একজন জীবিত এবং রীতিমত সেলেব্রেটি। তাকে নিয়ে বিশ্বের গণ্যমাধ্যমে কি নর্তন কুদন, কি মাতামাতি। আহা ! চোখ জুড়িয়ে যায় দেখলে। তেনাদের আশির্বাদ থাকলে, কত কিছুই না হতে পারে। নইলে স্কুলে যেতে পারে না যে কিশোরি মালালা, সে ঘরে বসে এই বয়সেই অক্সফোর্ড কোয়ালিটির ইংরেজি শব্দে ব্লগ লিখতো। আচ্ছা, সে ইংরেজি শিখেছে কার কাছ থেকে? এমন তো না যে তার পিতৃদেব ইংরেজির দিগগজ, যার কাছ থেকে ঘরে বসেই ইংরেজিতে পন্ডিত বনে গিয়েছে। আর যে আফগানিস্তান যুদ্ধ বিধবস্ত , যেখানে প্রাণ নিয়ে চলাই দায়, যেখানে স্কুলই ঠিকমত চালাতে তাবেদার সরকারের হিমসিম খাওয়ার দশা, সেখানকার ইন্টারনেট কি চমৎকার চলছে। সত্যি হিংসা হয়
যেদিন এই মালালা "তালেবানের" হাতে গুলি খেলো, সেদিন স্থানিয় পত্রিকার আগেই বিদেশি গণমাধ্যমে ফলাও করে সেই খবর প্রচারিত হলো। অনেকটা আমাদের দেশে তসলিমার নামে কোথায় কোন অখ্যাত যায়গায় মিছিল বের হবার মতই। দেশের আগেই বিদেশের পত্রিকায় ফলাও করে মাতামাতি আর মাতম।
মালালার মাথায় নাকি ক্লোজ রেঞ্জ থেকে গুলি করা হয়েছে। ৩২ ক্যালিবারের রিভলবার দিয়ে গুলি করলেও ইন দা স্পটে একজন মারা যাবে। কিন্ত হয়তো বিধাতার আশির্বাদই হবে। মাথায় গুলি খেয়েও তার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই খোদ লন্ডনে গিয়ে উন্নত চিকিৎসা করে সে দিব্যি সুস্থ। এই সময়কার কোন ফটো বা সংবাদ যা দেবার সব পশ্চিমা গণমাধ্যমই দিয়েছে।
তবে কিনা ইরাক ঘটনার পর পশ্চিমা সংবাদপত্রের কোন খবরে অন্তত আমি আস্থা রাখি না। বিশেষ করে ভুরাজনৈতিক খবরগুলি। এখন তো শুনছি ওই একই কায়দায় সিরিয়ার প্রতি নির্লজ্জ অপপ্রচার শুরু হয়েছে। কয়দিন পর দেখবে হলিউড থেকে এই ব্যাপারে ছবিও বানানো হবে। যেটি আবার অস্কারও পেয়ে যাবে। (হার্টস লকার ছবিটি দ্রস্টব্য)
সিরিয়ার মত দুর্বল একটা পিচ্চি দেশ নাকি পশ্চিমাদের জন্য হুমকি !
কেন বাবা এত ছেনালি করা? সোজা করে বললেই তো হয় যে, মধ্যপ্রাচ্যে কোন আরব দেশের শক্তিশালি হয়ে উঠা তোমাদের নির্বাচনে টাকা জোগান দেয়া জিয়নবাদিদের আস্তানা ইসরাইলের জন্য সুখকর ও কাম্য নয়?
