রাত তিনটা বেজে সতের মিনিট। ভ্যাপসা গরম। রাঙ্গামাটিতে বেড়াতে এসেও গরম থেকে বাঁচা যাচ্ছে না। বাঁচা যাবেই বা কিভাবে? প্রকৃতির তো এমন কোন নিয়ম নেই যে ঢাকা থেকে রাঙ্গামাটিতে এলে শীত লাগা শুরু করবে।
বাথরুমে গিয়ে শাওয়ারটা ছেড়ে দিল মিলি। খুব ক্লান্ত লাগছে তার। আবার শাওয়ারের ঠান্ডা পানি শরীর স্পর্শ করতেই ভালো লাগছে। চোখটা বন্ধ করে ফেললো সে। অনেক ঘুম পাচ্ছে। ক্লান্তি যেন তার চোখে ঘুম টেনে দিচ্ছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ঘুমিয়ে পড়বে নাকি আবার?
বাইরে থেকে হটপুটির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। চেয়ার পড়ে যাবার শব্দ। আর হ্যাঁ, টেবিলে রাখা কফি ভর্তি মগটা ভেঙে টুকরা টুকরা হয়ে যাবার শব্দ। নর্দমার কীটটার কাছ থেকে অবশেষে রক্ষা পেল সে। অনেকদিনপর নিজেকে হালকা লাগছে। কম তো সহ্য করেনি সে।
আচ্ছা! এমন তো ছিল না তারেক!! আগের দিনের কথাগুলি ভাবতে গেলেই কান্না পেয়ে যায় মিলির। ইউনিভার্সিটির রঙিন মুহূর্তগুলি - ক্লাসের এপার থেকে ওপারে চোখাচোখি, ক্লাস ফাঁকি দিয়ে কার্জনহল, টিএসসি, সোহরাওয়ার্দি উদ্যান, ধানমন্ডি লেক, হাতিরঝিল, রমনা কিংবা বেইলি রোডে ঘুরতে যাওয়া আর একজন আরেকজনের কাঁধে মাথা রেখে বসে বসে গল্প করা। হঠাৎ দুম করে বিয়ে ফেলা। বাসা থেকে কারোর বাবা মা মেনে নিলো না। তাও, নিজেরা নিজেরা বাসা ঠিক করে থাকা। টিউশানি আর টুকটাক ব্যবসার টাকা দিয়ে তো ছোট্ট সংসারটা খুব ভালই চলছিল। কিন্তু হঠাৎ করে সব ক্যামন যেন এলোমেলো হয়ে যেতে লাগলো। এইসহজ সরল ছেলেটা বদলে যেতে শুরু করলো। রাত-বিরাতে নেশা করে করে বাড়ি ফিরতে লাগলো। একদিন মিলি বাসায় এসে যে ধাক্কাটা খেল, তা বলার নয়। ঘরে আরেকটা মেয়ে আর তারেক!! সেদিন মিলি জিজ্ঞেস করতে তারেক মিলির গায়ে হাত তুলে বসলো। এরপর তো হাত তোলার ব্যাপারটা যেন খুব নিয়মিত পর্যায়ে চলে মিলি কল্পনাও করতে পারেনি। সেদিন থেকে কত যে কেদেছিল মিলি।
ক্যানো এমন হয়ে গেল তারেক? মানুষটার সরলতার খোলসের ভিতর যে এইরকম একটা পশু লুকিয়ে থাকতে পারে এটা সে কেন আঁচ করতে পারলো না?
আর কিছু চিন্তা করতে ইচ্ছে করছে না। কল বন্ধ করে গা মুছে শুকনা কাপড় পরে বেরিয়ে আসলো আসলো মিলি। টেবিলের কাছে ফ্লোরে বেকায়দায় পড়ে আছে তারেক। মুখ ভর্তি ফ্যানা। নিষ্প্রাণ চোখগুলি যে মিলির দিকেই তাকিয়ে আছে। তাতে দৃষ্টিটা ভয়ের, অনুতাপের নাকি ঘৃণার ঠিক বোঝা গেল না। মিলি বুঝতেও চায় না আর। রেস্টহাউজের রুমের দেয়ালে লাগানো ঘড়িতে সময় দেখল সে। রাত তিনটা বেজে সাতান্ন মিনিট। আর এক মুহূর্তও থাকতে ইচ্ছে করছে না এখানে। একসময়ে হয়তো ধরা পড়বে সে। বিষ মেশানো কফি খাইয়ে খুন করার দায়ে তার ফাঁসি আর না হয় যাবজ্জীবন জেল হবে। হলে হউক। এই জীবন থেকে জেল অনেক ভালো।
একটা চাঁদর গায়ে জড়িয়ে রেস্ট হাউজ থেকে বেড়িয়ে এল সে। আচ্ছা! চাঁদর কেন গায়ে দিল? এখন তো ভ্যাপসা গরম!
অতকিছু মাথায় আনার সময় নেই। অনেকদূর যেতে হবে। কোথায় যাবে মিলি জানে না। কিন্তু যেতে হবে।