ঐ দিন অবশ্য জন্মদিন ছিলো না। স্কুলে পা রাখতেই ক্লাস টু এর একটা বাচচা আমার হাতে ধরিয়ে দিলো একটা লাল গোলাপ । আমি অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, কেন? সে শুধু লাজুক হেসে বলেছিলো , "আপনাকে আমার খুব ভালো লাগে ।" ভালোবাসার এত অকপট প্রকাশ আর দেখিনি । গোলাপটা তাই অতুল মহিমায় রয়ে গেছে আমার রুপোর বাক্সে ।
সবচেয়ে প্রিয় কার্ডটা পেয়েছিলাম নাহিদের কাছ থেকে । "ম্যায়নে পেয়ার কিয়া"- ছবির সালমান -ভাগ্যবতীর রোমান্টিক ছবি আলা । বাড়ি আসতে না আসতেই খুলে বসেছি দেখার জন্য যে নাহিদ কি লিখেছে , আর অমনি আব্বু ঢুকেছে ঘরে । "উফ , এই সব কি , ছি ! " বলে বেরিয়ে গেলেন আর আমি বলার সুযোগই পেলাম না , প্রেমের মহামহিম নিদর্শনটা এসেছে একটা মেয়ের কাছ থেকে। কার্ডটা আছে এখনো , ব্রাউন পেপার ব্যাগে ।
ফারাহর সাথে গভীর বন্ধুতের মেয়াদ ২ মাস না হতেই ওরা বদলি হয়ে চলে গেলো সাভার । শুরু হলো আমার ম্যারাথন চিঠি লেখা । কিন্তু , অল কোয়ায়েট অন দা ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট ! ২ বছর পরে দেখা হতেই আমার অভিমান ভরা গালে দুটো চুমু দিয়ে ফারাহ দেখালো "প্রতি সপ্তাহে লেখা ১০৪ টা চিঠি ।" আমার বাড়ি থেকে পোস্ট অফিসটা অনেক দূরে ।মা মরা, বাপ নিরুদ্দেশ মেয়ে আমি। চাইলেই কি আর এই সব ছোট্ট খাট্ট কাজ করে দেওয়ার দাবী কারো কাছে করতে পারি ! " জল চোখে এখনো চুমু খাই পাতায় পাতায়।
নতুন ক্লাসে উঠে যাবো সবাই আর আমি ডায়রীতে সবার অনুভূতি কুড়িয়ে বেড়াচ্ছি । মাজহার অন্য স্কুলে যাওয়ার আগে লিখে দিয়ে গেলো -
" রুধির ধারা রুদ্ধ হয়ে যাবে ,
যাবে না রোধ করা তোমার হাসি মুখ ,
কখনো চেতনায় ,
কখনো স্বপনে,
আর চির জাগরনে ।"
প্রেমহীন ভালোবাসার এই কবিতাটা আমার পাওয়া সবচে' প্রিয় কবিতা !
সেই বছরই নাক লম্বা মাহবুব কি একটা লিখে ডায়রির পাতাটা স্ট্যাপলার দিয়ে আটকে দিলো । আর লিখে দিলো , আজকে থেকে ঠিক ১০ বছর পরে খুলবে , প্লিজ তার আগে যেনো দেখো না। আমি কথা রেখেছিলাম। এক দশক পরে খুলে দেখি লেখা , "ভালোবাসি , ভালোবাসি। আজকে বলবো , যদি হারিয়ে না যাও।" মাহবুব অবশ্য কথা রাখেনি । ৭ বছর আগেই পানিতে ডুবে হারিয়ে গেছিলো আমাদের সবার কাছ থেকে ।
পরিবার শুদ্ধু জাম্বিয়া চলে গেলো আনিকা । আমার সাথে চিঠিতে ভালবাসাবাসি । চিঠিতে ভরে পাঠিয়ে দিলো "ছোট্ট আর পাতলা কিউট একটা ইংরেজি এ" । আমি সেই আনবিক সাইজের লকেট এর জন্য পারোমানবিক সাইজের চেইন খুঁজে হয়রান! অত চিকন রুপার চেইন নাকি বানায় না কেউ! প্রথমবার দেশে আসার সময় আনিকা নিজেই নিয়ে এলো রুপোর কন্ঠ বন্ধনী আর বাঁধলো মিষ্টি ভালোবাসায় । বড় হয়ে সোনা পরেছি , অত সুখ পাইনি আর!
সেদিন জন্মদিন ছিলো । সবাই তো জানেই । কারন তখন আমি ক্লাসের তুখোড় ছাত্রী , খেলার মাঠের অপ্রতিরোধ্য রানী । সুতরাং ভক্ত কুলের "শুভ জন্মদিন" চিৎকারে আর উপহারে উপহারে আপ্লুত সকাল থেকেই । কোথা থেকে এসে হাজির হলো বাদল । ভীষন গোবেচারা , ভোদাই ছেলেটা লজ্জায় কাচুমাচু । জানেই না আমার আজকে জন্মদিন ! মাঠের সবাই করুনা আর তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকায় বাদলের দিকে ! কি ক্ষ্যাত রে! আর বাদল!!!!!!! সামরিক বাহিনীর কদম ছাঁটে ছাটা সারা মাঠের ঘাস তোল পাড় করে খুঁজে তুলে নিয়ে আসে কিছু ঘাস ফুল। কানের সোনার রিং খুলে ঐ ঘাস ফুল পরে ঘুরে বেড়ালাম সারাদিন । ভালোবাসাটা অতটা স্বচ্ছ ছিলো বলেই হয়ত বাদল আজও আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ।
তুমি কি বুঝলে কিছু ? টের পেলে কিসে আমি হই সবচেয়ে খুশি? কোন উপহারটা আমাকে হাসায় , কাঁদায়? জানি , তুমি ভীষন ব্যস্ত । জানি , আমার আঙুলে একটা হীরের আংটি পরানোর জেঁদ তোমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় । আমার আসা যাওয়ার পথে কোন ভালো বাস নেই।প্রতিদিন সি এন জি ড্রাইভারের কাছে অপমানিত হওয়া , রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে ঘন্টার পর ঘন্টা - তুমি একটা গাড়ি না কিনে থামবে না । বাড়িতে খুব গরম লাগে । কাজের লোক তো দুরাশা । রেনোভেট করে আধুনিক করে দিতে চাও , যাতে আমি একলাই , না না , আমরা দুজন টোনাটুনি সামলে নিতে পারি সংসারের কাজ। আর নিশ্চিন্তে ঘুমুতে পারি এ সি লাগানো ঘরে ।
কিন্তু এই যে দিন রাত , পাগলের মত টাকার পিছনে ছুটছো ! আমার সাথে কথা বলতে ভুলে যাচ্ছো। ছুঁয়ে দিতে ভুলে যাচ্ছো ।চুমু দিয়ে রাগিয়ে দিতে ভুলে যাচ্ছো । ভুলে যাচ্ছো তোয়ালে ফেলে আঁচলে হাত মুছতে ! এই যে তোমার অপেক্ষায় প্রতি সন্ধ্যায় বসে থাকছি ! তোমার সময় হচ্ছে না ৫ মিনিটের একটা ফোন করার । সময় হচ্ছে না আমার কাছে আসার । একবারও কি মনে হয়েছে ? আমার হাতের উপর সবচেয়ে দামী আর সুন্দর উপহারটা হতে পারে তোমার হাত ?