মুগ্ধতাঃ মাটির ময়না(The clay Bird)
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
২০০২ সালের মুভি মাটির ময়না এক মাদ্রাসা বালকের জীবনের গল্প,পশ্চিম পাকিস্তানী শোষন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের টানাপোড়নে ফুটিয়ে তোলা পরিচালক তারেক মাসুদের শৈশবের গল্প। আনু(নুরুল ইসলাম) আট-দশ বছর ছোট্ট বালক, তার বাবা কাজী সাহেব(জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়) কট্টরপন্থী মুসলিম, মা আয়েশা বিবি(রোকেয়া প্রাচী)। সাথে আনুর ছোট বোন আসমা, এবং প্রগতীশীল চাচা মিলন(সোয়েব ইসল্লাম)মিলন আনু কে নৌকা বাইচ, গ্রামের পূজো দেখতে নিয়ে যায়,বাতাসা কিনে দেয়,কাজী সাহেব, আনুর বাবা এসব বেদাতী কাজকর্ম থেকে আনু কে দূরে রাখতে তাকে মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দেন।আনু পরিচিত হতে থাকে বিষন্ন মাদ্রাসার কঠোর পরিবেশের সাথে,তাকে আনোয়ার জানোয়ার বলে খেপানো দুষ্ট ছেলেদের সাথে,আর সম্পুর্ন ভিন্ন মানুষিকতার বন্ধু রোকনের সাথে। দিন যায় রাত যায়, আইয়ুবের ক্ষমতা ত্যাগ,সামরিক শাশন জারি,শাসনত্রন্ত বাতিল, পরিষদ বিলুপ্ত এর রাজনৈতিক টেনশনের মাঝে মুভি এগুতে থাকে। আনুর বাবা কাজী সাহেব বাজারে হোমিওপ্যাথির চিকিৎসা দেন,তব্লীগে যান,আনূ বাড়িতে আসে, মায়ের সাথে পুঁথি পড়া শুনতে যায়,শোনে ইব্রাহীম (আঃ)এর তার প্রিয় বস্তু আল্লাহর পথে কোরবানী দেওয়ার কাহিনী, পরিচালক এর সাথে আনুর মাদ্রাসা গমনের সুক্ষ সাদৃষ্য দেখাতে চেয়েছেন,আনু ,আসম, মিলন চাচা গ্রামের রাস্তায় হাটে, প্রজাপতির এলোমেলো ওড়াওড়ি দেখে, আনু আবার মাদ্রাসায় চলে যায়,আনুর ছোট বোন আসমা আসুস্থ হয়ে পড়ে, এবং এক সময় মারা যায়, আনু বাড়িতে আসে, আসমার কবরে প্রজাপতিদের বিষাদগ্রস্থ প্রলাপ দেখে, এদিকে পশ্চিম পাকিস্থানী বাহিনী নারকীয় হত্যা শুরু করে, মিলন যুদ্ধে যায়, কাজী সাহেব বিশ্বাস করেন না পাকিস্তানী বাহিনী এমন কাজ করতে পারে, এক সময় পাকিস্থানী বাহিনী আসে,গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে ,মৃত্যুর পাহাড় নিয়ে আসে, সবাই পালিয়ে যায়, কাজী সাহেব পালান না,পরের দিন দেখা যায় তিনি মরেন নি, পোড়া ঘরের মাঝে দারিয়ে আছেন পবিত্র কোরআনের অর্ধেক পড়া পৃষ্ঠা হাতে।
মাটির ময়না মুভি সম্পর্কিত তারেক মাসুদের একটা সাক্ষাতকারের(সূত্রঃ প্রথম আলো,নিয়েছেনঃ তৈমুর রেজা)কিছু অংশ তুলে দেওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম নাঃ
প্রশ্ন: বাংলাদেশে আর্ট ফিল্মে জীবন যেভাবে হাজির হয় তাকে কেউ কেউ কৃত্রিম বলেন। আপনার কী মত?