মালালা বেচে আছে তার বাবা মার চোখের তারা হয়ে। বেচে থাক। সুখে থাক। তবে যেন কোনদিন দেখতে না হয় যে, নারী শিক্ষা আর নারী অধিকারের ফেরি করতে করতে সে একদিন নিজেই পণ্যে পরিণত হয়েছে।
আরেকজন আজ মৃত। বয়স কিন্তু মালালার চেয়েও কম ছিল। তার দোষ ছিল, সে প্রতারকের পাল্লায় পড়ে ভারতে গেলেও, দেহব্যাবসা করে সমাজ থেকে হারিয়ে যায়নি। বরং ছোট খাট কাজ করে, নিজের আর সংসারের পেট চালাতো।
দেশ আর মাটি থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করা যায়নি বলেই, সে দেশে ফিরতে চেয়েছিল। কিন্ত প্রতারকের পাল্লায় পড়ে যারা বিদেশে যায়, তাদের আবার ভিসা পাসপোর্ট কি? তাই ঝুকি নিয়েই সীমান্তের তারকাটা পার হয়ে দেশে আসতে চেয়েছিল।
ওর বেলায় বিধাতা ছিলেন নির্দয়। কাটাতারে কাপড় ঝুল আটকে যাওয়াই তার কাল হলো। তাই বিএসএফ নামের জারজদের শিকারে পরিণত হয়ে গুলিবদ্ধ অবস্থায় উলটো হয়ে মৃত্যুযন্ত্রণায় কাটিয়েছে কয়েকঘন্টা। এর মধ্যে বাচাও বাচাও বলে অনেকবার আর্তচিৎকার করলেও, সেই বানী দিল্লি কোলকাতা বা ঢাকায় কারো কানে পৌছায়নি। ওয়াশিংটন লন্ডন তো অনেক দুরের কথা।
আর শুনলেই উনারা গা করবেন কেন? আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে ভারত তো ইতিমধ্যেই তাদের অংকশায়িনি হয়ে গিয়েছে। সুতরাং হাজার পাপ করলেও, দেখেও না দেখা আর শুনেও না শোনার ভাব করে বসে থাকবে মোড়লরা। নইলে ৪০ জনকে "হত্যা" করার অপরাধে সাদ্দামকে ফাসি দেয়া হয়েছে, আর নুর আল মালিকির শাসনামলে প্রতিদিনই গড়ে ৪০জন ইরাকি বেসামরিক নাগরিক রহস্যময় অর্ন্তঘাতে নিহত হচ্ছে। সিরিয়াতে রাসায়নিক অস্রের প্রয়োগের অলিক অভিযোগে আগ্রাসন চালানোর তোড়জোর করলেও, ফিলিস্তিনের নিরীহ নারী আর শিশুদের উপর অবৈধ রাস্ট্র ইসরাইল ফসফরাস বোমা চালিয়ে হত্যা করলেও সেদিকে তাকানোর কোন গরজ পশ্চিমাদের নেই।
শোনা গেছে, পানির জন্য অনেক কাকুতি মিনতি করলেও বিএসএফ জারজরা তাকে পানি তো দেয়নি, বরং অসহায় অবস্থায় নিশ্চিত মৃত্যু পথযাত্রি এই কিশোরির উপর পাশবিক নির্যাতনও চালিয়েছিল।
হ্যা, আমি হতভাগি ফেলানির কথাই বলছি।
আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে যতদুর জানি দুই দেশের মধ্যে সেই রকম বৈরিতা না থাকলে নাকি এই সব বেড়া দেয়া হয় না। আর সীমান্তে গুলি করে নিরপরাধ বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করা রীতিমত আন্তর্জাতিক আইন পরিপন্থি।
সে কাজটিই ভারত দিনের পর দিন করে যাচ্ছে। অথচ আমাদের কারোই কোন বিকার নেই। সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিক হত্যা এখন এতই গা সওয়া হয়ে গিয়েছে যে, সংবাদপত্রে ছোট করে এক কোনায় খবর ছাপা হয়। সেটি পড়ে আমরা এক দুই মিনিট হায় হুতাশ করি। ব্যাস ! এর পর বসে যাই হিন্দি সিরিয়াল দেখতে। কিংবা বলিউড সেলেব্রেটিদের নিয়ে গসিপ শুরু করতে।
যেহেতু ভারত এখন পশ্চিমাদের নয়নমনি, তাই পশ্চিমাদের লোক দেখানো মানবাধিকার আইনের শাসন ইত্যাদির অস্তিত্ব প্রমান করতেই, ফেলানি হত্যার বিচার শুরু করা হয়েছিল। এ যে আই ওয়াশ, তার জলজ্যান্ত প্রমান হলো, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি অপরাধ সংঘটিত করেও বিএসএফ সদস্য বীর পুঙ্গব অমিয় ঘোষ ভারতের আদালতে নির্দোষ বলে প্রমানিত হয়েছে।
আহা ! এখন ভারত সরকার বলতে পারবে যে, দ্যাখো দ্যাখো আমরা আইনের শাসনের প্রতি কত শ্রদ্ধাশীল। এখন আদালত যদি কেউকে নির্দোষ বলে রায় দেয় তো আমরা কি করবো?
