বাবা মানুষটাকে নিয়ে আগে কখনও কিছু লিখিনি। লিখার কথাও ভাবিনি। এই মানুষটা বলতে গেলে আমার অপছন্দের তালিকাতেই ছিল। কারণে হোক আর অকারণেই হোক শাসনটা একটু বেশি করতো বলেই হয়তো। তাও আবার তিন ছেলের মধ্যে আমাকেই বেশি। কারণটা আর ব্যাখ্যা করার কিছু নেই। সাধারণত যা হয়। মানুষটার উদ্দেশ্য কখনই খারাপ ছিল না। কোন বাবারই থাকে না। মানুষটা শুধু সব কিছু নিখুঁত চাইত। তাতেই ছিল আমার অনীহা। পড়াশুনা, সামাজিকতা কোনটাই আবার মধ্যে ছিল না। এখনও নেই। সেই তুলনায় আমার বাকি দুই ভাই আমার থেকে হাজার গুনে ভালো। তবে বাবা মারতে গেলে অবশ্যি চুপচাপ বসে থাকতাম না। বরং গলা ফাটিয়ে নির্বিঘ্নে চিৎকার করে যেতাম। পরে মানুষটা এক পর্যায়ে হাল পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছিলেন। এই মানুষটার ছেলেগুলিকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল। এখনো আছে। আমিই খালি স্বপ্নে বাগড়া দিলাম। মানুষটার সাথে অনেক অনেক দিন কথা না বলে ছিলাম জিদ করে। এমনও হয়েছে। একি ঘরে দুজন বসে আছি, অথচ মনে হয়েছে আমি ছাড়া সেই ঘরে আর কেউ নেই। মানুষটা আমার ভালো চাইতো কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি। মানুষটা পরিবারের জন্যে সারাদিন খেঁটে ঘরে ফিরতো। বড় ভাইয়া আর পিচ্চিটা দৌড়ে যেত। আমি ঘরে থেকে বসে বসে আওয়াজ শুনতাম। অথচ, জন্মের পর থেকে আমি এই মানুষটার কাছে মানুষ হয়েছি। এই ছোটবেলায় এই মানুষটার হাতে মাথা রেখে ঘুমিয়েছি। জন্মের সময়ে মার অবস্থা খুব শোচনীয় ছিল। প্রচণ্ড রক্তপাত। ভাইয়ার বয়স মাত্র দু বছর। বাইরে তীব্র তুষারপাত। হাসপাতালে যাবারও উপায় নেই। এই মানুষটার অবস্থা তখন কি ছিল বলা যায়? তারপরও মা, ভাইয়া কিংবা আমার যত্নের এতটুকু কমতি হয়নি। এতটা অকৃতজ্ঞ না হলেও হতো।
এখনকার অবস্থা জানি না, মানুষটা আমাকে নিয়ে কি ভাবেন। এখন প্রায় রাতে টিভি দেখতে থাকা মানুষটার দিকে আমি উঁকি দিয়ে তাকিয়ে থেকে দেখতে থাকি। বয়সের ছাপ চামড়ার ভাঁজে ভাঁজে চলে গেছে। এখন আর সারাদিন খাটাখাটনির পর আগের মত জেগে থাকতে পারেন না। মাঝে মাঝে সাহস করে কাধে একটু হাত রেখে বলি, "শুতে যাও।" এইটূকুই। মানুষটার এই কঠোর একটা খোলসের মধ্যে একটা বাচ্চা লুকিয়ে আছে। আমিই সে বাচ্চাটাকে বের করে আনতে পারিনি। সেই বাচ্চাটাও তো চায়, দিনরাত খাটাখাটনির পর ক্লান্তি হয়ে ঘরে ফেরার পর তাকে আরেকটা বাচ্চা এসে গলাটা জড়িয়ে ধরুক। শেষ কবে গিয়েছি জানি না। কখনও চোখ তুলে তাকাবারও সাহস হয়নি। গতবছর অনেক সাহস করে দূর থেকে ফোনে একবার বলেছিলাম, "হ্যাপি বার্থডে"। অথচ আজকে পাশের রুমে থেকেও বলতে পারছি না, "হ্যাপি ফাদারস ডে'"। শত শত মাইল দূর থেকেও মানুষকে বোঝা যায়। আবার খুব কাছে থাকা মানুষটার ভিতরে কি কাজ করে সেটা বোঝা যায়। খুব অদ্ভুত একটা ব্যাপার।
মানুষটাকে চিনতে আমার অনেক সময় লেগেছে। আবার ভয়টাও অনেক বেড়ে গিয়েছে। সবসময় এই মানুষটা আমার কাছে থাকবে তো ! অনেকের কাছেই হয়তো এখন নেই। তাদের কথা চিন্তা করলে অনেক খারাপ লাগে। মাঝে মাঝে আপন মনেই বলি, "প্রকৃতি তুমি এতো নিষ্ঠুর কেন?"
লিখতে লিখতে দিনটা চলে গেল। এইবছরও বলা হল না। অনেকেই হয়তো বলবেন বাবা দিবস বিদেশে পালন করা হয় ওল্ড হোমে রেখে আসা বাবাকে দেখে আসার একটা উপলক্ষ হিসেবে। আমাদের সবার কাছে প্রতিটা দিনই হোক বাবা দিবস। কথাটা ঠিক। এবং এইটাই হওয়া উচিত। কিন্তু তারপরও আমার মত কিন্তু মানুষের জন্যে এই বাবা দিবসটা অনেক কিছু।