৯৫ সালে সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের পূর্ণ সদস্য মনোনীত হইলাম...বিশাল দায়িত্ব, একটা বিপ্লবী দলের অঙ্গ সংগঠনের কাউন্সিলর। সংগঠনের ভবিষ্যত নেতৃত্ব থেইকা শুরু কইরা সকল কর্মপদ্ধতিতে অপিনিয়ন দেওনের চর্চাটা জরুরী সংগঠনের এই পর্যায়ের যেকোন সদস্যের। আর ভবিষ্যতে দলকেন্দ্রীক জীবনযাপনের যেই শপথ তারো চর্চাভূমি ছিলো পূর্ণসদস্যগো ফোরামের। এই ফোরামের সদস্যরা সাধারনতঃ মনোনীত হইতেন, ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় পুরানা প্রায় সকল কমরেডদের শিখাইয়া যাওয়া পথে আমিও অনেক দোনোমনো ছিলাম পূর্ণসদস্যত্ব প্রাপ্তি নিয়া। শুরুতে এইটারে খানিকটা দায়ভারই ঠেকতো। কমিউনে থাকা, কালেকটিভিটির চর্চা, দলজীবন-বিপ্লব জীবন এই চেতনার স্বপ্ন পথে পা ফেলা...অনভ্যস্ততার অস্বস্তিতে পুরা ব্যাপারটারে অনেক কষ্টের সংগ্রাম মনে হইতো, নিজের উপর আস্থা রাখতে পারাটা কঠিন বটে...
যাই হোক ৯৫ সাল আমার জীবনের সবচাইতে স্মরণীয় হয় তার বহু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়া। মাদকাশক্তি থেইকা মুক্ত হই বছরের শুরুতেই...রাজনৈতিক মূল্যবোধের প্রতি জীবনাদর্শ সমর্পণের যেই বিতর্কিত মতাদর্শিক অবস্থান, তার দীক্ষা নেই এই বছরেই। সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারন সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পাই। ইপিজেড'এ শ্রমিক আন্দোলন, গ্রামকেন্দ্রীক কৃষক সংগঠন আর স্কুলে ছাত্র সংগঠনের তৎপরতার সম্প্রসারন শুরু করি বছরের মাঝামাঝি সময়েই। তারপর বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের বাৎসরিক জনসভায় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক উপস্থিতি...তয় বছর শেষে শিবির বিরোধী আন্দোলনের স্মৃতি সবকিছুরে ছাপাইয়া অনেক বড় হইয়া আসে আমার জৈবনিক অধ্যায়ে। যার স্মৃতিচারন আমার পূর্বতন একটা সিরিজ ব্লগপোস্টে করছি।
এতসব স্মৃতির ফাকে একটা স্মৃতি প্রায় হারাইয়া যাইতে বসছিলো। কিন্তু বাঁধ ভাঙার আওয়াজে হঠাৎ ইসলামী ছাত্র শিবিরের পবিত্রতা নিয়া অনেকরে উদ্বেলিত হইতে দেইখা আমার মনে পইড়া যায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতা। ১৯৯৫ সালের ২৬ ডিসেম্বর সংগঠনের একটা পুস্তিকা কেন ছাত্রসমাজ রাজনীতি করবে বিক্রীর দায়িত্ব নিয়া আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই। ঠিক সেই সময়ে রাবি'র দায়িত্বে থাকা কমরেড আরিফ পাবনায় থাকনে আমারেই স্থানীয় নবীন সংগঠকগো সাথে নিয়া পুস্তিকা হাতে বের হইতে হইলো। স্থানীয় সংগঠকরা আমারে শিবির নিয়ন্ত্রিত বিশ্ববিদ্যালয়ে বামপন্থী একটা সংগঠনের পুস্তিকা বিক্রীটা বিপজ্জনক হইবো বইলা বুঝাইলো...আর তাই সিদ্ধান্ত নিলাম লোক বুইঝা অ্যাপ্রোচ করুম...লোক বোঝা মানে চিবুকে ছাগদাড়ি আর টাকনুর উপর পায়জামা অথবা প্যান্ট পরিহিতরা আমার টার্গেট থেইকা বাদ...তো প্রথমেই স্থানীয় শক্তিশালী ছাত্র সংগঠন ছাত্র মৈত্রী'র টেন্টে গিয়া কিছু পুস্তিকা দিলাম তারা গণতান্ত্রিক ছাত্র ঐক্যভূক্ত সংগঠন হিসাবে সাদরে বিশ্ববিদ্যালয়ের হাল হকিকতের কথা শুনাইয়া শিবির বিষয়ে আমার কৌশলের তারিফ করলো।
