রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কিছু লেখাটা বোধহয় সবচেয়ে সহজ, সবচেয়ে আরামদায়ক আর উষ্ণ। কথাটা এজন্য বলছি যে, তাকে নিয়ে লেখা যে কোন রচনায়, যত ইচ্ছা বিশেষণ ব্যবহার করা যায়! কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক ইত্যাদি বিভিন্ন পরিচয় তো আছেই, সাথে যদি সুপণ্ডিত, চমৎকার ব্যক্তিত্বের অধিকারী, প্রজাপ্রেমী জমিদার ইত্যাদি বিশেষণে আধপাতা বা এক পাতা, চাই কি দুই পাতাও ভরিয়ে দেয়া যায়, কারও কিছু করার থাকবে না, বলার থাকবে না, মুখ বুজে পড়া ছাড়া। বাঙালি দুইটা কাজ- খুব ভালো, নিঃসন্দেহে পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের মানুষের চেয়ে হাজার গুণে ভালো, করতে পারে। একটা প্রশংসা, আরেকটা প্রশংসার বিপরীত নিন্দা(কুৎসা)। রবীন্দ্রনাথের প্রশংসা যেহেতু প্রাণখুলে করা যায়, নিন্দাও করে অনেকে সমপরিমাণে, তাই রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখার অভাব নেই।
তাই আমিও লিখতে বসেছি, সাহস করে। যদি খুব খারাপও লিখি, তাতেও কিছু আসবে যাবে না। এতো লেখার ভিড়ে জায়গা কৈ! অবশ্য আমার লেখাটা ঠিক রবি ঠাকুরকে নিয়ে নয়।
যাই হোক, কথায় কথা বাড়ে, তাই বলছি ছোট্ট করে, বলতে চাইছি লোকসাহিত্য নিয়ে। স্পেসিফিকালি বলতে গেলে, বলতে হয়, “বলতে চাইছি, ছেলেভুলোনো ছড়া নিয়ে”! রবি ঠাকুর “লোকসাহিত্য”-এ একস্থানে লিখেছেন- “আমাদের অলংকারশাস্ত্রে নয়া রসের উল্লেখ আছে, কিন্তু ছেলেভুলোনো ছড়ার মধ্যে যে রসটি পাওয়া যায়, তাহা শাস্ত্রোক্ত কোন রসের অন্তর্গত নহে। সদ্যঃকর্ষণে মাটি হইতে যে সৌরভটি বাহির হয়, অথবা শিশুর নবনীতকোমল দেহের যে স্নেহদবেলকর গন্ধ, তাহাকে পুষ্প চন্দন গোলাপজল আতর বা ধূপের সুগন্ধের সহিত এক শ্রেণিতে ভুক্ত করা যায় না। সমস্ত সুগন্ধের অপেক্ষা যেমন তাহার মধ্যে যেমন একটি আদিম সৌকুমার্য আছে; সেই মাধুর্যটিকে বাল্যরস নাম দেয়া যাইতে পারে। তাহা তীব্র নহে, গাঢ় নহে, তাহা অত্যন্ত স্নিগ্ধ সরস এবং যুক্তিসংগতিহীন।
শুধু মাত্র এই রসের দ্বারা আকৃষ্ট হইয়াই আমি বাংলাদেশের ছড়া সংগ্রহে প্রবৃত্ত হইয়াছিলাম। রুচিভেদবশত সে রস সকলের প্রীতিকর না হইতে পারে, কিন্তু এই ছড়াগুলি স্থায়ীভাবে সংগ্রহ করিয়া রাখা কর্তব্য, সে বিষয়ে বোধ করি কাহারও মতান্তর হইতে পারে না। কারণ, ইহা আমাদের জাতীয় সম্পত্তি।”
সোজা ভাষায়, ছেলেভুলনো ছড়া ইউনিক। মায়ের ভালোবাসার মতোই। আমার মা আমাকে যেভাবে ছোটবেলায় নানা কথায় ভুলিয়ে ঘুম পারিয়েছেন, খাইয়েছেন, কখনও বা শাসন করেছেন সেভাবেই করেছেন গোপালের মাও। মা আমাকে প্রতিবার খাইয়ে দেয়ার সময় গল্প বলতেন। এক গল্পই কতোবার বলতেন, কতোভাবে, কতো রঙ-মশলা চড়িয়ে!
