বিশ্বের সবচেয়ে ধনী মানুষ কে, জানেন?
সবচেয়ে ধনী মডেল?
সবচেয়ে ধনী অভিনেতা?
সবচেয়ে ধনী ফুটবলার?
সবচেয়ে ধনী ক্রিকেটার?
সব নিশ্চয়ই আপনাদের ঠোঁটের আগায়..!!
বিশ্বের সবচেয়ে ধনী রাষ্ট্রনায়ক কে জানেন? সবচেয়ে ধনী শেখ? সবচেয়ে ধনী প্রধানমন্ত্রী, সবচেয়ে ধনী প্রেসিডেন্ট?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর চট করে দেয়া সহজ নয়। উত্তর যে সঠিক হবে সেটাও হলফ করে বলতে পারবেন না, কারণ রাষ্ট্রপ্রধানদের টাকা দেখা যায়না, তারা সেগুলো গোপনে লুকিয়ে রাখেন সুইস ব্যাংকের অতি গোপন ভল্টে কিংবা পাচার করে দেন বিভিন্ন দেশে। তাঁরা যাপন করেন বিলাসী জীবন, তাঁদের লাগে লক্ষ দেহরক্ষীর প্রটোকল, তাঁরা চলেন বিশেষ রাষ্ট্রীয় বিমানে, তাঁদের ভোগবিলাস আর জীবনযাত্রা সারা পৃথিবীর মানুষের কেীতুহলের বিষয়। তাঁদের লাগে বিলাসবহুল দ্বীপ, ইয়ট আর সাততারা হোটেলের আতিথেয়তা। রক্ষক হয়েও তাঁরা ভক্ষক। মানুষ তাদের ঘৃণা করে সন্তর্পণে।আচ্ছা, বিশ্বের সবচেয়ে গরীব প্রেসিডেন্ট কে জানেন?
এই প্রশ্নের কিন্তু মাত্র একটাই উত্তর আছে। বিশ্বাস না হলো গুগলে গিয়ে সার্চ দিন, পুওরেস্ট প্রেসিডেন্ট। একটাই উত্তর দেবে গুগল, হোসে মুজিকা, উরুগুয়ের সদ্য সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, ৫ বছর প্রেসিডেন্টের আসনে থাকার পরও ভদ্রলোকের সম্পদ বলতে ২৮ বছরের পুরাতন ২০০০ ডলার মূল্যমানের একটি গাড়ি আর তিনপেয়ে একটি কুকুর, ব্যস এতটুকুই!! অসম্ভব সাদাসিধে জীবনযাপন, নির্লোভ ব্যক্তিত্ব, আর জনকল্যাণমূলক শাসন-এই তিনের মিশেল তাঁকে বসিয়েছে কিংবদন্তীর কাতারে। তাঁর সম্পর্কে কিছু কথা আপনাদের জানাবার লোভ সামলাতে পারছি না:
১. তিনি প্রেসিডেন্ট হয়েও কোনদিন প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে বসবাস করেন নি। মন্টেভিডিওর অদূরে একটি এক কামরার এপার্টমেন্টে স্ত্রী আর ম্যানুয়েলা নামের তিনপেয়ে কুকুরকে নিয়ে তাঁর বসবাস।
২. তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রাপ্য মাসিক ১২,৫০০ ডলার বেতনের মাত্র ১০ শতাংশ অর্থাৎ ১,২৫০ ডলার নিতেন, বাকিটা দান করে দিতেন। তিনি বলতেন, এর চেয়েও কম টাকায় উরুগুয়ের অনেক মানুষের জীবন চলে, আমার তো বেশ চলে যাচ্ছে।
৩. তাঁর কোন ব্যাংক হিসাব নেই, নেই কোন ঋণও।
৪. নিজেকে কৃষক হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন তিনি। তিনি এবং তাঁর স্ত্রী এখনও জীবনযাপন করেন ক্রিস্যানথিমাম ফুল চাষ করে।
৫. তাঁর গাড়িটি এক আরব শেখ কিনে নিতে চেয়েছেন এক মিলিয়ন ডলারে, সেটি তিনি বিক্রি করতে আগ্রহী, তবে বিক্রয়লব্ধ পুরো অর্থটাই তিনি ব্যয় করতে চান মানবসেবায়।
৬. যখন তাঁকে বলা হলো, তিনি বিশ্বের সবচেয়ে গরীব প্রেসিডেন্ট, তখন তিনি সহাস্যে বললেন, গরীব তিনি নন, গরীব হলো তারা যাদের আরো চাই।
৭. তিনি নিজের গাড়ী নিজে চালান, বিমানে চড়েন ইকোনমি ক্লাসে।
তিনি কেমন প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তিনি কি উরুগুয়েকে এগিয়ে নিতে পেরেছেন? আসুন উত্তর জানি এইসব প্রশ্নের।
১. তাঁর শাসনামলে তিনি উরুগুয়ের অর্থনীতিকে শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেন।
২. তিনি উরুগুয়েতে গাঁজা সেবন বৈধ করেন। এ ব্যাপারে তাঁর বক্তব্য শুনুন, আমি গাঁজাকে ঘৃণা করি, কিন্তু আমি জানি, উরুগুয়েতে অন্তত দেড় লাখ মানুষ গাঁজা সেবন করেন, আমি তাদেরকে মাদক পাচারকারীদের হাতে ছেড়ে দিতে পারিনা!
