প্রথমেই একটা চুটকি দিয়ে শুরু করি। এটা বোধহয় সমকালে প্রকাশিত, কিংবা রসালোতে। আমি ফেবুতে পড়েছি।
এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করছে-
“দোস্ত, ভ্যালেন্টাইন ডে কী?”
বন্ধুটি উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো, “আগে বল তোর গার্লফ্রেন্ড আছে?”
“না নাই। বয়ফ্রেন্ডও নাই!”
“তাইলে ভ্যালেন্টাইন ডে কিছু না। ওটা একটা সাধারণ রবিবার!”
এই হলো কাহিনী। ভ্যালেন্টাইন ডে হল শুধু প্রেমিক, প্রেমিকাদের জন্য।
গুরু বলেছেন, “কাপুরুষেরা জীবনে একটাই মাত্র প্রেম করে আর প্রেমিকাকেই বিয়ে করে; সাধারণ পুরুষেরা দুই তিনটা প্রেম করে বাবা মায়ের পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করে বাচ্চা জন্ম দিয়ে মরে আর মহাপুরুষেরা ছ্যাকা খেয়ে কয়েকদিন কান্নাকাটি করে আরেকটা খুঁজে; এবং খুঁজে না পেয়ে দাঁড়ি রেখে ভাব নেয়”।
আপনি যদি আমার মতো মহাপুরুষ হন, অর্থাৎ সিঙ্গেল থাকেন তাইলে ঐদিন আপনার কাথা গায়ে দিয়ে, নাকে তুল দিয়ে ঘুমানো উচিৎ (আমার লেখা কোন পাঠিকা পড়ছেন যদি, একটু নড়েচড়ে বসুন। আপনি কোন দুই বাচ্চার জনক, চল্লিশোর্ধ্ব ব্লগারের পোস্ট পড়ছেন না। পোস্টদাতা পুরাই সিঙ্গাল এবং তার বুকে ‘এক-সিন্ধু’ ভালবাসা। সেখান থেকে কিছু পরিমাণ আপনাকে দিতে তার কোন প্রবলেম নাই! ) ফেসবুকে পারতপক্ষে যাওয়ার দরকার নেই। সবাই নিজ নিজ জিএফের সাথে মাস্তি করবে আর আপনি ওদের লুতুপুতু স্ট্যাটাসে লাইক দিবেন, ওদের সেলফি দেখে জ্বলবেন, তার কোন দরকার আছে কি?
কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!
কথা হলো, কথা তা না। আমি বলতে চাচ্ছি, চুমু নিয়ে। প্রকাশ্যে চুমু খাওয়ার একটা ইভেন্ট খোলা হয়েছে। এর পক্ষে বিপক্ষে অনেকে অনেক কথা বলছে। বিপক্ষেই বেশি। কারণ বেশির ভাগেরই জিএফ নাই। আপনার সংস্কৃতি, টংস্কৃতি ফেলেন। ওদের চুমু খাওয়ার কেউ নেই বলেই বিরোধিতা!
বাঙালি জাতিটাই এমন। প্রথমে কিছুই মেনে নিতে চায় না। প্রথম যখন বিদ্যাসাগর শিক্ষা প্রসারের জন্য গ্রামে গ্রামে গিয়ে স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে লেগে গেলেন, তখন কিছু লোক বলেছিল, “সাহেবদের টাকা খেয়ে আমাদেরও পৌনেসাহেব বানাইতে আসছে”! আর এখন দেখুন- গলিতে গলিতে স্কুল! যখন বিদ্যাসাগর হিন্দু সমাজে বিধবা বিবাহ চালু করতে গেলেন, তখন দুই শ্রেণির লোক তার বিরুদ্ধে গিয়েছিল। একটা পুরুত-ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়, আরেকটা লুল সম্প্রদায়। (এটা আমার গবেষণা!) পুরুতফুড়ুৎ বিপক্ষে গিয়েছিল কারণ প্রগতির বিপক্ষে যাওয়াই তাদের কাজ, না গেলে তাদের পেটের ভাত জোটে না এবং জুটলেও হজম হয় না। আর যারা ঐ বিধবাদের ভোগ করতো মুফতে, তারা গিয়েছিল বিপক্ষে। কিছু শিক্ষিত তরুণও বাঁধা দিয়েছিল কারণ ওরা পুরুতটাইপ।
আজ যারা এই প্রকাশ্যে চুমু খাওয়ার বিপক্ষে বলছে, তাদের প্রধান যুক্তি হলো- এটা আমাদের সংস্কৃতি না, পাশ্চাত্য সংস্কৃতি। এটা আমাদের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। ইত্যাদি ইত্যাদি।
মানলাম। অবশ্যই পাশ্চাত্য সংস্কৃতি। কিন্তু মামা, মধ্যপ্রাচ্যের হিজাব আমদানি করা যায়, পাকিস্তানের থ্রি-পিস আমদানি করা যায়, পাজামার নিচে আন্ডারওয়ার পড়া যায় অথচ প্রকাশ্যে চুমু খাওয়া যায় না?
আপনি যদি বাংলা সংস্কৃতির ধব্জাধারী হন, তাহলে, আপনার মা, বোন, বৌকে বলুন শাড়ির সাথে যেন ব্লাউজ না পড়ে, ওটা বাঙালি সংস্কৃতি না। আগে বাঙালি নারী ব্লাউজ ছাড়াই শাড়ি পড়ত। ওটার আমদানি করে ঠাকুর পরিবার।
আপনি সাধারণ বাঙালি। আপনি-
“চারটি করে অন্ন খেয়ো,
দুপুরবেলা আপিস যেয়ো,
তাহার পরে টকশো ধেয়ো,
বাক্যানল জ্বালি-
কাঁদিয়া লয়ে দেশের দুখে
সন্ধেবেলা বাসায় ঢুকে
শালীর সাথে হাস্যমুখে
করিয়ো চতুরালি” (দেশের উন্নতি/ রবীন্দ্রনাথ। সামান্য পরিবর্তিত)
কিন্তু আপনি তো সংস্কৃতি না মেনে সন্ধেবেলা অপিস থেকে ফিরে শালীর সাথে সুখ দুঃখের আলাপ না করে ফেসবুকে পরজিএফ আর পরস্ত্রীর ফেস আর বুক দেখছেন, তাদের রিকু পাঠাচ্ছেন, চ্যাটিং করছেন (আস্তাগফিরুল্লাহ!)। এটাও বাংলা সংস্কৃতি নাহ।
আর মধ্যপ্রাচ্য থেকে গোটাল একটা লাইফস্টাইল ধার করে আনা গেল অথচ ‘চুমু’র বেলা ‘পাশ্চাত্য পাশ্চাত্য’ বলে নিজের পশ্চাৎ চাপড়াচ্ছেন! আসলে বাঙালির পুটু খুব সস্তা আর সবচেয়ে বড়ো ব্যাপার এদের সব ধরনের অনুভূতি পুটুতে থাকে। যখন তখন যে সে এসে পুটু মেরে দেয়। কিন্তু বাংলা সংস্কৃতি তো আর ধার্মানুভূতির মতো সস্তা না যে পুটুতে থাকবে। সেই যে পাল রাজাদের পর থেকে শুরু, পাকিস্তানে শেষ, বারেবারে এসেছে বিদেশী শাসক, বিদেশী সংস্কৃতি কিন্তু বাংলা টিকে ছিল, টিকে ছিল সংস্কৃতি। আর আজ স্বাধীন দেশে কীসের ভয়? এতো সস্তা আমাদের সংস্কৃতি?
আর প্রকাশ্যে চুমু খাওয়াটাকে যারা অশ্লীল বলছে, তারাই (কিংবা তাদের মতই কেউ) কিছুদিন আগে, তরুণ তরুণীর হাত ধরে হেঁটে যাওয়াটাকে ট্যাবু মনে করতো, ওটাই নাকি এমন অশ্লীল ছিল যে দেখেই ওদের ইয়ে হয়ে যেত! তখন হাত ধরাধরি দেখে ইয়ে হয়ে যেত, এখন চুমু খাওয়া দেখে হবে- একই ব্যাপার। একমাত্র পার্থক্যটা হলো, তখন কলিকাতা হারবাল ছিল না বোধহয়, এখন আছে। তখন তারা এ সমস্যায় ভুগেছে কিন্তু সমাধান পায়নি। কিন্তু আপনি লাকি, আপনার সমাধান আছে। এক ফাইলই যথেষ্ট!
সুতরাং, আপনার সমস্যা থাকলে চুপ করে থাকুন। বাঁধা দেবেন না।
অবশ্য পুলিশি পাহারায় না করাটাই সবচেয়ে ভাল হবে। ঐ ব্যাটারা ইয়াবা, গাঁজা, ফেনসিডিল থেকে শুরু করে সবকিছুরই ভাগ চায়। আপনি জিএফের ঠোঁটে নতুন জীবনের শক্তি খুঁজে নিচ্ছেন, এদিকে দুইতিন মিনিট পর পুলিশ এসে বলছে, “ব্যাটা, ভাগ দে!” কী করবেন তখন?