তারেক: আমার সঙ্গে একবার ঢাকাই ছবির অন্যতম পরিচালক কাজী হায়াতের আলাপ হচ্ছিল। মাটির ময়না ছবিটা দেখে উনি বলেছিলেন, ‘আচ্ছা, আপনাদের সিনেমায় চরিত্রগুলো যেভাবে আচরণ করে, সেটা কিন্তু পশ্চিমের মানুষের আচরণকে অনুসরণ করে করা।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী রকম? উনি বললেন, ‘দেখেন আমাদের দেশে যদি আপনজন কেউ মারা যায়, মেয়ে মারা গেল বা বোন মারা গেল, তখন আঞ্চলিক ভাষায় বলে যে একেবারে কেঁদেকেটে ছরদো হয়ে যায়। আপনার সিনেমায় দেখেন, মেয়েটা মারা গেল, বাপেও কান্দে না, মায়েও কান্দে না, ভাইটা, হ্যায়ও কান্দে না। এইটা আসলে পশ্চিমাদের অনুকরণ করেন।’ আমি তখন বললাম, আপনি যেটাকে দেশীয় আচরণ বলছেন, মানুষ এভাবে কাঁদে, হাসে, নানা সময়ে যেভাবে সে আচরণ করে, এই আচরণবিধিগুলো পুরোপুরি কি সে জীবন থেকে আহরণ করে? তার মধ্যে এসব আচরণের অনেক প্যাটার্নই কিন্তু গেঁথে যায় চলচ্চিত্র দিয়ে। বাংলাদেশের মানুষ যে আচরণ করছে, রি-অ্যাক্ট করছে নানা ঘটনায়, এই আচরণগুলো আপনি কি মনে করেন না যে আপনার বানানো চলচ্চিত্র দিয়ে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত? প্রেমে ব্যর্থ হয়ে মানুষ কীভাবে কাঁদবে তার মানস গঠন আপনি তৈরি করে দিচ্ছেন। উনি খুব অবাক হয়ে গেলেন। বললেন, ‘আরে, আমি তো এভাবে ভাবিনি।’ মানুষের আবেগে তো পার্থক্য থাকে। হাইব্রিডের মতো সব একাকার করে দিলে তো হবে না। বৈচিত্র্য থাকতে হবে। আমার বাবাকে দেখেছি, উনি জীবনে কোনো দিন কান্নাকাটি তো দূরের কথা, কথা বলার সময় একটা স্বাভাবিক স্কেল থাকে না উত্তেজিত হলে, যেটা ছাড়িয়ে যায়, ইমোশনাল হয়ে গেলে... আমার বাবা চিরদিন একই স্কেলে কথা বলেছেন। আমার পরিবারে আমার বোন যখন মারা গেছে তখন আমার বাবা কাঁদেনি। পাথর হয়ে গেছিল। সেই জিনিসটা তো একটা সিনেমাটিক ট্রিটমেন্টের মধ্যে আসবে। আমি যদি এখন এটা, কাজী হায়াতের ছবির মতো আমার মা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কাঁদতে বসে, তাহলেই কেবল সেটা সত্যি হবে তা তো না।
প্রশ্ন: আপনার ছবিতে রিচুয়াল, মিথ, ফেস্টিভিটি এগুলো অনেক গুরুত্ব নিয়ে আসে, আবেদন নিয়ে আসে। আপনি কি রিচুয়ালকে নিছক রিচুয়ালস হিসেবেই দেখেন? নাকি এর মধ্যে অন্য কিছুর খোঁজ করেন?
তারেক: মাটির ময়নায় দেখো, যখন পুঁথিতে শোনা যাচ্ছে, ইব্রাহিম তার ছেলেকে কোরবানি দেবে ইত্যাদি ইত্যাদি, এই গল্প যখন বলা হচ্ছে পুঁথির মধ্যে, দর্শক শুনছে, আর কে শুনছে? আনু শুনছে। আনু যখন শুনছে আনুর কি নিজের কথা মনে হচ্ছে না? আমি যখন শৈশবে এই পুঁথি শুনেছি তখন আমি আমাকে আবিষ্কার করেছি। আমার বাবা যেন ইব্রাহিম। আমাকে মাদ্রাসায় যে দান করেছে, আমাকে স্যাক্রিফাইস করেছে ধর্মের কারণে। ধর্মের জন্য আমাকে বলি দিয়েছে। আনুও কি এই পুঁথিতে নিজেকে আবিষ্কার করছে না? এখন দর্শক যদি আনুর মধ্যে সেই অনুরণনটা খুঁজে না পায় তো সেটা আমার হয়তো ব্যর্থতা। এটা যদি আমি জারিত করতে না পারি এই রিচুয়াল শুধু রিচুয়ালের জন্য না, ইটস নট রিচুয়াল ফর রিচুয়ালস সেক। এই যে ইব্রাহিমের আর্কিটাইপ, এই মিথ তো আমার আজকের জীবনেও যে কতটা জারি আছে, কতটা প্রাসঙ্গিক। সো, মিথ কি আসলেই মিথ্যা? মিথকে কনটেক্সুয়ালাইজ করা গেলে সত্যিটা এই সময়ের মধ্যেও পাওয়া যায়।
প্রশ্ন: আরেকটা প্রশ্ন। মানুষের কিছু ফ্যাকাল্টিকে আমরা বলি ভালো, কিছু মন্দ। ভায়োলেন্স, ক্রুয়েলটি, বীভৎসতা এগুলো নেতিবাচক ব্যাপার। যেমন অমিয়ভূষণ মজুমদার, তার ফিকশনে সেভাবে ইভিল ক্যারেক্টার আসতে পারে না। ফিল্মে যেমন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। সত্যজিৎ রায়ের শুধু অশনি সংকেত বাদ দিলে তার কাজের মধ্যে দৃষ্টিকে পীড়া দেয় এমন কিছু আসে না। আপনার ছবিতেও খুব ভায়োলেন্ট কোনো দৃশ্য, যা আমাকে পীড়া দেয় বা ইভিল কোনো ক্যারেক্টার আমরা দেখি না। এটা আসলে কী?