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার এটাই যে, এসব ছড়া রচিত হয়েছে মায়েদের দ্বারাই। তারা হাজার বছর ধরে মুখেমুখে রচনা করেছেন এসব। এই মুখ থেকে অন্য মুখ- এভাবেই ছড়িয়ে পড়েছে-শব্দ পাল্টে গেছে, অনেকসময় পাল্টে গেছে মূল ছড়াটাই। অথচ পড়লে মনে হয়, শুনলে মনে হয়, সব যেন একজনেরই রচনা! এটাই এই ছড়ার মৌলিকতা। আসলে নিষ্পাপ, অসহায় সন্তানের প্রতি ভালবাসাটা সব মায়েরই একই সুরে গাঁথা, তাই ছড়াগুলোও মৌলিক।
রবি ঠাকুর সংগ্রহ করেছেন এমন প্রায় ৮১ টা ছেলেভুলোনো ছড়া। তার মধ্য থেকে কয়েকটা তুলে দিচ্ছি-
১
কে মেরেছে কে ধরেছে সোনার গতরে।
আধকাঠা চাল দেব গালের ভিতরে।।
কে মেরেছে কে ধরেছে কে দিয়েছে গাল।
তার সঙ্গে গোসা করে ভাত খাও নি কাল।।
কে মেরেছে কে ধরেছে কে দিয়েছে গাল।।
তার সঙ্গে কোঁদল করে আসব আমি কাল।।
মারি নাইকো ধরি নাইকো বলি নাইকো দূর।
সবেমাত্র বলেছি গোপাল, চরাও গে বাছুর।।
২
পুটু নাচে কোনখানে।
শতদলের মাঝখানে।
সেখানে পুটু কী করে।
চুল ঝারে আর ফুল পাড়ে।
ডুব দিয়ে দিয়ে মাছ ধরে।
৩
ওরে আমার ধন ছেলে
পথে বসে বসে কানছিলে।।
মা ব’লে ব’লে ডাক্ছিলে।
ধুলো-কাদা কত মাক্ছিলে।।
সে যদি তোমার মা হত।
ধুলোকাদা ঝেড়ে কোলে নিত।।
৪
খোকা যাবে রথে চড়ে, ব্যাঙ হবে সারথি।
মাটির পুতুল নটর্-পটর্, পিঁপড়ে ধরে ছাতি।
ছাতির উপর কোম্পানি কোন্ সাহেবের ধন তুমি।
৫
কিসের লাগি কাঁদ খোকা কিসের লাগি কাঁদ।
কিবা আমার নেই ঘরে।
আমি সোনার বাঁশি বাঁধিয়ে দেব-
মুক্তা থরে থরে।
৬
খোকা খোকা ডাক পাড়ি
খোকা বলে, শাক তুলি।।
মরুক মরুক শাক্ তোলা-
খোকা খাবে দুধ কলা।।
৭
খোকা যাবে নায়ে লাল জুতুয়া পায়ে।
পাঁচশো টাকার মখমলি খান
সোনার চাদর গায়ে।।
তোমরা কে বলিবে কালো।।
পাটনা থেকে হলুন এনে
গা করে দিব আলো।।
৮
খোকা ঘুমালে দিব দান
পাব ফুলের ডালি।
কোন ঘাটে ফুল তুলেছে
ওরে বনমালী।
চাঁদমুখেতে রোদ লেগেছে
তুলে ধরো ডালি।।
খোকা আমাদের ধন
বাড়িতে নটের বন।
বাহির-বাড়ি ঘর করেছি
সোনার সিংহাসন।।
৯
খোকামণির বিয়ে দেব হাটমালার দেশে
তাই গাই বলদে চষে।।
তারা হীরেয় দাঁত ঘষে।
রুইমাছ পালঙের শাক ভারে ভারে আসে।
খোকার দিদি কনায় বসে বাছে
কেউ দুইটি চাইতে গেলে বলে আর কি আছে।।
১০
খোকা যাবে মাছ ধরতে ক্ষীরনদীর কূলে।
ছিপ নিয়ে গেল কোলা ব্যাঙে, মাছ নিয়ে গেল চিলে।।
খোকা বলে পাখিটি কোন বিলে চরে।
খোকা বলে ডাক দিলে উড়ে এসে পড়ে।।
****
উপরের ছড়াগুলো সামান্য মনোযোগ দিয়ে পড়লেই বুঝতে পারা যায়, এসবের ঠিক নির্দিষ্ট কোন অর্থ নেই। শিশুর ভাবনার মতো- ছন্নছাড়া, নিষ্পাপ, আনন্দমুখর। আসলে এই পিচ্চিদের সাথে কিছুক্ষণ সময় কাটালেই আমরা ওদের মতো হয়ে যাই অনেকটা। ওর হাসিটাই তখন মুখ্য হয়ে পড়ে, ওর আনন্দ ছাড়া বাকীসব মূল্যহীন, গৌণ। মায়েদের চিন্তাটাও তাই হয়ে যায় ঐ শিশুর মতোই। তারই প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই এসব ছড়ায়।
