১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই আমার জন্ম। সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া দেশের যেইসব প্রত্যাশিত দুর্যোগ তার মধ্যে উচ্চমধ্যবিত্ত একটা পরিবারের সন্তান হিসাবে আমি নিজেরে প্রিভিলেজ্ড’ই ভাবি আজো। আমার জন্মের আগে বাড়িতে অ্যাম্বুলেন্স আসে মায়রে হাসপাতালে নিয়া যাওনের লেইগা। হাসপাতালের ডাক্তার সাবে রা অপেক্ষা করেন আমার মায়ের লেইগা, নিরাপদ প্রজননের সকল নিয়ম মাইনা আমার ভূমিষ্ঠ হওন এই পৃথিবীতে। তখন এই দেশের মানুষ শুনছি দুর্ভিক্ষের প্রারম্ভিক কবলে, একদিকে পর্যাপ্ত সরবারাহ ছিলো না পণ্যের অন্যদিকে ক্ষমতাসীন মুনাফাখোরগো পরিকল্পিত বাণিজ্যের চাপ, সব ছিলো। আমার বাপের ব্যবসা ছিলো, তিনি যেই পণ্য বানাইতেন সেইটা ঠিক গরীব মানুষের পণ্য না। যাগো টাকা আছে, তারাই কেবল আমার বাপের ফ্যাক্টরিতে বানাইন্যা পণ্যের ভোক্তা হইতে পারতো। যাউগ্গা জন্মদিনের এই দিনে অঙ্কুরের অংশীদাররে নিয়া খুব বেশি কিছু কইতে চাই না…
১৯৭২ সালে জন্মাইন্যা শিশু আমি বর্তমানের মধ্যবয়স্ক ভাস্কর হওনের পথে জীবনের বহুমুখ দেখছি বইলা দাবী করি। ছোটবেলায় ক্লাস মেট ফাহিমরে দেখছি dress as you like প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করবো বইলা বাপরে দিয়া সুদূর লন্ডন থেইকা সুপারম্যানের কস্টিউম নিয়া আইতে। আবার মহল্লার বন্ধু গোপালরে মধ্যবয়সে দেখি মিরপুর ১ নম্বরের মোড়ে মানুষের জুতা শিলাই কইরা সুখেই আছে…দুই জনের সাথেই যখন দেখা হয় আমি সময় নিয়া কথা কই, জীবন সম্পর্কে…সেইখানে হয়তো আত্মম্ভরীতা থাকে,লজ্জা থাকে, তুলনামূলকতা থাকে। কিন্তু তারা আমার বন্ধু, আজো, হয়তো বাকীটা জীবনেরই। বন্ধুতা মানে আমি দলবাজী বুঝি না আর…
পুরান ঢাকায় একটা বড় সময় কাটাইছি…আমার নানা-দাদার বাড়ি এখনো সেইখানেই। সপ্তাহের পাঁচটা দিন স্কুল-বাসা-আবাহনী মাঠ আর শনি-রবি নানী বাড়ি এই কইরাই চলছে আমার শৈশব আর কৈশোর। চরিত্রের মধ্যে যেই কারনে একটা pseudo ঢাকাইয়া আচরন শিকড় গাইরা বইসা গ্যাছে। আমি ঢাকাইয়াগো মতোন রূঢ় হই শব্দোচ্চারণে, সহজে ক্ষুব্ধ হই weekend রকবাজী’র লেইগা। যতোটুক দরকার এইরম আচরনে গা ভাসাইতে, তার সবটুক স্বাধীনতা’ই আমার মা প্রোভাইড করছেন আমার বাইড়া উঠনে। কেবল একটা জায়গাতেই আটকাইছেন বন্ধনে…বাংলা সাহিত্যের ছাত্রী আর স্কুল মাস্টারনী হওনে তার চরিত্রের একটা দিক সারাক্ষণ চাইছেন আমার মধ্যেও সংক্রমিত হোক…আমরা যাতে ছাপার অক্ষরে থাকা গ্রন্থপাঠ করি। তার সুখ ঐটাতেই…কখনো চান নাই আমি এইটা হই ওইটা হই…তার চাওয়া ছিলো আমরা যেনো মানুষ হই…বাড়িতে খাওনের টেবিলে আমরা তর্ক করতাম সামাজিক বিভিন্ন সমকালীনতা লইয়া…যুক্তি করনের অভ্যাস গইড়া উঠুক তিনি চাইছেন সর্বান্তকরণে…
আমার বাপে ছিলেন আওয়ামি লীগের ব্যবসায়ি সমাজের প্রতিনিধি টাইপ। ৭৩’এ দেশে যখন দুর্ভিক্ষ সেইসময়ে শেখ মুজিবের জন্মদিনের কেক বানাইয়া পাঠাইছিলেন তিনি…তার একটা কনফেকশনারী ছিলো, এই কনফেকশনারীর নাম পুরান ঢাকার মানুষ এখনো মনে রাখে…ঐতিহ্যের মতোন। সেই ফ্যান্সি বেকারীর নামে। আমি যখন স্কুলে পড়ি সেই সময়েও আমি বাপের লগে তর্ক করতাম…দুর্ভিক্ষের সময় কেমনে এই অপচয় সে করতে পারছে! আমার বাপের অনেক আধিপত্যকামী নোংরা ব্যাপার থাকলেও বাড়ি’র সাংস্কৃতিক অবস্থানের কারনে এই তর্ক চলতো আমাগো বাড়িতে। বিশ্বিবিদ্যালয়ে আমি যখন বাসদের রাজনীতিতে যোগ দেই তখন তিনি আমারে রাজনীতি না করনের কোন চাপ দিতে পারেন নাই…তখন আমার বাপের ব্যবসা লোকসানের দায় নিয়া প্রায় সমাপ্তির পথে, কিন্তু এই অনিশ্চয়তার মধ্যেও আমাগো পরিবার থেইকা রাজনীতি বিরোধী কোন মানসিকতা ছিলো না। আমি সিদ্ধান্ত নিছিলাম দলকেন্দ্রীক জীবন যাপন করুম…বিপ্লব হবে আমার জীবন। তাই আমি যখন রাজনৈতিক সংগ্রাম থেইকা সইরা আসি তখন অনেক কমরেড’ই চমকায়। কারন মূলতঃ যেই বিরোধের কারনে একজন সামাজিক মানুষ রাজনীতি থেইকা সইরা আসে, সেই সম্ভাবনা আমার ছিলো না।
পারিবারিক কারনেই আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শ্রদ্ধাশীল হই। কিন্তু কখনোই তর্কহীন থাকতে পারি না। শেখ মুজিব আর আওয়ামি লীগের সমালোচনা কইরাই আমরা এখনো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করতে পারি। তাতে কারো চেতনার বিপর্যয় ঘটে না। আমরা শৈশব থেইকাই শিখি, এই সমাজের যা কিছু ভালো আর যা কিছু খারাপ তার বাইরেও অনেক মতবাদ আছে। আবাহনী মোহামেডান কিম্বা আওয়ামি লীগ-বিএনপি এই চেতনার বাইরেও মানুষের চিন্তার মুক্তি প্রয়োজন।
সক্রিয় রাজনীতি করতে গিয়া আমি একটা বড় ধাক্কা খাইছিলাম। তার পরিণতিতেই আমারে অব্যাহতি পাইতে হইছিলো বাসদের ছাত্র সংগঠন থেইকা। তখন আমি কেন্দ্রীয় কমিটি’র দপ্তর সম্পাদক ছিলাম। আমি প্রয়োজনবাদের বিরুদ্ধে কথা কইছিলাম…প্রয়োজনবাদের বিরুদ্ধে আমি খানিকটা সোচ্চার হইছিলাম…বুর্জোয়া মার্কিন সংস্কৃতির মূল পরিচালিকা শক্তি এই প্রয়োজনবাদের বিরোধীতা কইরা আমি সংগঠন পরিচালনার কথা বলছিলাম। সংগঠন পরিচালিত হওয়া প্রয়োজন দ্বন্দ্বমূলকতা দিয়া সেইটা বলছিলাম। কিন্তু সংগঠন তার প্রয়োজন থেইকা চোখ সরাইতে পারে নাই। মার্ক্সিয় রাজনীতির এই সমস্যাটা আমি হাইলাইট করছিলাম…মতাদর্শ আর সংগঠনের একটা দ্বন্দ্বমূলকতা নিয়া ভাবতে কইছিলাম পার্টিরে…কিন্তু পার্টির অনেক বিশ্লেষণে আমি আজো একাত্ম হইলেও সংগঠন পরিচালনার মমতাদর্শ নিয়া বিরোধ তৈরী হইলো ভালো মতোই…
কিন্তু আমার জীবনের সবচাইতে কাছের মানুষগুলি ছিলো আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সাংগঠনিক সহযোদ্ধারা। আজো আমি রকিব ভাইয়ের সাথে ব্যক্তিগত অনুভূতিমালা শেয়ার করি। রফিক ভাই এখনো আমার মেন্টর মতোন থাকেন…সেবাদিরে দেইখা আমি নারীমুক্তি’র কথা ভাবতে সাহস পাই…এই মানুষগুলি আমারে মাদকাশক্তি থেইকা ফিরাইয়া জীবনের নতুন দৃষ্টিভঙ্গী ধারণে সহযোগিতা করছিলো। সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রতি মনোনিবেশ করাইতে পারছিলো আমার বিক্ষিপ্ত অস্তিত্ববাদী মনোভঙ্গী থেইকা।
আমার এই বাইড়া উঠনের কালে আমি শিখছি, প্রতিবাদ না করলে একজন মানুষ আর মানুষ থাকে না। পোষা পশুর সাথে তার কোন পার্থক্য থাকে না। প্রতিবাদ আর সঠিক বিশ্লেষণী ক্ষমতাই পারে একজন মানুষরে শ্রেয়তর করতে। কারন শোষকেরা, স্বৈরতান্ত্রিকেরা ক্ষমতাশালী হইলেও তাগো মনুষ্যত্ব লইয়া সামাজিক প্রশ্নের মালা অনেক দীর্ঘ। যেকোন অ্যাক্টিভিজমে অংশগ্রহণের আগ্রহ আমার অপরিসীম…কিন্তু এক্কেরে প্রশ্নহীনতায় তারে ছাইড়া দেওনটা আমার কাছে মনুষ্যত্বের প্রকাশ মনে হয় না। কার পক্ষে লড়তাছি? কেনো লড়তাছি? কিভাবে লড়তাছি? আমার উদ্দেশ্য কি? আমার লক্ষ্য কি? এইসব আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয় তার ধারাবাহিকতাতেই…এইসব প্রশ্নকরনের মধ্য দিয়াই আমি যুদ্ধের সৈনিক থাকতে চাই। আমার প্রশ্নে যদি কেউ মনোকষ্টে ভুগে তাইলে এইটা তার সমস্যা…জীবনরে যে যুক্তির নিগড়ে বানতে পারে নাই এইটা তার সমস্যা। আবেগের নির্ভরতায় কোন কার্যকরী পরিবর্তন ঘটে না, আমি এই মতাদর্শে বিশ্বাস করি।
আজকে আমার জন্মদিন। ফেইসবুক আর মৌসুমের কল্যাণে এই জন্মদিনের কথা মনে রাখতে আমি বাধ্য হইতেছিলাম। কিন্তু গতো ৩৫ বছরের জন্মদিনগুলিতে আমি কয়টা জন্মদিবসে এইরম মনে রাখছি!? ছোটবেলায় বাড়িতে কেক কাটা হইতো মনে আছে, বন্ধু-বান্ধব আসতো…তারপর বড় হইয়াও শেষ ৯৩ পর্যন্ত রাইত ১২টার সময় বাড়িতে ফিরা টের পাইতা আমার জন্মদিবস আজ! ছোটবোনটা সারপ্রাইজ্ড করতে পারছে আমারে আজীবন…ঐ সারপ্রাইজ্ড হওনের অপেক্ষাতেই কি আমি সব ভুইলা থাকতাম!? কে জানে!
এই প্রথম আমি কিছু লিখতেছি জন্মদিন উপলক্ষ্যে…আমার কাছে এই দিবসের কতোটুকই বা মর্তবা! তাই অনেক বিক্ষিপ্ত হইলাম চিন্তায়…