আর আওয়ামি লিগ সরকারও বলিহারি যাই। মুখে বলছে তারাই নাকি স্বাধীনতার চেতনার একমাত্র সোল এজেন্ট। অথচ সীমান্ত হত্যার ব্যাপারে তাদের দলেরই সাধারণ সম্পাদক জনৈক সৈয়দ আশরাফ বলেছিল "সীমান্তে হত্যাকান্ড ঘটবেই। এই সব নিয়ে সরকারের মাথা ঘামানোর সময় নেই।"
যে দলের সাধারণ সম্পাদক ভারতের প্রতি আনুগত্যশীল, সেই দলটিকে স্বাধীনতার স্বপক্ষ্যের শক্তি এ কথা কি কোন বিবেকবান মানুষ বিশ্বাস করবে? না বিশ্বাস করা উচিত?
ফেলানির কপাল খারাপ বলতেই হয়। সে স্বল্প শিক্ষিত মেয়ে। ইংরেজি জানতো না, ব্লগ লিখতে পারতো না। সর্বোপরি তাকে দিয়ে বিশ্ব মিডিয়ার বাণিজ্যও হতো না। তাই এই রকম অপঘাতে মরার পরেও তার বিচার নিয়ে অবিচারের ব্যাপারে বিশ্ব নিশ্চুপই থাকবে।
আর যে দেশে ফেলানির জন্ম, সে দেশের মানুষেরা স্বাধীনতা যুদ্ধের পর থেকে আসতে আসতে নিবীর্য কাপুরুষের পরিণত হয়েছে। তাই প্রতিবেশি রাস্ট্রের একান্ত বাদ্যগত ভৃত্যদের তারা ভোট দিয়ে ক্ষমতায় পাঠায়।
আর তথাকথিত মানবাধিকার ধব্জাধারিরা (ব্যাতিক্রম রয়েছে) দেখলে নারীত্বের অবমাননা দেখেন, তালাকের প্রশ্নে ইসলামকে তুলোধুনা করে আইন পর্যন্ত বদলাতে দিনমান আদাজল খেয়ে পড়ে থাকেন। অথচ ফেলানির প্রশ্নে নারীত্বের কোন অবমাননা তাদের চোখে পড়ে না। সাধে কি লোকে বলে যে, আমাদের রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে আমলা, ব্যাবসায়ি, সাংস্কৃতিক কর্মি, সুশিল সমাজ, সাংবাদিক, সম্পাদক, সুশিল সমাজ প্রতিটি স্তরে ভারতের দালাল বিদ্যমান।
১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধকালিন সময় রাজাকারের সংখ্যা ছিল নেহায়েতই হাতে গোণা। অথচ স্বাধীনতার ৪২ বছর পরে, নব্য রাজাকারদের সংখ্যা আশংকাজনকভাবেই বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এ সবই সম্ভব হয়েছে আমাদের উদাসীনতা, নির্লিপ্ততা আর দেশপ্রেমহীনতার কারণে।
যদি স্বাধীনতার সময়ই বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকির পথে প্রকাশ্যে রাজাকার নিধনে চলতো, তাহলে এত বছর পর নব্য রাজাকারদের উত্থান হতে পারতো না। আর এই সব নব্য রাজাকাররা না থাকলে, আজ বিএসএফের মত জারজ একটি বাহিনীর সাহস হতো না, আমাদের বুকে গুলি চালানোর।
আর আমরাও অন্তত ভারতীয় পণ্য, হিন্দি বুলি আর হিন্দি পর্ণ নায়িকাদের দেখে মজতাম না। কঠিন প্রতিবাদে ভারত সরকারের কাপুরুষ হৃদয় কাপিয়ে দিতে পারতাম।
নাহ ! সেই সবই স্বপ্নের কথা। বাস্তবতা ভিন্ন জিনিস। তাই অক্ষমের দুর্বলতা থেকেই শুধু বিরবির করে বলতে হচ্ছে, আহা রে ফেলানি, তুই যদি মালালা হইতি রে
ধীবর
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ১:১৯