তারেক: ভালো-মন্দ দুটো দিকই খুব কড়াভাবে আসে ফর্মুলা সিনেমায়। আর আমরা যারা সৃজনশীল ছবি বানাতে চেষ্টা করি তাদের ফিল্মে ভায়োলেন্স যে আসে না, তা না, কিন্তু তার ট্রিটমেন্ট হয় ভিন্ন। যেমন যদি আমি আমার ছবি মাটির ময়নার কথা বলি। পুরো ছবিটা বেসিক্যালি ভায়োলেন্স নিয়ে। ছবির বিষয়বস্তুই যদি দেখি, নানাভাবে ভায়োলেন্স আছে, ওয়ার ইজ দ্য ব্যাকড্রপ। ছবির মধ্যে নানাভাবে ব্রুটালিটি আছে। একটা ব্যাপার আছে নন্দনতাত্ত্বিক, যেটা তুমি বললে, একজন নির্মাতা হয়তো ভায়োলেন্স না দেখিয়ে ভায়োলেন্ট একটা অ্যামবিয়েন্ট তৈরি করছে। এটা তার কাছে অনেক বেশি অর্থবহ যে গ্রাফিক ওয়েতে ভায়োলেন্স দেখাব না, কিন্তু আমি ক্রিয়েট এ সেন্স অব ভায়োলেন্স। মাটির ময়না ছবিতে ভায়োলেন্স মোর অ্যাসথেটিক্যালি এসেছে। এসথেটিক এ অর্থে যে, ইটস মাচ মোর ক্রিয়েটিভলি চ্যালেঞ্জিং টু শো ভায়োলেন্স উইদাউট শোয়িং ভায়োলেন্স। ইনডিপেনডেন্ট সিনেমার ক্ষেত্রে ফর্মুলা ট্রিটমেন্টের জায়গায় ইনডিভিজুয়াল টেম্পারমেন্ট কাজ করে। এখন ব্যক্তিগত জীবনে আমার আদর্শিক জায়গার থেকে বড় জায়গা হচ্ছে যে, আমি আসলে ভায়োলেন্স জিনিসটা ব্যক্তি জীবনে নিতে পারি না। আই হ্যাভ মাই ওন হিস্ট্রি আছে। সে কারণে আমি ভায়োলেন্স নিতে পারি না। অ্যাজ এ ফিল্মমেকার আমি জানি যে, যখন আমি ভায়োলেন্স দেখছি এটা আসলে ফলস, এই রক্তটা আসলে কৃত্রিম রক্ত, পুরো জিনিসটা তৈরি করা, তার পরও আমি তাকাতে পারি না। আই অ্যাম সো মাচ অ্যাফেক্টেড বাই ভায়োলেন্ট সিন। একটা ভার্চুয়াল ভায়োলেন্স, যেটা আসলে অ্যাকচুয়াল ভায়োলেন্স না, তাও আমি নিতে পারি না। অনেক সময় এমন হয়েছে, কোনো একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে, কারও ব্লিডিং হচ্ছে, আমি সেখান থেকে পালিয়ে চলে গেছি। এই যে আমার ব্যক্তিগত জিনিসটা রয়েছে, সেটাও এখানে রিলেটেড। মাটির ময়না ছবিতে অনেক ভায়োলেন্ট দৃশ্যের সুযোগ ছিল, যখন গরু জবাই দেওয়া হচ্ছে, প্রাসঙ্গিকভাবেই ওখানে স্লটারিংটা দেখানো যেতে পারত, কিন্তু ওখানে শুধু পোস্ট-স্লটারিং রক্তভেজা ছুরিটা দেখা যাচ্ছে। চড়ক খুবই ভায়োলেন্ট ব্যাপার, আমাদের ক্লোজআপ ছিল, বিশাল বড়শি দিয়ে গাঁথা চামড়া, সেটা কিন্তু আমার টেম্পারমেন্টের কারণে ওই ভায়োলেন্ট সিন আমি ব্যবহার করব না।
মাটির ময়নাঃ
Awards
Wins[2]
• 2002 Cannes Film Festival, FIPRESCI Prize in section Directors' Fortnight outside competition[3]
• 2002 International Film Festival of Marrakech, Best Screenplay Award - Tareque Masud & Catherine Masud
Nominations[2]
• 2002 International Film Festival of Marrakech, Golden Star - Tareque Masud
• 2004 Nominated, Directors Guild of Great Britain, Outstanding Directorial Achievement in Foreign Language Film - Tareque Masud
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ হঠাৎ মেহজাবীনের পিছে লাগছে কেন ?
স্বৈরচারী আওয়ামীলীগ এইবার অভিনেত্রী মেহজাবীনের পিছনে লাগছে। ৫ ই আগস্ট মেহজাবীন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন ‘স্বাধীন’। সেই স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট যুক্ত করে অভিনেত্রীকে উদ্দেশ্য করে আওয়ামী লীগ তার অফিসিয়াল ফেইসবুকে... ...বাকিটুকু পড়ুন
বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?
সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী
বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন
জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন
=বেলা যে যায় চলে=
রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।
সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন