চিরকাল যুদ্ধটা অসমই থেকে গেলো । আমার মায়ের সাথে আমার বয়সের ব্যবধান পাক্কা দুই দশক ! কি করে পারবো আমি ? তর্ক বাধলেই নিশ্চিত হার । মামণি আমার চেয়ে বয়সে বড় , জ্ঞানে বড় , অভিজ্ঞতায় বড় ।বড্ড হতাশা আর কষ্ট নিয়ে বার বার মেপে দেখতাম ছোটবেলায় , "আম্মু তো আমার চেয়ে হাতে পায়েও বড় !" কত্ত কত্ত দিন মামণি ফাকি দিয়ে আমাকে ভাত খাইয়েছে । " আর এক গ্রাস খেলেই তুমি ঊতুউউউউউউউ বড় হবে।" আর আমিও "আমার মাথা মাকে ছাড়িয়ে ছাঁদ ফুড়ে আকাশ স্পর্শ " করার মত বড় হওয়ার , লড়াই এ জিতে যাওয়ার অলৌকিক স্বপ্নে বিভোর হয়ে গোগ্রাসে গিলেছি গ্রাসের পর গ্রাস । আমাকে যে মায়ের সমান হতেই হবে !
আমার নানাভাই ছিলেন শিক্ষক। মুজতবা আলীর "পন্ডিত মশাই" এর মতন তাঁর বেতনও কোনদিন কুকুরের তিন ঠ্যাং এর চেয়ে বেশি হওয়ার সুযোগ পায়নি। ভাই বোনের আধিক্যের সংসারে টিপে টিপে পয়সা গুণে দিন চললেও মা হয়ত খারাপ ছিলেন না । একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামে এই আপাদমস্তক সৎ , গুণী , পর শ্রদ্ধেয় মানুষটি বিশাল এক অপরাধ করে ফেলেছিলেন। তার পুত্র ও কন্যাদের তিনি মুক্তিযুদ্ধে সামিল করেছিলেন, যারা যুদ্ধে যাবার মত বড় হয়েছিলো তাদের , যারা যুদ্ধে যাবার মত বড় হয়নি তাদেরকেও ।
ফলস্বরুপ তাকে ও তাঁর সাথে পাওয়া পরিবারের অন্য পুত্র সন্তানদের হত্যা করা হয় নির্মম ভাবে ।জ্বালিয়ে দেওয়া হয় বাড়িঘর। লুট হয়ে যায় রাজাকারদের হাতে ভিটেমাটিটুকুও। যুদ্ধ পরবর্তী একটি বিধ্বস্ত দেশে আয়হীন, উপায়হীন নানীমা ছোট ছোট সন্তানদের নিয়ে কি ভাবে বেঁচেছিলেন, ভাবলে শিউরে উঠি বারেবার। মাত্র ১৭ বছর বয়সে পিতাকে হারাতে কেমন লাগে ? কেমন লাগে ঘর বাড়ি হারিয়ে উদবাস্তু হতে ?
আমি কোন দিন জানবো না । আমি জানবো না অবলম্বনহীন জীবন সংগ্রামের কথা । আমি জানবো না শূন্য থেকে শুরু করার কথা । আমি জানবো না মাসের পর মাস জীবন হাতে করে পালিয়ে বেড়াতে কেমন লাগে । আমি জানবো না , প্রতি মুহুর্তে ধর্ষিতা হওয়ার আতংক কেমন। আমি জানবো না , চোখের সামনে প্রিয়তম ভাইয়ের লাশ পড়ে থাকলে মানুষ কিভাবে বেঁচে থাকে। আমি জানবো না , একজন মুক্তিযোদ্ধার কন্যা বছরের পর বছর কেন অপেক্ষা করে , বাবাকে পাওয়া যাবে । অথবা পাওয়া যাবে তাঁর কবরের সন্ধান ।
আমি হয়ত কোনদিনই পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারবো না , যেই দেশকে স্বাধীন করতে গিয়ে মামনিকে পিতার রক্তে দাম শুধতে হয়েছে, তিলে তিলে বেঁচে থাকার অসহনীয় কষ্ট পেরুতে হয়েছে সেই দেশটাকে মাত্র ৩৭ বছরের মাথায় আবার পরাধীন হতে দেখলে তাঁর কেমন লাগে। আমি হয়ত কোনদিনই লিখে বর্ননা করতে পারবো না পিতার খুনীর গাড়িতে দেশের পতাকা উড়তে দেখলে আমার মা কেমন কষ্টে , ঘৃণায় , ক্ষোভে তড়পাতে থাকেন । কোনদিনই বলে বুঝাতে পারবো না , সেই হাহাকার আর কান্নার দৃশ্য ।
তবে , একটি ব্যাপারে আমি নিশ্চিত । সময়ের নিষ্ঠুরতম পরিক্রমায় একদিন আমার বাবাও বিদায় নেবেন । যাকে শত্রুর বুলেট, পেতে রাখা ফাঁদ আর পাক সেনাদের উদ্ধত বেয়োনেট কেড়ে নিতে পারেনি , সময় নামক এক অনিবার্য শত্রুর হাত একদিন তাকে গুম করে দেবে তার কন্যার জীবন থেকে ।
রক্তহিম করা অশ্রুর উল্লাসে আমি আছি সেই দিনের অপেক্ষায় , যে দিন আমিও আমার মায়ের সমান হবো ।