বহুদিন পর অবশেষে সিরিজের ৮ম অস্ত্রটা নিয়ে গ্যাজানোর মতো সময় পেলাম । মাঝখানে ব্যস্ত ছিলাম বললে কিছুটা ভুল হবে , আসলে আমি যথেষ্টই অলস প্রকৃতির । আদৌ কেউ যদি এই পর্বের জন্য অপেক্ষা করে থাকেন , দেরি হবার জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত ।
=======
MG-42
=======
হেভি মেশিনগানের জগতে এর প্রতাপ যারা প্রত্যক্ষ করেছে , তারা সেই স্মৃতি আজীবন বয়ে বেড়িয়েছে । কারো স্মৃতি এর ট্রিগারে হাত রাখার , কারোরটা এর শব্দ শোনার । কারন এর দ্বারা ঘায়েল হবার পর কারো বেচে থাকার কথা না । এর দাপটে ছাড়খার হয়ে যেত... না , সবকিছু না , শুধু যেটার তাক করা হতো সেটাই ছাড়খার হতো । আর বিশ্বাস করুন , আপনি যখন যুদ্ধক্ষেত্রে , আপনি কোনভাবেই চাইবেন না এর নলটা আপনার দিকে থাকুক । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যে কয়টা নাৎসিদের জিনিস সবাই ভয় পেত , তার লিস্টে এটা উপরের দিকেই থাকার কথা । আস্ত এক কোম্পানি সৈন্যের বুকে ত্রাস ছড়ায় দিতে এই জিনিস এক ডজন লাগে না , দুটাই যথেষ্ট । এর একটা ডাকনামও আমেরিকানরা দিয়েছিলো , 'Hitler's Buzz Saw' ।
=======
এর আসল নাম "মাশিননগাইওয়েভ'র ৪২" (Maschinengewehr 42) বা ইংরেজি অনুবাদে MachineGun 42 । এর ডিজাইনার ওয়ার্নার গ্রুনার সম্ভবত কল্পনাও করেন নি কখনো যে তিনি ইতিহাস রচনায় অংশ নিবেন । তিনি মূলত যে ফ্যাক্টরিতে কাজ করতেন তাদের মূল কাজ ছিলো হারিকেন তৈরি করার । অস্ত্র নিয়ে তাদের কোন পূর্বের অভিজ্ঞতা ছিলো না । তাকে পাঠানো হয় মিলিটারি ইউটিলিটি ট্রেনিং এ , যেন নিজেকে এসবের সাথে সাক্ষাৎ করিয়ে নিতে পারেন ।
যেহেতু তিনি মাস প্রোডাকশনের উপর স্পেশালাইজড ছিলেন , তাই যখন এমজি ৩৯ এর ডিজাইন করেন , তার প্রোডাকশন টাইম পূর্বের এমজি ৩৪ এর চেয়ে ৫০ শতাংশ কম সময়ে মাত্র ৭৫ ঘন্টায় তৈরি সম্ভব হয় আর দাম কমে যায় ২৪ শতাংশ । কিন্তু একটা সমস্যা রয়ে গেলো , জার্মানদের তখন দরকার নতুন কিছু । তাই তারা এটাকে ঘষামাজা করে অবশেষে দাড়া করালো এমজি ৪২ এর ডিজাইন ।
এর ডিজাইন কতটা ইনোভেটিভ তা বলে শেষ করা যাবে না ।
আমরা জানি যে , র্যাপিড ফায়ারের কারনে অস্ত্রের ব্যারেল গরম হয়ে যায় তখন এটাকে যেভাবেই হোক ঠান্ডা করতে হয় । তৎকালীন সময়ের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলো ব্রাউনিং , তারা ব্যবহার করতো ওয়াটার কুলিং সিস্টেম যা ব্যাপক ঝামেলা (জ্যাকি চ্যানের 1911 সিনেমাটায় দেখেছিলাম অস্ত্রের মধ্যে প্রস্রাব করতে, DISGUSTING !! ) । জার্মানরা ব্যবহার করেছিলো এয়ার কুলিং সিস্টেম । কিন্তু এতে তো অস্ত্র আরো তারাতারি গরম হবে না ?? সে জন্যই এতে ব্যবহার করেছিলো রিপ্লেসেবল ব্যারেল । গরম হয়ে গেলো , সাথে সাথে খুলে ৫ সেকেন্ডের মধ্যে আরেকটা ব্যারেল লাগায় দেন আর আগেরটা ঠান্ডা হতে সময় দেন ।
এরকম খুটিনাটি অনেক কিছুই আছে । সব বলে দিলে মহাকাব্য হয়ে যাবে ।
১৯৪২ সালে এর ডিজাইন কমপ্লিট হয় এবং সে বছরই এটাকে মাঠে নামিয়ে দেওয়া হয় । মওজার ওয়ের্কে এজি এবং গ্রযফুয এজি এর ম্যানুফেকচারিং এর দায়িত্ব নেয় । শুরুতে ফিল্ড টেস্ট হিসেবে ১৫০০ তৈরি করা হয় , আর এর মজা বুঝার পর মাত্র ৪ বছরে ৪০০০০০ এর বেশি এই বস্তু তৈরি করা হয় ।
কার্যনীতি : রিকয়েল অপেরেটেড , রোলার লকড ।
=======
এতে ব্যবহার করা হতো 7.92x57mm মওজার কার্ট্রিজ । ফিডিং সিস্টেমে কোন ম্যাগাজিন বা কন্টেইনার ব্যবহার হতো না , যেহেতু এটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের হেভি মেশিনগান । এতে বেল্ট ব্যবহার হতো , তা ৫০ রাউন্ডের ও ২৫০ রাউন্ডের পাওয়া যেত ।
=======
ঠিক কি কারনে এর কদর এত বেশি ??
একটা কারন তো বলেই দিয়েছি , এর ওভারহিটিং সমস্যা সমাধান করা হয়েছিলো । এবার বাকিগুলাও বলা যাক ।
এর অপরদিকে ছিলো আমেরিকার এম১৯১৯ ব্রাউনিং মেশিনগান যাকে ডাকা হতো 'থার্টি ক্যাল' । তার ইফেকটিভ রেঞ্জ ছিলো ১৫০০ মিটার , আর জার্মান এমজি ৪২ এর অ্যাডজাস্টেবল সাইট দিয়ে তা ২০০০ মিটার গড়াতো ।
থার্টি ক্যাল এর ফায়ার রেট ?? এমজি ৪২ এর তুলনায় হাস্যকর । মাত্র ৪০০-৬০০ রাউন্ড পার মিনিট আর অপরদিকে জার্মানরা চালাতো ১২০০-১৪০০ রাউন্ড পার মিনিট ।
এমনকি এই অস্ত্রকে অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট ওয়েপন হিসেবেও ব্যবহার করা যেত । ভাবতে পারেন !!
এখন হয়তো বলবেন , ব্রিটিশ থমসন ১৫০০ রাউন্ড ফায়ার রেট দেখাতো । আরে থমসনের ব্যারেল দিয়ে বের হতো .45 ACP পিস্টল রাউন্ড । তার সাথে মওজার কার্ট্রিজ এর তুলনা চলে না ।
এর আরেকটা সুবিধা ছিলো একে নিয়ে চলাচল করা সহজ । লম্বাটে শেপের হওয়ায় বহন করা সহজ , শত্রু দেখার সাথে সাথে সেট করে শত্রুকে মাংশের মোরব্বা বানায় ফেলাও সহজ ।
এটা রিকয়েল অপারেটেড হওয়ায় ব্যবহারকারীকে (যে সেই মূহুর্তে একজন সিরিয়াল কিলার) কোন রিকয়েল সহ্য করতে হতো না ।
এর আওয়াজ ছিলো অত্যান্ত ব্যাতিক্রমী , এর অবশ্যই .. ভয়াবহ । আপনি হয়তো ভাববেন যে , শত্রু তো শুনেই বুঝে যাবে এটা এমজি ৪২ আর সতর্কভাবে কাউন্টার স্ট্র্যাটেজি বের করে ফেলবে । না ! বাস্তবে মোটেও তা হতো না ! এটা শত্রুর মনে আতংক ছড়ায় দিতো । শত্রু সৈন্যদের মরালিটি চূরমাড় হয়ে যেত ।
আমেরিকানরা যুদ্ধের সময় তাদের ট্রেনিং এর সময় শুধুমাত্র এর শব্দের সাথে পরিচয় করায় দিতে বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছিলো । সত্যিই অন্য কোন মেশিনগানের শুধুমাত্র শব্দ দিয়ে শত্রুর কলজে নাড়িয়ে দেওয়ার যোগ্যতা ছিলো না ।
=======
এর সমস্যা... ?? আসলে এর সমস্যা খুজে বের করা বেশ কঠিন । একটা অসুবিধা আছে অবশ্য । আগেই তো বলেছি এর কুলিং সিস্টেমের জন্য এর ব্যারেল পাল্টাতে হতো । তাতে যে ৪-৬ সেকেন্ড সময় ব্যয় হতো , শত্রুরা সেটার জন্যই অপেক্ষা করতো । তাদেরকে সেরকম নির্দেশনাই দেওয়া হতো যেন তারা এই ছোট্ট সময়ের বিরতিটা ব্যবহার করে । আর টানা ব্রাশ ফায়ার করা হলে এটা প্রতি ১৭০-২০০ রাউন্ডের মধ্যেই করা লাগতো । এইই ।
=======
এর আসলে তেমন প্রকৃত ভ্যারিয়েন্ট নেই । যা আছে সব আসলে যুদ্ধের পরে অন্যান্য দেশের বানানো নকল । এর মাঝে উল্লেখযোগ্য আছে - সুইস এমজি ৫১ , যাসতাভা এম৫৩ (যুগোস্লাভিয়া) ইত্যাদি ।
তবে জার্মান বাহিনী আজও এর একটা ভ্যারিয়েন্ট ব্যবহার করে , রেইনমেটাল এমজি ৩ ।
=======
সেই আমলে অস্ত্রে তেমন গ্যাজেট ব্যবহার করা হতো না । তবুও মাঝে মাঝে এতে স্কোপ ব্যবহার করতো ।
=======
এই অস্ত্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্য যেকোন অস্ত্রের তুলনায় বেশি রাউন্ড গুলি ছুড়েছে । এর ব্যবহার কিন্তু থেমে যায় নি । এখনো সিরিয়ার এই সিভিল ওয়ারে এই অস্ত্র ব্যবহার হয় । মূহুর্তের মধ্যে যুদ্ধক্ষেত্রের পরিবেশ পাল্টে দিতো এই অস্ত্র । একটা কুড়ে ঘরকেও এটা মূর্তিমান দুর্গে পরিণত করতে পারতো । যতদিন মানুষ শিশার বুলেটে তামার খোলস ব্যবহার করবে , ততদিন এই অস্ত্রের কথা মানুষের স্মরণে থাকবে ।
=======
এই হলো আজকের অস্ত্র পরিচিতি ।
এর পরে আসছে - কোন একটা স্নাইপার রাইফেল (এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারি নাই কোনটা নিয়ে লিখবো)
পড়ার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ
=======
এই সিরিজের পূর্বের পর্বগুলো -
AK 47 - Click This Link
M1 Garand - Click This Link
IMI Desert Eagle - Click This Link
Remington 870 - Click This Link
Scorpion VZ 61 - Click This Link
Thompson SMG - Click This Link
Sten Gun - Click This Link