এরপর টুকটুকের মোড়ে দাঁড়াইয়া আমি লোক বুঝি আর মৃদূস্বরে আমার রাজনৈতিক অবস্থান শুনাই। সেই সময়টায় শহুইরা এবং অশহুইরা মধ্যবিত্তগো মধ্যে ছাত্র রাজনীতি বিরোধী অবস্থান থাকলেও একটা অবরুদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যেইভাবে ছাত্র রাজনীতির পক্ষে যেইরম সাড়া দিতেছিলো তাতে আমি আমি অত্যুৎসাহী হইয়া উঠলাম। অন্যান্য কমরেডরা খাইতে গেলেও আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আরো কয়েকজনরে অ্যাপ্রোচ করি। দূরে তিনচারজন আধুনিক পোশাকের ছাত্রী পরিবেষ্টিত আরো আধুনিক এক ক্লিনশেভ্ড যুবক দাঁড়াইয়া বেশ হাঃ হাঃ হোঃ হোঃ টাইপ মুডে গল্প করতেছে দেইখা একটু অবাক হইলাম। এমন হ্যান্ডসাম যুবকের দিশা ঢাকা শহরেও খুব একটা মিলে না। আর তাই নিঃসন্দেহ হইয়া তারে গিয়া পুস্তিকা আগাইয়া দিলাম। যুবক প্রতিক্রিয়ায় আমারে আগাপাশতলা মাইপা জিগাইলো কোত্থেইকা আগমন...আমি পরিচয় দিলাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র...দ্বিতীয় কোন প্রশ্ন না কইরা সে আমারে ১৫ মিনিটের মধ্যে বিশ্বিদ্যালয় থেইকা বাইর হইয়া যাওনের হুমকী দিলো সাথে মনে করাইয়া দিলো নাইলে আমার লাশ বিশ্ববিদ্যালয়েই পুইতা রাখন লাগবো। এইরম হুমকীর পর মানসিক অবস্থা খুব ভালো থাকনের কথা না। আমিও খানিকটা মেজাজ খারাপ, খানিকটা ভয় নিয়া ছাত্র মৈত্রীর নেতাকর্মীগো কাছে বিস্তারিত কওনের পর তারা উত্তেজিত হইলো...কিন্তু যুবকরে দূর থেইকা দেখানের পর তাগোও ভীত চোখ দেইখা আরো অস্বস্তিতে পরলাম।
শাহাদত নামের এই যুবক কয়দিন আগে বিএনপির সাংস্কৃতিক সংগঠন জাসাস'এর রাবি শাখার সহ সভাপতি আমানুল্লাহ আমানরে পরীক্ষা দিয়া বাইর হইয়া আসনের পথে দিনে দুপুরে কোপাইয়া খুন কইরা শিবির নেতৃত্বের স্নেহভাজন হইছে। আর স্বভাবতঃই সাধারন ছাত্র-ছাত্রী আর প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলির কাছে হইছে মূর্তিমান আতঙ্ক...রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এইরম শাহদতেরাই শিবিরের রাজনীতি নিয়ন্ত্রন করে বইলা ধারণা পাইলাম। আর তারই ধারাবাহিকতায় গতো বছর শিবির নেতা সালেহীন যখন শিক্ষক খুনের দায়ে অভিযুক্ত হয়, তখন অবিশ্বাস করনের কোন কারন খুঁইজা পাইনা...
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে তারপরেও আমি আরো প্রায় এক সপ্তাহের মতোন ছিলাম। খানিকটা নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় পুস্তিকা বিক্রীর কাজটা আরো খানিকটা আগাইয়াও নিছিলাম...কিন্তু ছাত্র শিবিরের ক্ষমতার দাপটে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক প্রতিফলন হিসাবে প্রাণোচ্ছ্বল কোন শিক্ষার্থীর খোঁজ পাই নাই। শুনছিলাম গলা ছাইড়া গান গাওয়ার অপরাধে এক ছাত্রের বিশ্ববিদ্যালয় ছাইড়া চইলা যাইতে হইছিলো...সে আরেক গল্প...
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জানুয়ারি, ২০০৮ রাত ১১:১২