শেষ করার আগে কবি কালপুরুষ কাফকার একটা কবিতা শেয়ার করছি, (তার অনুমতি না নিয়েই), পড়ে ভাগেন-
“চুমু খাওয়ার জন্য দেয়ালের ঈশ্বরকে সরানোর
প্রয়োজন নেই
এমনকি যদি সে হয় বিশ্বস্ত বন্ধুর প্রেমিকা—
চুমু খাও তাকেই
ঠোঁট, কপাল, চিবুক হলে ভালো
কিংবা দেয়া যেতে পারে বুকে;
যদি জানালায় ঢোকে চাঁদের আলো
যদি সে কেঁদে ওঠে দুখে—
সান্ত্বনা দেবে? কী প্রয়োজন? গোল্ড লিফ দাও মুখে;
তাকে কাঁদতে দাও। সে কাঁদুক মহাসুখে”
হ্যাপি কিসিং!
সংযুক্তিঃ- অনেকেই বলছে, “তোমার বাবার সামনে, মা-বোনের সামনে চুমু খেতে পারবে?
সমস্যা কী জানেন? আমরা ভাবছি, “ও কী ভাববে, সে কী ভাববে, বাবা কী ভাববে” ইত্যাদি।
বাবার কথা বললেন। হ্যাঁ, ভাই আমার বাবা আমার প্রকাশ্যে চুমু দেখার জন্য প্রস্তুত নন। কিন্তু তাকে প্রস্তুত করতে হবে। বোঝাতে হবে, এর মধ্যে পাপের কিছু থাকতে পারে কিন্তু অশ্লীল কিছু নেই। আর তাছাড়া তিনি প্রস্তুত নন বলে আমি পিছিয়ে যাবো কেন?
আচ্ছা, ব্যান্ডের গানগুলির কথা ভেবে দেখুন। এখন অ্যাশেজের গান না শুনলে আমার রাতের ঘুম হয় না ভালভাবে, মনে হয় কিছু একটা মিস করে যাচ্ছি। কিন্তু আমার বাবা এটাকে কোন চোখে দেখে? তার কাছে এগুলো চিৎকার ছাড়া কিছুই নয়। তার মতে, আইয়ুব বাচ্চু থেকে শুরু করে জুনায়েদ ইভান পর্যন্ত সবাই শুধু চিৎকার করেই যায়, আর শ্রোতারা মিউজিক শুনেই লাফায়!
অথচ আমরা যারা নিয়মিত বিভিন্ন ব্যান্ডের গান শুনছি, তারা জানি, আমাদের এই নাগরিক জীবনকে তুলে ধরতে শুধু তারাই পেরেছে। আমার বাবা অ্যাশেজ শোনে না বলে কিন্তু আমি তাদের গান শোনা ছেড়ে দেইনি।
বাবার কান তৈরি হয়েছে কুমার বিশ্বজিৎ এর গান শোনার জন্য। তিনি তাকেই সেরা গায়ক মনে করেন, স্বাভাবিক।
চুমুর ব্যাপারটাও এমন। বাবার আমলে ছিল না এর প্রচলন। তখন হয়তো কারও হাত ধরে হাঁটা, দাঁড়িয়ে দুই মিনিট কথা বলা ইত্যাদিই ছিল বিশাল ব্যাপার, হয়তো ট্যাবু। তখন নিশ্চয়ই আপনার মতো কেউ বলেছে, “তুই তোর প্রেমিকাকে নিয়ে তোর বাবার সামনে হাতধরে হেঁটে যেতে পারবি? তোর বাবা কি এটা দেখার জন্য প্রস্তুত?”
কিন্তু আজ দেখুন! আজ শুধু হাত ধরে কেন, কেই যদি কোমর ধরেও হেঁটে যায় আমরা ভ্রূক্ষেপ করি না। কারণ, আমরা মানিয়ে নিয়েছি, সমাজ মেনে নিয়েছে, সেটা আর ট্যাবু না। সেদিন যদি আপনার কিংবা আপনার মতো কারও কথা শুনে ওরা পিছিয়ে যেত তবে আজ চুমু খাওয়ার বদলে “পুলিশি পাহারায় হাত ধরে হাঁটি” টাইপ ইভেন্ট আয়োজন করতে হতো।
প্রথম প্রথম কিছু এলে সবার চোখে লাগে, কিন্তু আস্তে আস্তে সহ্য হয়ে যায়।
আরেকটা কথা, অনেকে বলছে, এটা বাড়াবাড়ি। আরে, এটাই সময় উচ্ছ্বাসের। এ সময় কেউ যদি একটু বাড়াবাড়ি করেই, সেটা কি খুব ভুল? সমাজকে প্রতি নতুন প্রজন্মই ভাঙে। আমাদের আগেরটাও ভেঙেছে, আমরা ভাঙছি, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মও ভাঙবে। হয়তো দেখা যাবে, পরবর্তী প্রজন্মের অগ্রগতিকে আমিই বাঁধা দিচ্ছি কারণ আমি তখন বৃদ্ধ হয়ে যাব মনে ও মননে। আর বৃদ্ধরাই এই ধরনের উচ্ছ্বাসকে বাঁধা দেয়।
অকালে বৃদ্ধ হবেন না।
হ্যাপি কিসিং
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১১:০৮