১০ নম্বর ছড়াটায় দেখা যায়, খোকাবাবু ক্ষীরনদীর কূলে মাছ ধরতে গেছেন। ক্ষীরনদীর কূলে খোকাবাবু মাছ ধরতে গিয়ে কী সংকটেই পড়েছিল তা কি তুলি দিয়ে না আঁকলে মনের ক্ষোভ মেটে? অবশ্য ক্ষীরনদীর জিওগ্রাফী খোকাবাবু আমাদের চেয়ে অনেক ভালো জানেন, সন্দেহ নেই। কিন্তু যে নদীতেই হোক, তিনি যে প্রাজ্ঞোচিত ধৈর্য অবলম্বন করে, পরম গম্ভীরভাবে, নিজ দেহের প্রায় চারগুণ এক ছিপ ফেলে মাছ ধরতে বসেছেন, সেটাই যথেষ্ট কৌতুকাবহ। তার উপর যখন জল থেকে ড্যাবা ড্যাবা চোখ মেলে একটা কালো মতন উৎকট কোলা ব্যাঙ খোকার ছিপ নিয়ে টান মেরেছে, অন্যদিকে ডাঙ্গা থেকে চিল এসে মাছ ছোঁ মেরে নিয়ে চলে যাচ্ছে, তখন তার বিস্মিত মুখের ভাব- একবার প্রাণপণ শক্তিতে ছিপ নিয়ে টানছে তো আরেকবার সেই চিলের প্রতি হাত পা ছুঁড়ছে- এই চিত্র সবার দ্বারা তুলে ধরা সম্ভব? [এই অংশটুকু সাধু থেকে চলিত’তে রূপান্তর ও সামান্য পরিবর্তন করেছি, রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ হতে]
৯ নম্বরটাতে দেখতে পারছি আমরা, খোকাকে হাটমালার দেশে বিয়ে দেয়া হবে। যদিও আমরা মানচিত্র এফোঁড়ওফোঁড় করেও হাটমালার সঠিক অবস্থান আবিষ্কার করতে পারি না। কিন্তু এই অজ্ঞাতকুলশীল হাটমালার মাতালকরা বর্ণনা পাই আমরা ছড়াটায়, এমন বর্ণনা যে শুনলে এখনকার অ্যামেরিকার লোকজনও লজ্জা পাবে, আধুনিক কলম্বাস হয়তো জাহাজ নিয়ে বেড়িয়ে পড়বে সেই দেশের সন্ধানে! সেখানকার মানুষ হীরে দিয়ে দাঁত ঘষে-কম কথা? রুইমাছ পালঙ শাক অঢেল। আর সেই শাক বাছতে আছে খোকার দিদি। খোকার দিদি আবার এমন কেপ্পন যে, এতো ভুঁড়ি ভুঁড়ি থাকা পরও কেউ চাইতে এলে বলে, “আর কি আছে!”
ভাবুন তো একবার চিত্রটা! এই চিত্র কি ছন্দজানা পণ্ডিত ছড়াকারের পক্ষে আঁকা সম্ভব, ছড়ায়?
আজকাল অবশ্য মায়েরা আর শিশুদের ছড়া শোনায় না, বলে না গল্পও। “চায়ের কাপটা হয়ে যাবে শিম্পাঞ্জী, তোমার টিভির পর্দায়/ ডিজিটাল ইঁদুর নাচতে নাচতে নামতা পড়তে শেখায়”! তাই কি আমরা এমন মেধাহীন গাধা আর নিষ্প্রাণ জাতিতে পরিণত হচ্ছি? থাক, আর এ নিয়ে লিখতে ইচ্ছে করছে না।
তবুও এই ছড়াগুলো গুরুত্বপূর্ণ। মুখেমুখে রচিত এই ছড়াগুলোই আমাদের সময়ের কথা বলে। জানিয়ে দেয় আমাদের সেই সময়ের সামাজিক অবস্থা, দুঃখ-দুর্দশা, ভালোবাসা, স্নেহ-মায়া, আশা আকাঙ্ক্ষা- অনেককিছুই। তাই এগুলো সংরক্ষণ করাটা জরুরী। রবীন্দ্রনাথ কিছু সংগ্রহ করেছিলেন, আরও রয়ে গেছে অনেক। সেগুলো সংগৃহীত হয়েছে কিনা, জানা নেই আমার।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও রচিত হয়েছে এমন কিছু ছড়া। যেমন-
“নুনও মঙ্গা ত্যালও মঙ্গা
আরো মঙ্গা শলাই
শেখ মজিবরক ভোট দিয়া
ইন্ডিয়া পালাই।
হারিকেনবাগে দউরা দউরি
নৌকা পাইলে ভোট
শেখ মজিবরের টাকা খাইলে
ক্যাশরগঙ্গের লোক।।
২
উঠরে শালি টোপলা বান
হামরা যামো হিন্দুস্থান।।
এসব আমার দাদীর কাছ থেকে শোনা। এমন হাজারও ছড়া হয়তো ছড়িয়ে ছটিয়ে আছে দেশের গ্রামগুলোয়। সেসব সংগ্রহ করার মতো কেউ আছেন কি?
১১/০৪/২০১৬
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই এপ্রিল, ২০১৬ সকাল ১১:৫৮