
রূপকথার গাছের তলে বসে হরিৎ জোছনায় ভিজছি যখন
সরসিজ আলীম
দত্তবাড়ি আর ঠাকুরবাড়ির অভিজাত পাড়া পেরুনোর ঘুপচিতে কাজীবাড়ির বাঙালি মসলমানদের মোল্লার দেউড়। এর একটু সামনে এগিয়ে যেতেই আম-জাম-কাঁঠালের ছায়ার ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায় দাশেদের বাড়ি। আর এই পথ দিয়ে যেতে যেতেই একদিন কবিতার সাথে দেখা হয়েছিলো। কবিতার কাঁধ ছুঁয়ে আবার যখন হাঁটতে থাকি নকশি কাঁথার মাঠ দিয়ে, তখন রূপাই মেয়েটি কলাঝোপের আড়াল দিয়ে সাজু ছেলেটির মাঠের দিকে হেঁটে যাওয়া পথের দিকে উঁকি দিয়ে দেখে। আমরা চুপিচুপি রূপাই মেয়েটির পাশে দাঁড়িয়ে ইতিহাসের পাতায় পাতায় উঁকি দিয়ে দেখছি, সেখানে কবিতারা কার সাথে কথা কয়?
কবিতারা ভালোবাসার কানে কানে কথা বলে, কি কথা বলে? ‘একদিন ঘুমের ঘোরে তোমায় কামড়ে না দিয়েছি তো দেখো!/ আগেই বলেছিলাম, এমন করে আমায় বিবর্ণ করো না হে ভালাবাসা।’ [যে কথা কেউ জানে না, পৃষ্ঠা ৪০] ‘হরিৎ জ্যোৎস্নায় ভেজে রূপকথার গাছ’ কাব্যগ্রন্থ থেকে।
মানুষ ভালোবাসাকে নিয়ে অনেক দ্বন্দ্বে পড়ে যায়। ভালোবাসার একটা পূর্ণাঙ্গ নাম দেয়া যাক, ধরে নেয়া যাক জীবন। বীজদানার মধ্যে একটি জীবন থাকতে পারে। বীজদানাটি মৃত্তিকার উপযোগি ওম পেয়ে অঙ্কুর হয়ে সবুজ ছাড়ালো। কোথায় তার নিবাস, কোন জঙ্গলে বা পাহাড়ের খাদে কোথায়, তা নিয়ে তার মাথা ব্যথা নেই। তার শেকড়ে চায় কিছু পানি, তার জিহ্বাতে চায় কিছু আলো-বাতাস। সে মহীরুহ হয়ে উঠছে কিনা, তার ফুল-ফল তাকে নিয়ে বন্দনা করছে কিনা, এসবে তার কোন আগ্রহ নেই। তবে তার দায় আছে নিজের প্রাণকে ধরে রাখা। সে জানে নিজের শেকড়কে মাটিতে ধরে রাখতে পারলে তার প্রজাতি টিকবে, এতেই সে খুশি। মানুষের প্রাণটি প্রাকৃতিক আর জীবনটি স্বপ্নের মধ্যে বিস্তৃত। এই স্বপ্নের বিস্তৃতির মধ্যে চলতে থাকে খেলা। এই খেলায় সে জয়ী হতে চায় সর্বত্র। বিজয়ী মানুষ নিজেকে ঈশ্বর জ্ঞান করতে ভালোবাসে। এই ঈশ্বর হয়ে ওঠার প্রতিযোগিতায় মানুষ পরস্পরকে পরাজিত করতে চায়। আবার পরাজিত মানুষগুলো একে অপরের সাথে ফিসফিসিয়ে ভালোবাসার কথা বলে। আমরা এখন শাকিলা তুবা’র ‘হরিৎ জ্যোৎস্নায় ভেজে রূপকথার গাছ’ কাব্যগ্রন্থ থেকে ভালোবাসার কিছু ফিসফিসানো স্বর শুনবার জন্য কান পাততে পারি:
ভালবাসাকে বলেছিলাম বর্ষণ হয়ে না ভেজাতে
বরং তৈরি করে দিয়ে গেলো আশ্চর্য এক ঘর
কুয়াশার ধুম্রজাল ভেদ করে একটা পানসী মাইলের পর মাইল ছুটছে [ যে কথা কেউ জানে না, পৃষ্ঠা ৪০ ]
ভালোবাসার কাছে কবির এক ভিন্ন আকাক্সক্ষা আছে। সেই আকাক্সক্ষাটি পানসীর উপর চেপে মাইলের পর মাইল ছুটছে। মানুষের আকাঙ্ক্ষাগুলো পরাবাস্তবতার ধুম্রজালের মধ্যেই বসবাস করে।
অবেলায় যে ফেরী করে বেড়ায় আমার মন
কিনে দিতাম কিছু মোম আর দেশলাই
ভালবাসার মৃত্যুপ্রাপ্ত মানুষের শবযাত্রায় এসব আলো কাজে লাগে বৈকি। [ যে কথা কেউ জানে না, পৃষ্ঠা ৪০]
মানুষের আকাক্সক্ষার মৃত্যু হয়তো নেই। শেষ দিন পর্যন্ত তার আলো জ্বালিয়ে রাখে মাুনষ।
মানুষের অনুভূতির তল আর সীমার বিস্তৃতি কতদূর প্রসারিত তা ভাষার সীমাবদ্ধতাকে সন্ধান করে ফেরে। শাকিলা তুবার অনুসন্ধান সেইখানে। তার ভাষার প্রবাহমান গতি অসীম অনুভূতিকে প্রায় স্পর্শ করতে সক্ষম। তার ভাষার সাবলিলতা পাঠককে শব্দের সরাসরি মুখোমুখি আর চোখাচোখি করিয়ে দেয়। আবার হঠাৎ কোন বাক্য পাঠককে বারবার ভাবাতে বাধ্য করে:
এবারের বৈশাখে ঠিক ঠিক যাব আপনার বাড়ি
একটা বাড়ি পরেই তো থাকেন!
যদিও মাঝের ওই বাড়িটাতেই আমার যত আপত্তি,
বোধ করি তাই একদিন, মাত্র একটি শীতের রাতে মাঝের ঐ বাড়িটি দেখিনি [ কেমন আছেন আপনি, পৃষ্ঠা ১৫ ]
শীতের রাতটিতে মাঝের বাড়িটি কেন দেখিনি কবি? পাঠককে অনুসন্ধানী করে তোলে। সাবলিলতা ভেঙে দিয়ে পাঠকের সাথে নতুন খেলায় মাতে স্বয়ং কবি। প্রেমিকা কি আড়ালকে সরিয়ে দেবার জন্য শুধুমাত্র একটি শীতের রাতের জন্যই অপেক্ষা করে? বা একটি বাড়ি কি প্রেমিকের মুখোমুখি করতে বাঁধার দেয়াল হয়ে ওঠে। প্রেমিকার অনুরাগ কি কোন আড়ালকেই তোয়াক্কা করে? আমরা ধারণা করতে পারি, এই পঙক্তিতেই কবি অনুরাগের ছোঁয়া আঁকতে সচেষ্ট হয়েছেন!
