় হায় এ কার মধ্যে এসে পড়লাম আমি। আমার চারপাশে যে ছোট্ট বাচাগুলোকে দেখছিলাম তারা সবাই তাদের মায়েদের হাত শক্ত করে চেপে বসে আছে। এদের সবার বয়স ৩ থেকে ৪ এর মধ্যে। আমরা ক্লাসে ঢুকার সাথে সাথে প্রিন্সিপাল ম্যাম কে দেখা মাত্রই( আমাকে দেখে না কিন্তু) সবাই একযোগে চিৎকার শুরু করে দিল। ক্লাস শুরু হবে কাজেই মায়েদের বেড়িয়ে যাওয়ার অনুরোধ করার সঙ্গে সঙ্গে আরেক দফা চিৎকার। আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। প্রিন্সিপাল ম্যাম আমাকে অভয় দিয়ে বললেন ব্যাপার না প্রথম প্রথম এমন হবে ,পরে সব ঠিক হয়ে যাবে। শুনলাম আজ বাচ্চাগুলোর জীবনের প্রথম স্কুল। কারণ সেদিন থেকেই ওই বছরের নতুন সেশন এর ক্লাস শুরু। কি অদ্ভুত অবস্হা! বাচ্চাদেরও জীবনে প্রথম, টিচারের জীবনে প্রথম। কিন্তু দূর্গতি যে আরও অপেক্ষা করছে বুঝিনি তখনো। যাই হোক অভিভাবকরা এক এক করে চলে যেতেই একযোগে সমবেত কোরাস শুরু হল। কেউ কেউ তো মায়ের পিছন পিছন ভোঁ দৌড়। তাদের পেছন পেছন আমি। ছোটবেলার দৌড়াদৌড়ির অভিঞ্গতা যে এভাবে কাজে লাগবে বুঝিনি। কোথায় পরে রইল শেকসপিয়র।
যাই হোক ভাবলাম খেলনা দিয়ে শান্ত করানো যায় কি না। সবাই কে টেবিলে বসিয়ে প্রত্যেক কে কিছু করে খেলনা দিলাম। চোখ ভর্তি টলমলে পানি নিয়ে সবাই খেলনায় মনসংযোগ করল। আমিও কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেল্লাম। কিন্তু কিছুক্ষন যেতে না যেতেই শুনি চিৎকার-"মিছ্ আমাল থেলনা দেয়না, আমাকে মালে"। তাকিয়ে দেখি ক্লাসের মধ্যেকার সবচেয়ে স্বাস্হ্যবান একটি ইয়া নাদুস নুদুস সাইজের একটি বাচ্চা আরেকটি বাচ্চার কাছ থেকে সব খেলনা কেড়ে নিচ্ছে। ও দিতে রাজি না হওয়ায় ওর পিঠে দুমাদুম.......। আমি ওই দৃশ্য দেখে দৌড়ে গেলাম ওদের কাছে। অনেক কষ্টে মোটুটার হাত থেকে নিরীহ প্রাণীটিকে ছাড়িয়ে নিলাম। ওর খেলনা ওকে ফেরত দিয়ে মোটুর দিকে ফিরে ওকে কাছে নিয়ে বললাম," ছি ফ্রেন্ড কে কি মারতে হয়? সবাই মিলেমিশে খেলতে হয়......"। আমার কথা শেষও হয়নি হঠাৎ আমার চোখের সামনে হাজারটা হলুদ তারা জ্বলে উঠল, সেই সাথে গলাফাটা চিৎকার....আমারই কন্ঠ দিয়ে। আমার নসিহত পছন্দ না হওয়ায় মোটু বাবাজি তার সর্বশক্তি দিয়ে দশাসই এক পাঞ্চ মেরে দিয়েছে আমার নাক বরাবর। আমি ছোটখাট মানুষ ওই পাঞ্চ সহ্য করতে পারব কিভাবে? নাক চেপে বসে পরেছি মেঝেয়। আর একবার প্রমাণ পেলাম ডারঊইনের তত্ত্ব আসলেই ঠিক। মানুষ আসলে পূর্বে নয় এখোনো বানর রয়েই গেছে। নইলে এগুলো কি?
এই ছিল আমার প্রথম দিন ক্ষুদে দস্যূদের মাঝে। সেই থেকে শুরু। প্রথম দিনের ওই অভিঞ্গতার পর ভাবিনি টিকতে পারব কিন্তু কিভাবে যেন টিকে গেলাম। অল্পদিনেই ভাব হয়ে গেল বিচ্ছুগুলোর সাথে। ওরাও আমার ভক্ত হয়ে গেল। জবটাকে উপভোগ করতে শুরু করলাম। প্রতিদিন কত যে মজার কাহিনী হয় ওদের নিয়ে তা বলে শেষ করা যাবেনা। ধীরে ধীরে অন্যগুলোও শেয়ার করব। আসলে ওদের কারনেই এখন জীবনটা অনেক বৈচিত্র্যপূর্ণ মনে হয়।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুলাই, ২০০৯ রাত ১২:০২