৩. তিনি উরুগুয়েতে সমলিঙ্গের বিবাহ, গর্ভপাত এগুলোও বৈধ করেন। যদিও তাঁর এ পদক্ষেপ সমালোচিত হয়, এর সুফল পেতে শুরু করেছে উরুগুয়ে।
৪. তিনি বিশ্বনেতাদের উদ্বুদ্ধ করেন মানবিকতা এবং বিশ্বায়নের উপর জোর দেয়ার জন্য। তিনি মানবিক সম্পর্ক, ভালবাস, বন্ধুত্ব, সেীহার্দ্য আর পরিবারের শক্তির ওপর ভিত্তি করে নতুন পৃথিবী গড়ে তোলার ওপর জোর দেন।
৫. ২০১৫ সালের ০১ মার্চ তিনি প্রেসিডেন্টের অফিস ছেড়ে যান, তখন বিবিসি লিখেছিলো, উরুগুয়ের অর্থনীতি তিনি রেখে যাচ্ছেন স্বাস্থ্যবান আর স্থিতিশীল অবস্থায়, লাতিন আমেরিকার অন্য অর্থনীতিগুলো যার ধারেকাছেও নাই।
৬. উরুগুয়ের মানুষ তাঁকে আদর করে ডাকে ’পেপে’। তিনি ছিলেন জনমানুষের প্রেসিডেন্ট, মানুষের মঙ্গলই ছিলো তাঁর ধ্যানজ্ঞান।
৭. তিনি ভোগবিলাস কমানোর পক্ষপাতী। এত ছোট পৃথিবী এত মানুষের বিলাসবহুল জীবনযাপনের উপযোগী কিনা, সে প্রশ্ন তিনি তুলতেন প্রায়ই।আর তাঁর অভিযোগ ছিলো যুদ্ধ আর সমরাস্ত্রের ব্যয়ের বিপক্ষে। এই খাতের ব্যয়গুলোকে মানুষের কল্যাণের খাতে স্থানান্তরের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি বিশ্বনেতাদের।
আসুন, প্রেসিডেন্ট মুজিকা’র ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে জানি, তিনি কিভাবে এতদূর এলেন, তাও জানি।
১. তাঁর জন্ম ১৯৩৫ সালে। এক সাধারণ গরীব পরিবারে। তিনি বিয়ে করেছেন ২০০৫ সালে, লুসিয়া টোপোলানাস্কি, তাঁর দীর্ঘদিনের প্রেমিকাকে।
২. তিনি প্রেসিডেন্ট ছিলেন ০১মার্চ ২০১০ থেকে ১মার্চ ২০১৫ পর্যন্ত। তার আগে ০১মার্চ ২০০৫ থেকে ০৩ মার্চ ২০০৮ পর্যন্ত তিনি ছিলেন প্রানীসম্পদ, কৃষি ও মৎস্য মন্ত্রী।
৩. প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন একজন টুপামারো গেরিলা। যারা ধনীর সম্পদ লুন্ঠন করে গরীবের মাঝে বন্টন করতো। টুপামারো আন্দোলনের একজন স্থপতিও তিনি।
৪. তিনি ৬বার পুলিশের হাতে গুলিবিদ্ধ হন। এর মধ্যে ১৯৭২ সালে তো প্রায় মরেই গিয়েছিলেন, কোনমতে বেচে যা্ন।
৫. তিনি প্রায় ১৫ বছর জেল খাটেন। এর মধ্যে বেশীরভাগ সময়ই তাঁকে কাটাতে হয় নির্জন সেলে কিংবা অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। তিনি জেল থেকে পালানও অনেকবার।
৬. ১৯৮৫ সালে উরুগুয়েতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর তিনি জেল থেকে মুক্তি পান। যোগ দেন বাম রাজনীতিতে। ১৯৯৪ সালে তিনি সিনেটর নির্বাচিত হন, ২০০৫ সালে মন্ত্রী আর ২০১০ এ প্রেসিডেন্ট। ২০১০ এর নির্বাচনে পূর্বতন প্রেসিডেন্ট তাঁকে দলীয় মনোনয়ন দেননি। দলের নেতানেত্রীদের প্রাণের দাবির মুখে তাঁকে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী করা হয়।
৭. দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতাই করেননি। অবসর নিয়েছেন প্রেসিডেন্টের পদ থেকে, তবে তিনি অবসরে বিশ্বাস করেন না, কাজ করে যেতে চান ভালবাসার শক্তি নিয়ে। তিনি জানেন, প্রতিদিন তিনি একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছেন মৃত্যুর দিকে। তাই তিনি প্রাণপণে কাজ করে যেতে চান ভবিষ্যতের সুন্দর পৃথিবীর জন্য।
নাস্তিক, নি:সন্তান এই লোকটি দক্ষিণ আমেরিকার প্রায় সব সম্মানজনক পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁর স্বপ্ন একটি একতাবদ্ধ ল্যাটিন জাতি।
জীবনে আক্ষেপ আছে অনেক কিছুর জন্য, তাঁর সম্পর্কে জানার পর বেড়েছে আরেকট, ইশ, আমার দেশে যদি এমন একজন রাষ্ট্রপ্রধানের জন্ম হতো!
এই লোকটি নোবেল শান্তি পুরষ্কার পাননি। তাতে মনে হয়, তাঁর কোন ক্ষতি হয়নি। নোবেল পুরষ্কার সুযোগ হারিয়েছে সম্মানিত হবার।
লেখাটা বড় হয়ে গেলো, কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমার মনে হচ্ছে আমি কিছুই লিখতে পারিনি এই স্বল্প পরিসরে। এই অবিশ্বাস্য মানুষটি সম্পর্কে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখলেও শেষ হবেনা তাঁর গুণগাঁথা।
সবশেষে, আরো অনেকদিন সুস্থভাবে বেঁচে থাকুন এই মানুষটি-স্রষ্টার কাছে এই মিনতি।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ৯:১৩