ভালোবাসার মধুপর্বের নাম অনুরাগ। অনুরাগের অনুকম্পন ছেড়ে প্রেমিকে এগিয়ে যেতে হয় নিবেদনের পথে। নিবেদনের ভাষাটিও সাবলিল এখানে:
নদীর গহীনে জাল ফেলো আড়ম্বরে
ধীবর, নীরবে মন তোল, মাছ নয়! [ ধীবর, পৃষ্ঠা ৭৫ ]
বানের জলে একটা সাপ ভেসে যাচ্ছে, তার মাথার উপর একটি ধেড়ে ইঁদুর। পিঁপড়ের থোকা আর পিঁপড়ের ডিম, একটি মৃতপাখি আর পাখির বাসা। একটি বা একাধিক শিশু খেলনা। একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার মায়ের কাছে রক্ষিত সন্তানের শেষ স্মৃতিচিহ্নÑ তার পরিধানের কাপড় বা বাঁশের বাঁশি বা একতারাটিও ভাসিয়ে নিচ্ছে বন্যার জলের তোড়। এইসব আলাদা আলাদা দৃশ্যপট একসাথে ভেসে যাচ্ছে। ভাসিয়ে নিচ্ছে বানের জল। আমাদের ভাবনার গতি পাল্টায় ক্ষণে ক্ষণে অথবা ভাবনার বিস্তার বয়ে চলে ভিন্ন ভিন্ন দৃশ্যপটের ভেতর দিয়ে, তখন একেকটি খণ্ডচিত্র পারস্পরিকভাবে জোড়া দেয়া সহজ হয়ে ওঠে না পাঠকের জন্য। জলরাঙা মেয়ে কবিতাটি ভাবনার পারস্পর্য হয়তো আছে, ঠিক ঠিক সূত্র ধরে রাখা হয়তো কঠিন হয়ে যায়। তারপরেও বলতে হয়, সব ভাবনা, শব্দের গাঁথুনি আর শব্দের আলোড়ন মিলেমিলে না গেলেও কবিতার ক্ষতি হয় না। পাঠকমনে শুধু আলাদা আলাদা দৃশ্যপটই ভেসে থাকুক না। একটি শিল্পোত্তীর্ণ কবিতার স্রোত সব কিছু ভাসিয়ে নিক না:
ইটের ভাটায় পুড়ছিল কয়েকটি পাখা
একটা গোলাপী পাখায় আগুন লাগেনি তখনো,
হতচকিত মুগ্ধতায় আগুন থেকে গোলাপ কুড়োয়
ঝর্ণার পানিতে জন্ম যে মেয়েটির।
পরের স্তবকে:
ওরা সকাল থেকে দুপুর অব্দি হাওয়ায় ঘোরে,
উৎসর্গীত ফুলের মধু চোষে শেষ বিন্দু পর্যন্ত,
আত্মত্যাগের তৃপ্তিতে মৌমাছিগুলো রয় চেয়ে
বনজ্যোৎস্নার পট পরিবর্তন হয় মুহুর্মূহু।
আবার শেষ স্তবকে:
পাখার গোলাপী পালকে জরীর নকশা কাটে মেয়েটি,
সে জানে না ঘুম তাকে জড়িয়ে রাখে গভীর সুখে,
জলরাঙা মেয়ের লোভে স্বর্গও কবে হয়েছে বিস্বাদ,
ইটের ভাটায় আর নিজের পাখা খোঁজে না স্বর্গদূত। [জলরাঙা মেয়ে, পৃষ্ঠা ৫৮]
কবি শাকিলা তুবা’র কাব্যমানস নিবেদনের স্নিগ্ধতা দেয়। প্রেমিকের অনুভব নিয়ে বিশ্ব সংসারের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে মন চাইবে। মানুষের মানবিক আকাক্সক্ষার বিস্তর আলোড়নগুলো ভেসে ওঠে ভাসতে থাকে। শব্দের সাংগীতিক পরশ এনে দেয় কাব্যময়তার নতুন দোলা। কাব্যের সহজাত সুর ভিন্নভাবে মুগ্ধ করে পাঠককে।
একটি মাত্র টিপই আজ আমার কপালে,
টিপের নিচে এখন ক্ষত,
দগদগে ঘা হয়ে জ্বলছে; ক্রমবর্ধমান...
আজ ভাবি, সেদিন সবগুলো টিপ পরে নিলেই হত,
কপালটা দগদগে হতে হতে একটা মানচিত্র হয়ে যেত আর
আমি তখন তোমায় ভালাবেসে হয়ে যেতাম দশের। [ ও মেয়ে তোমার টিপ, পৃষ্ঠা ৮২ ]
‘হরিৎ জ্যোৎস্নায় ভেজে রূপকথার গাছ’ কাব্য শিরোনামের সাথে মিথ জুড়ে দেবার চেষ্টার সাথে সাথে রোমান্টিসিজম জুড়ে দেবার চেষ্টাও আছে। শাকিলা তুবা’র প্রথম কাব্যগ্রন্থটির অধিকাংশই প্রেমের কবিতা। মধ্যবিত্ত-শিক্ষিত-সরল সাধারণ কথা বলার ঢঙে কবিতাগুলোর শব্দবিন্যাস করা হয়েছে। তবে কিছু কবিতা গ্রন্থ থেকে সরিয়ে নিতে পারলে একটি সুনির্বাচিত কবিতার সুস্বাদ পাঠক পেতে পারতো। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ছয় ফর্মা করার জন্য অনেক প্রশ্ন করার হয়েতো আছে। অনেক বাঁকা কথা না বলে বলা যায়, শাকিলা তুবা’র লেখালেখির প্রচেষ্টা অনেক দিনের, সেখান থেকে কবিতাগুলো একসাথে গ্রন্থভুক্ত করতে চেয়েছেন। বই প্রকাশের সাথে বিনিয়োগের সম্পর্ক রয়েছে। আর সেইসাথে পাঠকের পাঠের আগ্রহ কতটা, তা পরিমাপ করেই বইয়ের পরিধি অনেকাংশে হিসেবি লেখক ও প্রকাশক বই করে থাকেন। সেক্ষেত্রে বইটির আয়তন সুবিবেচনা প্রসূত হযনি বলে জ্ঞান করি। তবে বইটি কাব্যপাঠকের কাছে শাকিলা তুবা’কে চিনিয়ে দেবে নিঃসন্দেহে।
একটি বিয়য় পাঠককে আহত করবেই, তা হচ্ছে পাণ্ডুলিপির পরিচর্যার দিকটি। এক দিক দিয়ে বই প্রকাশের সময় সমকালীন বানান রীতিটি অবশ্যই গ্রহন করতে হবে। কাব্যগ্রন্থের শিরোনামে ‘জ্যেৎস্না’ বানানটি কোনভাবেই কি আমরা গ্রহন করতে পারি? আমাদের প্রকাশনাগুলোতে পাণ্ডুলিপি সম্পাদনার জন্য যোগ্য মানসম্মত পেশাদার সম্পাদকের ঘাটতি থাকতে হয়তো পারে। কিন্তু পাণ্ডুলিপির অসংখ্য বানান প্রমাদ কোনভাবেই গ্রহনযোগ্য নয়। এই বইয়ের প্রকাশককে খুব সাধারণ মানের একজন প্রকাশক হবার যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। একটি পাণ্ডুলিপি গড়ে উঠতে বছরের পর বছর বয়ে যায়। তাকে পরিশীলিত করে, নির্ভুলভাবে ও নান্দনিক মানসম্মত করে পাঠকের রুচির উপর ছুঁড়ে দিয়ে চ্যালেঞ্জ জানাবার সৎসাহস দেখাতে হয় প্রকাশককে। প্রকাশককে কোমর সোজা করে বুক টান করে পাঠকের মুখোমুখি দাঁড়াবার ক্ষমতা থাকতেই হবে।
কবি শাকিলা তুবা’র সৎ কাব্য নিষ্ঠার জয় হোক। পাঠকের জন্য নতুন কবিতার সাহস যোগাবে শাকিলা তুবা’র কাব্যগ্রন্থটি।
হরিৎ জ্যোৎস্নায় ভেজে রূপকথার গাছ। শাকিলা তুবা। প্রকাশক: নন্দিতা প্রকাশ। প্রচ্ছদ: চারু পিন্টু। প্রকাশকাল: নভেস্বর ২০১১। পৃষ্ঠা: ৯৬। মূল্য: ১৮০ টাকা।
শাহবাগস্থ পাবলিক লাইব্রেরির বৈশাখী বইমেলাতে বইটি পাওয়া যাচ্ছে 'ভনে'র স্টলে। সংগ্রহ করুন। মেলাটি চলবে ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত।